ডিয়েগো সিমিওনির কাছেও মেসি দূর আকাশের তারা
উৎপলশুভ্রডটকম
১৪ অক্টোবর ২০২১
বার্সেলোনা যখন আর লিওনেল মেসিকে রাখতে পারছিল না, তখন হাত বাড়িয়েছিলেন ডিয়েগো সিমিওনি। কিন্তু অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কোচ কল্পনায় মেসিকে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখলেও বাস্তবে হয়েছিলেন হতাশ। মেসিকে কোচিং করানোর স্বপ্ন তাই আর পূরণ হয়নি। মেসিকে তাই কাছ থেকে দেখার সুযোগও হয়নি সিমিওনির। অন্য আরও অনেকের মতো তাঁর কাছে মেসি রয়ে গেছেন দূর আকাশের তারাই।
ডিয়েগো সিমিওনির কাছেও লিওনেল মেসি দূর আকাশের তারা। সেই তারাকে কাছে টানতে কিছুদিন আগে একবার চেষ্টাও করতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, বার্সেলোনায় যেহেতু আর থাকছেন না, তা তাহলে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে মেসিকে আনা যায় কি না! তবে সেই ভাবনা শুরুতেই শেষ হয়ে যায়। কারণ,প্যারিস সেন্ট জার্মেই আলোর গতিতে মেসিকে সই করিয়ে ফেলে।
এ নিয়ে ডিয়েগো সিমিওনির আফসোস এই জীবনে আর যাবে না। কোচ হিসেবে মেসিকে না পাওয়ার আফসোস। সিমিওনি স্প্যানিশ লা লিগায় বরাবর মেসিকে পেয়েছেন ভীতি জাগানিয়া প্রতিপক্ষ হিসেবে। ২০১১ থেকে স্প্যানিয়ার্ড ক্লাব অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কোচ, প্রতিপক্ষ দলের ডাগআউট থেকে মেসিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। মেসিকে যতটা জানেন, তা নিয়েই কথা বলেছেন আর্জেন্টিনার সংবাদপত্র ওলের সঙ্গে। অনুমিতভাবেই সেসব কথায় মেসির প্রতি শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ।
পিএসজির হয়ে ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ানে অভিষেকের দিন ম্যাচশেষে প্রতিপক্ষ ক্লাবের খেলোয়াড়েরাও মেসির সঙ্গে ছবি তুলেছেন। গোলকিপার তো তার শিশু সন্তানকে মেসির কোলে চড়িয়ে দিয়ে ছবি বানিয়েছেন। তা এই চিত্রটা কি আর মেসি যখন স্বদেশ আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেন, তখন বদলায়? সেখানেও তো সতীর্থরা টিমমেটের চেয়ে বেশি মেসির ভক্ত।
সিমিওনি তো আর্জেন্টিনা দলের ভেতরের কথা জানেন না। যতটুকু জানেন, তার ভিত্তিতে বলছেন, ’সত্যি বলতে বাইরে থেকে বলা খুব কঠিন। আমরা যা দেখি, তা থেকে শুধু একটা মতামতই দিতে পারি। ভেতরে যা কিছু ঘটে তা হয়তো একেবারে ভিন্ন। আর সত্যি কথা হলো, তারাই (আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা) জানে আসলে কী হয় না হয়’।
কিন্তু বছরের পর বছর মেসিকে দূর থেকেও দেখেও যে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়, সেটা কেন বলবেন না সিমিওনি! ’বাইরে থেকে আমরা লিওর ব্যক্তিত্ব, তার উপস্থিতি অনেক মূর্ত হতে দেখি। সেটা সবকিছুতে। স্কালোনি (আর্জেন্টিনার কোচ) আসার পর থেকে মেসি আরো ছুটতে শুরু করেছে। এমন এক মেসিকে দেখা যাচ্ছে, যাকে যেভাবে সবাই দেখতে চায়।’
স্পেনের ক্লাব অ্যাটলেটিকোতে খেলোয়াড় হিসেবে কিংবদন্তির জায়গায় উঠে গিয়েছিলেন সিমিওনি। কোচ হিসেবে সাফল্যও ঈর্ষনীয়। বার্সোলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের মতো দুই জায়ান্টকে পেছনে ফেলে দুবার অ্যাটলেটিকোকে জিতিয়েছেন শিরোপা। কোপা দেল রে ছাড়াও জিতেছেন মহাদেশীয় ক্লাব সেরার শিরোপাও। কোচ হিসেবে সিমিওনিকে তাই কিংবদন্তি বলে ফেলতেই পারেন।
তবে মেসিকে কোচিং করানোর সুযোগ তো আর হয়নি। কোনো একদিন আর্জেন্টিনার কোচ হতেও পারেন। কিন্তু এখন ৩৪ বছর বয়সী মেসি ততদিনে আর খেলার মাঠে থাকবেন কি না, তা বলতে পারে কেবল ভবিষ্যৎই। তবু মেসি সম্পর্কে যতটা জানেন এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে খেলোয়াড় হিসেবে যা জেনেছেন, সেটাও তো পাঠকদের জন্য জানা কম পাওয়া নয়।
‘মেসিকে কোচিং করানোর সুযোগ কখনো পাইনি। তার সম্পর্কে জানিও বেশ কম। তার সঙ্গে আমার খুব কম কথা হয়েছে’.. এমন একটা বিনয়ের বাতাবরণের মধ্যে নিজেকে রেখে সিমিওনি বলেন, ‘আমার দেখা মতে সে সবসময় জিততে চায়। ও নিজেও জিততে চায়...সকল প্রত্যাশা এবং জয়ের বাসনা তার ওপর চাপিয়েও দেওয়া হয়, কারণ সে একজন বিজয়ী।'
জয়ের তীব্র বাসনাই চ্যাম্পিয়নদের অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। কঠোর পরিশ্রম আর মেধায় মেসির মতো কেউ কেউ সর্বকালের সেরাদের কাতারে পৌঁছে যায়। সিমিওনির বিশ্বাস জয়ের তীব্র বাসনাই মেসিকে অনন্য করে তুলেছে, ‘সবার আগে সে জিততে চায়। আর সেটা গেল কোপা আমরিকায় খুব ফুটে উঠেছিল।’
মেসি জানপ্রাণ দিয়ে লড়েন দেশের জন্য। তারপরও শুনতে হয়েছে, দেশের জন্য সর্বস্ব দেন না। ক্লাবের জন্য তোলা থাকে সেরাটা। এসব কথা চলেছে বছরের পর বছর। কোপা আমেরিকা, বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও শিরোপা জিততে না পারা মেসিকেও তীব্র হতাশার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। একবার তো কোপার ফাইনালে হেরে রাগে দুঃখে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। নতুন কোচ তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে না আনলে চিরটা কাল বড় শিরোপা না জেতার দুঃখের আগুনেই পুড়তে হতো। ২০২১ কোপা আমেরিকার ট্রফি সেই দুঃখ ঘুচিয়েছে।
দক্ষিণ আমেরিকার মুকুট কোপা সিমিওনিও জিতেছিলেন। তাই বোঝেন এর মূল্য কত। সিমিওনি এটাও জানেন, এই জয় মেসিকে কতটা স্বস্তি এনে দিয়েছে, ‘সন্দেহ নেই, কোপা আমেরিকা জিতে (পিঠে গাথা) ছুরিটা বের করে এনেছে ও। চ্যাম্পিয়নস্ লিগসহ কত কিছুই তো জিতেছে। ব্যালন ডি’অরও তাঁর হয়েছে। কিন্তু জিততে পারছিল না আর্জেন্টিনার হয়ে!’
জীবন এমনই। কাউকে সব দিয়ে দেয়। কারও জন্য তোলা থাকে। অনেক সাধনার পর যার দেখা মেলে। মেসির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই ঘটেছে বলে বিশ্বাস সিমিওনির, ‘এটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু জীবন আসলে পরের সময়ে দেওয়ার জন্য কিছু তুলে রাখে। এটা এভাবেই আমাদের মেনে নিতে হয়। তার সবচেয়ে বেশি আমার যেটা মনে ধরে তা হলো, ও কখনো হাল ছেড়ে দেয় না। ও দুনিয়ার ওপর রাগ করে না। বলে না, আমি আর পারছি না, আমি সব ছেড়েছুড়ে দিচ্ছি। সে লড়ে। লড়তে থাকে। লড়তে থাকে। শেষ অব্দি এটাই জীবন। টোকা দাও, টোকা দাও, টোকা দিতে থাকো। একসময় সেটা ভেঙে পড়বেই।’
মেসিকে কখনো কোচিং করাতে না পারার প্রসঙ্গট এসেছে এরপরই। সিমিওনি গোপন একটা কথা জানিয়েছেন যার উত্তরে, ‘একটা গোপন কথা বলি আপনাদের। মেসিকে নিয়ে যখন অত কিছু হচ্ছিল বার্সেলোনাতে (মেসির বার্সা ছাড়ার ব্যাপারটা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হয়ে যাওয়া), আমরা সুয়ারেজকে বললাম কিছু একটা করার জন্য। আমি লিওকে ফোন দিইনি। কিন্তু আমি সুয়ারেজকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম মেসির ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। আমি জানতে চাইছিলাম, মেসি কী ভাবছে। আমাদের কি আদৌ সামান্যতম সুযোগ আছে কি না ওকে দলে পাওয়ার?’
তারপর কী হলো? ‘আমাদের ওই চেষ্টা তিন ঘণ্টা স্থায়ী ছিল।’ কারণ দৃশ্যপটে দ্রুত পিএসজি ঢুকে পড়ে।
একই দেশের মানুষ, একই লিগে বছরের বছর ধরে ছিলেন দুজন। তারপরও সেভাবে মেসিকে চেনার সুযোগ হয়নি সিমিওনির, ‘ঘটনা হলো, তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ আমাদের মেলেনি। সবসময় সে বার্সেলোনাকে নিয়ে ছিল। আমরা ছিলাম অ্যাটলেটিকো নিয়ে। আর সে যখন জাতীয় দলে, তখন তো আর আমি ছিলাম না।’