চেনা মাটি চেনা পাড়ায়
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
২৯ অক্টোবর ২০২১
চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম দুই ম্যাচ হেরেও না, এল ক্লাসিকো হেরেও না, বার্সেলোনা কোচ হিসেবে রোনাল্ড কোম্যানের বিদায়ঘণ্টা বাজল রায়ো ভায়েকানোর কাছে হেরে। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে জাভির নামটাই শোনা যাচ্ছে সবচেয়ে জোরেশোরে। যা শুনে কাশীনাথ ভট্টাচার্যের মনে পড়ে গেল কবীর সুমনের গানের কলি, `চেনা মাটি চেনা পাড়া`য়।
ব্রায়ান লারার মেয়ের নাম সিডনি। আমাদের ক্রিকেটপ্রবণ উপমহাদেশে অনেকেই জানেন কারণ। ১৯৯৩ সালে সিডনিতে টেস্টে প্রথম শতরান পেয়েছিলেন লারা, শেষ পর্যন্ত থেমেছিলেন ২৭৭ রানে। সেই ইনিংস যা লারাকে দিয়েছিল পরিচিতি। তাই মেয়ের নাম সিডনি।
জাভি এরনানদেস-এর মেয়ের নাম জানেন?
এবার সমস্যা। কারণ, ‘জাভির নাম জানি, এটাই তো যথেষ্ট, ওঁর মেয়ের নামও জানতে হবে নাকি’, বলে ফেলবেন উপমহাদেশের ফুটবল-পাঠক। আসলে আমাদের এই উপমহাদেশে জাভি যে আর লারা নন!
সত্যি কথায়, ‘জাভি’ নামটাও আমরা ঠিকঠাক জানি না! অন্তত, উচ্চারণের দিক দিয়ে। ইউরো প্রতিযোগিতার আগে ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি লেখায় পড়েছিলাম ডেরেক রে-র বক্তব্য। ফিফা ভিডিও গেমস-এ তাঁর কণ্ঠ ব্যবহৃত হয়, ইএসপিএন-এ বুন্দেসলিগার ধারাভাষ্য দেন। অন্তত পাঁচটি ইউরোপীয় ভাষায় পণ্ডিত মানুষ ডেরেকের বক্তব্য ছিল সহজ – ‘নিজের নামটা কেউ ঠিকঠাক উচ্চারণ করছে শুনলে বেশ ভালো লাগে। ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ যখন নামের উচ্চারণটা ঠিক করে, আনন্দ হয় জেনে যে, অন্তত আমার দেশ, ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধায় কার্পণ্য করছেন না। আমরা কেউই ভাষাবিদ নই, কিন্তু এই সামান্য চেষ্টাটুকু, অর্থাৎ কারও নামটা ঠিকঠাক উচ্চারণের চেষ্টাটুকু অন্তত করতেই পারি।’
গত বছর কুড়ি-একুশ ‘হাবি-জাবি’ ইত্যাদি নানারকম লিখে ‘খাবি’ খেতে খেতে যখন জাভির নামের কাতালান উচ্চারণ শুনতে গেলাম ইন্টারনেটে, পেলাম ‘শাবি’! এই উচ্চারণ স্পেনীয় নয়, কাতালান। আনেকেই জানেন, স্পেন আর কাতালুনিয়ার দীর্ঘ বিরোধিতার ইতিহাস, যা এল ক্লাসিকো অর্থাৎ রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার বিরোধিতাকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। তাই জাভির নামের উচ্চারণ স্পেনীয় নয়, কাতালানে কেমন, জানাটা জরুরি ছিল। আইপিএ (ইন্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যালফাবেট) অনুসারে ইংরেজির ‘এক্স’ অক্ষর সাধারণত কাতালানে ‘তালব্য শ’-এর মতো উচ্চারিত হয়। হায় রে, আমাদের এতদিনের স্পেনীয় ‘হাবি-জাবি’ পণ্ডিতি!
তবে হ্যাঁ, স্পেনীয় হোক বা কাতালান, ‘এইচ’ এই ভদ্র লেটারটি কিন্তু কোথাও উচ্চারিত হন না! তাই ‘হার্নান্দেজ’-এর মতো প্রবল ইংরেজি-প্রধান উচ্চারণ ছেড়ে এরনানদেজ বা এরনানদেস বলুন, সামান্য হলেও কাতালান সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করুন, জাভিরা খুশি হবেন।
আর ধান ভানতে শিবের গাজন যে কারণে, জাভির প্রায় ছ-বছরের ফুটফুটে কন্যার নাম, ‘এশিয়া’। আমাদের মহাদেশের নাম, কারণ, জাভি সেই মৌসুমেই এসেছিলেন বার্সেলোনা ছেড়ে, কাতারের আল সাদ ক্লাবে, খেলতে। জাভির মেয়ের নাম ‘মাসিয়া’ বা ‘বার্সেলোনা’ হলে নামকরণের সার্থকতা বিচারে ক্লাস টেনের বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নের মতো উত্তর লিখতে সুবিধে হতো কি না, আলাদা বিষয়! বার্সেলোনা, স্পেন এবং বিশ্ব ফুটবলে সর্বকালের অন্যতম সেরা পাসার সম্মান জানিয়েছেন আমাদের মহাদেশকে, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় আত্মজার নামে জুড়ে দিয়ে, সেই জন্যও জাভির প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ল আরও।
আসলে জাভি মানেই যে ফুটবল সমাজের সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির ছোটখাটো চেহারা, জিম-পেটানো ভার-তোলানো সিক্স-এইট-প্যাক নয়। মাঝমাঠের মাঝখানে খেলেও ট্যাকল করতেনই না! তিনি ছিলেন গানের আসরে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ‘কনডাক্টর’-এর মতো, যাঁর অঙ্গুলি এবং হাতের সঞ্চালনে বাজনদারদের বাজনা এবং গায়কের গান শুরু হয় বা থেমে যায়। সঞ্চালক, কিংবা, পুতুল নাচ দেখেছেন যাঁরা জানবেন, পর্দার পেছনে থাকা সেই পুতুল নাচানোর লোকটাকে, আঙুলে নানা সুতোয় বেঁধে-রাখা পুতুলদের নাচিয়ে দর্শককে আমোদ দিয়ে এসেছেন যিনি।
ক্রিকেটে এবি ডি ভিলিয়ার্স আসার পর ‘তিন শ ষাট ডিগ্রি’ কথাটা বেশ চলছে। বার্সেলোনার মাঝমাঠে জাভির ‘সিগনেচার মুভ’ ছিল ওই ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে-যাওয়া। কাতালানরা বলতেন ‘লা পেলোপিনা’। বুসকেটসরা কত চেষ্টা করলেন। পেলোপিনা ততটা সুন্দর তো হলোই না, কার্যকারিতার প্রসঙ্গ তো তোলাই উচিত না!
আসলে জাভি মানে এত সবের ওপরে যা থেকে যাবে, ২০০৫-২০১৫ বছর দশেক সেই ফুটবলারকে দু'চোখ ভরে দেখার এক অনাস্বাদিত আনন্দ। এমন কেউ যিনি শুধু পাস দিয়েই খুশি। বল পাচ্ছেন, পাস দিচ্ছেন, আবারও বল পাচ্ছেন, পাস দিচ্ছেন। বল পায়ে নিয়ে একটা সেকেন্ডও অতিরিক্ত রেখেছেন, কেউ বলতে পারবেন না। পেপ গার্দিওলাই বোধ হয় একবার বলেছিলেন, 'জাভির পায়ে বল আসার পর ভিডিওটা থামিয়ে দিন। মাঠের পরিস্থিতি দেখুন মন দিয়ে। ভাবুন, কাকে বা কোথায় পাস দিলে দলের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকার হবে। ভেবে নিয়েছেন? এবার ভিডিওটা আবার চালু করুন। অবাক হয়ে দেখবেন, আপনি এতটা সময় নিয়ে যা ভেবেছিলেন, সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে সেই কাজটাই মাঠে করে এসেছে জাভি!'
সেই জাভি এবার কোচের আসনে বসবেন বার্সেলোনায়। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন নিয়ে ‘হোম কামিং’ শব্দটা সচেতনভাবেই পরিহার করেছে ইংরেজি প্রচারমাধ্যম। কেন, বুঝতে গভীরে যেতে হবে না। তা হলে যে যে কারণে ‘ঘরে ফেরা’ এত দিন ব্যবহৃত হচ্ছিল সেগুলোর গোড়ায় যে টান পড়তে পারে! ১৯৯২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত যে ঘরে ছিলেন, মাঝের এই ছয় বছর সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংস্কৃতির দেশ কাতারে কাটিয়ে আবার ফেরা, কবীর সুমনের গানের কথামতো ‘চেনা মাটি চেনা পাড়া’য়। সেই ন্যু ক্যাম্প, সেই সাজঘর, সেই লা মাসিয়ার দিনগুলো ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সঁপে দিতে চাইছে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ক্লাব। এবং, এবার তিনিও রাজি, গত বছর তিনেক আল সাদ-এর দায়িত্বে থাকার পর। হয়তো, আগামী চব্বিশ ঘণ্টাতেই পাকা কথা।
রোনাল্ডো কোম্যানও বার্সেলোনা-প্রাক্তন ছিলেন। কিন্তু তিনি বার্সেলোনায় আর যে-ই হোন, জাভি নন। তাঁর কোচিং জীবনে বার্সেলোনা ক্রমশ নেমেছে। এমনকি, লিওনেল মেসিকেও ছেড়ে যেতে হয়েছে বার্সেলোনা। এল ক্লাসিকো হেরেছেন অনেকেই। শুধু সেই কারণে চাকরি হয়তো যেত না, ডেস্ট আগে ফাঁকা গোলে বল ঠেলে দিতে পারলে তো যেতই না হয়তো। কিন্তু রায়ো ভায়েকানোর কাছেও হার! চ্যাম্পিয়নস লিগে পরপর দুটি হার দিয়ে অভিযান শুরু? বাড়াবাড়ি তো বটেই।
আপাতত সের্জি বারহুয়ান দায়িত্ব সামলাবেন বার্সেলোনার, যত দিন না জাভি সরকারিভাবে দায়িত্ব নিচ্ছেন। বারহুয়ান সে দিন ছিলেন বার্সেলোনার প্রথম এগারোয় যে দিন ভ্যালেন্সিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালে প্রথমবার লা লিগায় বার্সেলোনার প্রথম দলে জায়গা পেয়েছিলেন জাভি। আর, শেষ যেবার খেলেছিলেন, বুসকেটস-পিকে-আলবারা ছিলেন তাঁর মাঠের সঙ্গী। এবার সতীর্থদের বোঝানোর পালা, মাঠের মধ্যে তো ছিলেনই, মাঠের বাইরেও তিনিই ‘বস’। কোমর বেঁধে নিতেই পারেন বুসকি-পিকে, এই পারফরম্যান্স দিয়ে অন্তত সন্তুষ্ট করা যাবে না জাভিকে। বার্সেলোনার এই পাস-মাস্টারের এখন আসল কাজ, দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাস বাড়ানোর লোক খুঁজে নেওয়া, ব্যাটনটা এগিয়ে দেওয়া ঠিক ফুটবলারের পায়ে। একেবারে যেভাবে পেপ গার্দিওলা খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁকে।
জাভির এই নতুন ভূমিকায় বার্সেলোনা শুধু নয়, উল্লেখযোগ্য উত্থান হতে পারে স্পেনেরও। হাতে পাবেন পেদ্রি-গাভি এবং আনসু ফাতির মতো তরুণদের। বয়স খুবই কম, এখনই সাড়া জাগিয়েছেন এই তিনজন। ওঁদের দরকার পরিচর্যা। আরও সুবিধা, স্পেনের দায়িত্বে এখন লুইস এনরিকে। তিনিও ছিলেন জাভির লা লিগা অভিষেকের দিন, পরে বার্সেলোনাতেও কোচের দায়িত্বে। নেশনস লিগই বুঝিয়েছে, তরুণদের নিয়ে কাজ করতে কতটা আগ্রহী এনরিকে। সেই নিউক্লিয়াসটাও তৈরি করে দিতে পারবেন জাভি, বার্সেলোনায়। ঠিক যেমনভাবে তাঁদের ২০০৮-২০১২ বিশ্ব এবং ইউরোপজয়ী স্পেনের নিউক্লিয়াস তৈরি হয়েছিল গার্দিওলার হাতে।
শুধু, বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ যদি আরও আগে সচেতন হয়ে রাজি করিয়ে ফেলতে পারত, কে বলতে পারে, ঘরে ফিরে সেরা বন্ধু মেসিকেও পেয়ে যেতেই পারতেন জাভি!