রোনালদোর পায়ে আবার স্বপ্ন দেখার পালা ইউনাইটেডে
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
১২ সেপ্টেম্বর ২০২১
এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও স্বপ্ন দেখছে নতুন করে। স্বপ্ন সত্যি করে দেখানোর মালিক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যে এসে গিয়েছেন!
‘ক্রিস্টিয়ানো, বল ভুলে যাও। ওই বল তোমায় খাওয়াবে না। ক্লাস মিস কোরো না। মনে রেখো, স্কুলই আসল, যা তোমার ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেবে। ওই বল তোমায় কিচ্ছু দেবে না!’
তখন পঞ্চম শ্রেণিতে। রোজ দিদিমণি ওই একই কথা বলতেন। না বলে উপায় ছিল না তাঁর। রোজই ক্লাসে ঢুকত যখন ক্রিস্টিয়ানো, হাতে বল। দেখলেই রেগে যেতেন দিদিমণি। তিনি অবশ্য এখনও আসেন ক্রিস্টিয়ানোর বাড়ি, প্রায়ই। আর এসে নিজের ভুলের কথা জোর গলায় বলেন, আর তাঁর স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের বাবা-মাকে আগেই শুনিয়ে দেন, ওই বয়সী কোনো ছেলেকে আর বল নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে দেখলে কোনো দিনও বকবেন না। যা শিক্ষা তাঁকে দিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো!
ভাগ্যিস ওই দিদিমণির কথা শুনে ফুটবল কখনও পা ছাড়া করেননি! ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সই করলেন সপ্তাহ দুয়েক আগে। ইংল্যান্ডের ফুটবল প্রাণ পেল, গর্ডে উঠল টুইটার। তার কিছুদিন আগে লিওনেল মেসির বাধ্য হয়ে দল বদলে রেকর্ড হয়েছিল সমাজমাধ্যমে। তার চেয়ে মাত্রই সাত লক্ষ বেশি ‘উল্লেখ’ পেল ক্রিস্টিয়ানোর খবর। কেন, প্রমাণ পেতে অবশ্য দু-সপ্তাহও অপেক্ষা করতে হল না!না এলেও তাঁর জয়গাথায় মুখরই থাকত ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। ভিনি-ভিডি-ভিসি আবারও। এলেন-খেললেন-জিতলেন-জেতালেন। দু-গোল নিজের, দলের চার। তাঁর জন্য ইউনাইটেডের পারফরম্যান্সে অন্য মাত্রা। তাঁর পর্তুগিজ সতীর্থ, এই তো সে দিন ইউরোতে নিতান্ত নিষ্প্রভ যিনি, ব্রুনো ফার্নান্দেজের পা থেকে বেরোলো দিনের সেরা গোল। খেলা শেষে আর প্রিমিয়ার লিগে চেলসির পরের খেলার আগে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ইপিএল শীর্ষে আবার, চতুর্থ ম্যাচের পর। সব গল্পই ফিরে আসার এবং জয়সূচক!
ঠিক ১২ বছর ১১৮ দিন পর প্রিমিয়ার লিগে খেলতে নেমে নতুন রেকর্ড হল। আগে ২৯২ ম্যাচে ১১৮ গোল ছিল, এখন ২৯৩ ম্যাচে ১২০। যত দিন যাবে, এই রেকর্ড আরও দুর্ধর্ষ হবে। ইউনাইটেডে প্রথম পর্বের ক্রিস্টিয়ানো গোল করার ব্যাপারে এতটা ধারাবাহিক ছিলেন না, এখন যেমন। শেষ পাঁচ ক্লার মৌসুমে তাঁর গোল যথাক্রমে ৪২, ৪৪, ২৮, ৩৭ এবং ৩৬। সঙ্গে যোগ করুন ২০১৬ থেকে পর্তুগালের জার্সিতে ৫৭ ম্যাচে ৫৬ গোল! তাঁর বয়স ৩৬, আগামী ফেব্রুয়ারিতে ৩৭ হবে, বলছেন নাকি কেউ? আরও একবার ৪০ গোলের ক্লাব মৌসুমের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন, চাইলে ল্যাডব্রোকসে লগ্নিও করে ফেলতেই পারেন!
আধুনিক ফুটবলে বক্সে তাঁর নড়াচড়া, গোলের গন্ধ খুঁজে ঠিক সময় ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাওয়া... এখন ফুটবলের রূপকথায়। প্রথম গোলের সময় যেমন। শট নিয়েছিলেন ম্যাসন গ্রিনউড। সোজা বল ধরতে গিয়ে ফসকালেন নিউক্যাসলের হতভাগ্য গোলরক্ষক ফ্রেডি উডম্যান। আর ফসকেই প্রমাণ পেলেন, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়! টুক করে বলটা জালে পাঠিয়ে পরিচিত লাফ দিতে শূন্যে উঠে পড়েছেন ততক্ষণে ক্রিস্টিয়ানো।
প্রথমার্ধের সংযুক্ত সময় ধরলে ৪৭ মিনিটে গোল। একা ক্রিস্টিয়ানোর নয়, চাপের পাহাড়টা সরে গেল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ওপর থেকেও। দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামার ১৭ মিনিট পর, ম্যাচের ৬২ মিনিটে লুক শ মাঝখান দিয়ে অনেকটা দৌড়ে উঠে এলেন। দুর্দান্ত পাস দিলেন ক্রিস্টিয়ানোকে। ডান পায়ে বল নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে বাঁ পায়ের জোরালো শটে বল রাখলেন আবার সেই ফ্রেডিকে বিব্রত করতে, দু'পায়ের মাঝখান দিয়ে, জালে। এ যেন দূর থেকে শটে নাটমেগ!
ক্রিস্টিয়ানোরা আসলে এমনই। তাঁরা এলে দলের মনোবল কী করে যেন বেড়ে যায়। অদ্ভুতভাবে জুভেন্টাসে ততটা হয়নি বিশেষ। কিন্তু লাল জার্সিতে ফিরে এসে মাঠভর্তি দর্শকের পাশাপাশি টেলিভিশনে চোখ রেখে বসে থাকা তাঁর বিশ্বজোড়া ভক্তদের আশ্বাস দিলেন, সঙ্গে গ্যালারিতে বসে-থাকা লালমুখো প্রাক্তন গফার অ্যালেক্স ফার্গুসনকেও যে, তিনি পৌঁছে গিয়েছেন আবারও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পরিত্রাতা হয়ে উঠতে। তাই তো এডিনসন কাভানি কোনো কথা না বলেই সাত নম্বর জার্সির মালিকানা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি আসা মাত্রই। জানেন, খুব ভাল করেই জানেন, কিছু কিছু জিনিসের উত্তরাধিকারী হওয়া কঠিন। বাড়ির বড় ছেলে বহু দিন বিদেশবাসের পর ফিরে এলে তাঁকে তাঁর পছন্দের ঘরটাই ফিরিয়ে দিতে হয়। সেটাই দস্তুর, সৌজন্য, ভালবাসা, শ্রদ্ধা।
প্রথম ৯০ মিনিট দেখেই কি এত বড় নিশ্চয়তা দেওয়া যায়? সম্ভব, ফুটবলারের নাম ক্রিস্টিয়ানো বলেই।
তিনি এলেন মানে গোলও পাবেন। নিজের হাসি চওড়া হবে। দলের ফুটবলারদেরও বাড়বে আত্মবিশ্বাস। পল পগবা, ব্রুনো ফার্নান্দেজরা এখন জেনে গেলেন আরও ভাল করে যে, তাঁদের মাথা থেকে দলকে জেতানোর হিমালয়প্রমাণ চাপের বোঝাটা স্বেচ্ছায় মাথা পেতে নিয়ে নিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো। যার প্রমাণ হাতেগরম প্রত্যাবর্তনের ম্যাচেই। শেষ দুটো গোলেরই অ্যাসিস্ট পগবার!
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তাই আবার স্বপ্ন দেখা শুরু, নতুন করে। এসে গিয়েছেন যে স্বপ্ন সত্যি করে দেখানোর মালিক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো!