উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
সমর্থকদের চক্ষুশূল থেকে প্রিয় মুখ বেনজেমা
রাইসান কবির
২০ নভেম্বর ২০২১
আগের সেই ভুড়ি ভুড়ি মিস করা বেনজেমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মাঠে। সুযোগ পেয়ে সুযোগ কাজে লাগানোটাই তাঁর জন্য এখন স্বাভাবিক। একসময় দলের বোঝাতে পরিণত হয়ে যাওয়া বেঞ্জু এখন হয়ে গেছেন দলের ত্রাণকর্তা। রোনালদো-পরবর্তী যুগে রিয়ালকে তো টানছেন তো তিনিই।
এখন থেকে প্রায় ছয় বছর আগের ঘটনা। ফ্রেঞ্চ তারকা করিম বেনজেমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে সতীর্থ ম্যাথু ভালভুয়েনাকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের। এই ঘটনার জেরে দুজনই জাতীয় দল থেকে জায়গা হারান, খেলতে পারেননি ২০১৬ সালের ঘরের মাঠের ইউরোতে।
এই কেলেঙ্কারির জেরেই কিনা কে জানে, এর পরের কয়েক বছর বেনজেমার মাঠের পারফরম্যান্স ছিল একেবারেই সাদামাটা। ২০১৬-১৭ আর ২০১৭-১৮ এই দুই মৌসুমে স্ট্রাইকার বেনজেমা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন কীভাবে গোল করতে হয়। পরিসংখ্যান বলছে, ওই সময়টাতে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে তাঁর গোলসংখ্যা যথাক্রমে ১৯ ও ১২। তার চেয়েও বড় কথা, দৃষ্টিকটু সব মিসের কারণে ভক্তদের কাছে খলনায়কে পরিণত হয়েছিলেন বেনজেমা। বার্নাব্যুর দুয়োধ্বনিতে হয়ত ত্যক্তবিরক্তই হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
তবে বেনজেমার এই দুর্দিনেও তার ওপর আস্থা রেখেছিলেন কোচ জিনেদিন জিদান। দুই মেয়াদে রিয়ালের দায়িত্বে থাকা জিদান এত ব্যর্থতার পরেও সুযোগ দিয়ে যাচ্ছিলেন প্রিয় শিষ্য বেনজেমাকে। এত সুযোগ পেয়েই কিনা কে জানে, ধীরে ধীরে যেন বদলে যেতে থাকলেন বেনজেমাও। ২০১৭-১৮ মৌসুমের শেষে রিয়াল মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ক্লাব ছেড়ে পাড়ি জমান জুভেন্টাসে। এরপর থেকেই যেন বদলে যাওয়া শুরু!
রোনালদো-পরবর্তী যুগে প্রথম মৌসুমে রিয়ালের হয়ে ৫৩ ম্যাচ খেলে ৩০ গোল করেন বেনজেমা। তখন থেকেই যেন নতুন করে পথচলা শুরু হলো তাঁর, আর তাকাতে হয়নি পেছন ফিরে। পরের মৌসুমে ৪৮ ম্যাচে গোল করেছেন ২৭টি। তার পরেরটায় যেন আরও বেশি ধারালো। ৪৮ ম্যাচেই জাল খুঁজে পেয়েছেন ৩০ বার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বদলে যাওয়ার এই সময়টাতে নিজের ফিনিশিংয়ে দারুণ উন্নতি এনেছেন তিনি। আগের সেই ভুড়ি ভুড়ি মিস করা বেনজেমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মাঠে। সুযোগ পেয়ে সুযোগ কাজে লাগানোটাই তাঁর জন্য এখন স্বাভাবিক। একসময় দলের বোঝাতে পরিণত হয়ে যাওয়া বেঞ্জু এখন হয়ে গেছেন দলের ত্রাণকর্তা। রোনালদো-পরবর্তী যুগে রিয়ালকে তো টানছেন তো তিনিই। চেলসি থেকে বেলজিয়ান সুপারস্টার এডেন হ্যাজার্ডকে নিয়ে আসলেও প্রথম দুই মৌসুম তাঁর কেটেছে ইঞ্জুরির ছোবলেই। এই মৌসুমে সুযোগ পেয়েও সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি নিজেকে। অনভিজ্ঞ-আনকোরা এই ফরোয়ার্ড লাইনে তাই গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছেন অভিজ্ঞ বেনজেমাই। ২০১৯-২০ মৌসুমে রিয়ালের লা লিগার শিরোপা জয়েও ডাগআউটের মাস্টারমাইন্ড জিনেদিন জিদানের পাশাপাশি দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল স্ট্রাইকার করিম বেনজেমার।
চলতি মৌসুমেও যেন আগুনে ফর্মে আছেন বেনজেমা। এখন পর্যন্ত ১৫ ম্যাচ খেলে গোল করে ফেলেছেন ১৪টি। কার্লো আনচেলত্তির অধীনে এবারের মৌসুমে রিয়ালের অসাধারণ ফর্মের বড় কারণ তিনিই। ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডার কিড ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের সাথে বেনজেমার অসাধারণ রসায়নে এখনো পর্যন্ত এই মৌসুমে ভালোমতোই টিকে আছে রিয়াল মাদ্রিদ।
বদলে যাওয়া করিম বেনজেমার আরও আনন্দের ঘটনা ঘটেছে এই সময়ে। ছয় বছর আগে যে জাতীয় দলের দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল চিরতরে, সেই দরজাটাও খুলেছে অবশেষে (খুলতে বাধ্য হয়েছে বলাটাই হয়ত শ্রেয়)। বেনজেমার এমন আগুনে ফর্মের কারণে তাঁকে আর উপেক্ষা করতে পারেননি কোচ দিদিয়ের দেশম। জাতীয় দলের হয়ে ইউরোতে ফিরেই ৪ ম্যাচে ৪ গোল করে জানান দিয়ে রেখেছেন এখনো ফুরিয়ে যাননি তিনি। এরপর উয়েফা নেশনস লিগেও চ্যাম্পিয়ন করেছেন ফ্রান্সকে। ফাইনালে অসাধারণ এক গোল করে ফ্রান্সের জয়ে রেখেছেন বড় ভূমিকাও।
একসময় গোল করতে ভুলে যাওয়া, দলের বোঝাতে পরিণত হওয়া, ভক্তদের চক্ষুশূল হয়ে যাওয়া, জাতীয় দল থেকে নির্বাসিত করিম বেনজেমা যেভাবে সব সমালোচনার জবাব দিয়ে যাচ্ছেন এক এক করে, তাতে মনে হতেই পারে, যেন রূপকথার কোনো গল্পে ভ্রমণ করে চলেছেন বেঞ্জু।