তবে তো মিলান মানে `মালদিনি এবং দশজন`
রিজওয়ান রেহমান সাদিদ
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
পিতা-পিতামহ যে জার্সি গায়ে চাপিয়ে হয়েছিলেন কিংবদন্তি, দানিয়েল মালদিনি সেই এসি মিলানের হয়ে প্রথম গোল করলেন গতকাল, মানে ২৫ সেপ্টেম্বর। ফুটবলের তিন প্রজন্মের অবিশ্বাস্য এক গল্প লেখা হচ্ছে মিলানে।
সিজারে মালদিনি মনে মনে কি এই ছবিটাই এঁকেছিলেন?
সিজারে মালদিনির সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে নিশ্চিত। পরিচয় না থাকলেও নাম থেকেই অনুমান করে নেওয়া যায় অনেকটা; আর ফুটবলের অল্প-বিস্তর খবরাখবর রাখলে গত দুদিনে আপনি জেনে গেছেন, সম্পর্কে ইনি পাওলো মালদিনির বাবা।
এই খবরটুকু জানা থাকলে হঠাৎ করে দুজনের নাম নিয়ে পড়ার কারণটাও নিশ্চয়ই জানেন। সিজারের নাতি (সম্পর্কে যিনি আবার পাওলোর পুত্র) দানিয়েল মালদিনি ক্লাব ফুটবলের সিনিয়র পর্যায়ে নিজের প্রথম গোলের দেখা পেয়েছেন গতকালই (২৫ সেপ্টেম্বর)। অন্তর্জালের দুনিয়া এরপর উপচে পড়ল তাঁকে অভিনন্দনের জোয়ারে সিক্ত করতে। দানিয়েল যে গোলটা করেছেন এসি মিলানের জার্সিতে, যে জার্সিতে এর আগেই কিংবদন্তি হয়ে গেছেন তাঁর পিতা আর পিতামহ।
সিজারে মালদিনির গল্পটাই আগে সারা যাক। নাবিক বাবা ঘুরে বেড়াতেন দেশে দেশে, মা মারিয়াকে নিয়ে সিজার রয়ে গিয়েছিলেন জন্মশহরেই। সেই শহরেরই ত্রিয়েস্তিনা ক্যালসিও ১৯১৮ ক্লাবে শুরু ফুটবল ক্যারিয়ারের। বর্তমান সিরি সি-তে খেলা দলটার তখন বেশ ভালোই দাপট। ওই ক্লাব থেকেই ১৯৫৪ মৌসুমে সিজারে মালদিনিকে দলে টেনেছিল এসি মিলান। শুরুতে রাইট ব্যাক পজিশনে খেললেও পরে সরে এসেছিলেন সুইপার পজিশনে। নিজেকে কিংবদন্তিদের কাতারে নিয়ে গিয়েছিলেন ওই পজিশনে খেলেই।
নিলস লিডহোম, হুয়ান শিয়াফিনো…মিলানের ওই দলটায় বিখ্যাত খেলোয়াড় ছিলেন অনেকই। এই দলকে নেতৃত্ব দিয়েই ১৯৬৩ সালে মিলানকে প্রথম ইউরোপিয়ান কাপের স্বাদ দিয়েছিলেন তিনি, জিতেছিলেন চারটা সিরি আ'র শিরোপাও। ১২ বছর মিলানে কাটিয়ে ১৯৬৬ সালে যখন তোরিনোতে পাড়ি জমালেন, এসি মিলানের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৪১২ ম্যাচ খেলার রেকর্ডটা গড়া হয়ে গেছে ততদিনে।
মিলানের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়দের তালিকায় সিজারে মালদিনি এখন অবশ্য দশ নম্বরে। রেকর্ডটা হারিয়ে আক্ষেপের বদলে সিজারের গর্বই হয় বোধ হয়। মাঝে যতই ফ্র্যাঙ্কো বারেসি, জেনারো গাত্তুসো, মাউরো তাসোত্তিরা ঢুকে পড়ুন, পাওলো মালদিনির সৌজন্যে মিলানের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ফুটবলারের রেকর্ডটা তো এখনো মালদিনি পরিবারেরই অধিকারে আছে!
পাওলো মালদিনির সঙ্গে এসি মিলানের সম্পর্ক নিয়ে বলতে গেলে সেই বহুল ব্যবহৃত উপমাতেই আশ্রয় খুঁজতে হবে, 'বেটার লাভস্টোরি দ্যান টোয়াইলাইট'। সেই তো যুব দলে ঝলক দেখিয়ে শুরু, তখনকার মিলান কোচ নিলস লিডহোমের নজর কেড়ে উদিনেসের বিপক্ষে অভিষেক মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তাঁর প্রতিভার স্বপক্ষে প্রমাণ মেলে বোধ হয় এই তথ্যেও, মিলানের হয়ে এর চেয়ে কম বয়সে অভিষেক হয়নি কারও।
কৈশোরের ওই প্রতিভার ঝলক যে মিথ্যে মরীচিকা ছিল না, পরের ২৫ বছরে তার প্রমাণ দিয়েছেন অগুনতিবার। এবং প্রতিবার যে দলের নামটা এসি মিলান, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
বাবার মতোই রাইট ব্যাক পজিশনে শুরু করলেও বাঁ পায়ে দক্ষতার কারণে পরে সরে গিয়েছিলেন লেফট ব্যাক পজিশনে। বাবাকে ভুলিয়ে পাওলো মালদিনিই যে 'মালদিনি' হয়ে উঠলেন, সেটাও এই ভূমিকাতে খেলেই। ২৫ বছরের ক্লাব ক্যারিয়ারে শিরোপাও জিতেছেন ২৫টি; এর মধ্যে সাতটা সিরি আ যেমন আছে, আছে এসি মিলানের জেতা সাতটা উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের পাঁচটাই।
ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিটাও কম ভারি নাকি! ক্লাব রেকর্ড ৯০২টা ম্যাচ খেলেছেন, সিরি আ-তে তাঁর চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন কেবল জিয়ানলুইজি বুফন। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে ইকার ক্যাসিয়াস ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর তৃতীয় সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ডটা তাঁর, সবচেয়ে বেশি ৮টা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলার রেকর্ডগা ভাগাভাগি করছেন ফ্রান্সিসকো জেন্তোর সঙ্গে। বাবা সিজারেও এসি মিলানের হয়ে ৩ নম্বর জার্সিই পরতেন, তবে এসি মিলান যে ৩ নম্বর জার্সিটাকে অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে চিরতরে, সেটা পাওলো মালদিনির কারণেই।
এসি মিলানের সঙ্গে যে পাওলো মালদিনির সম্পর্কটা ফুরোয়নি এখনো। টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে মিলানের ক্লাবটার হৃতযৌবন পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব নিয়েছেন ২০১৯ সালে। মালদিনি পরিবারের সঙ্গে মিলানের সম্পর্কটা আরও শক্তপোক্ত করার দায়িত্ব অবশ্য তাঁর একার হাতে নেই এখন, সেই ব্যাটনটা এখন উঠেছে দানিয়েল মালদিনির হাতে। বাবার মতোই এসি মিলানের একাডেমি থেকে উঠে এসেছেন, হেল্লাস ভেরোনার বিপক্ষে মিলানের ১-১ গোলে ড্রয়ের ম্যাচে সিনিয়র দলের হয়ে অভিষেক ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। দশম ম্যাচে এসে পেয়ে গেলেন প্রথম গোলও।
গোলসংখ্যার হিসাবে পিতা-পিতামহকে ছাড়িয়ে যাওয়াটা অবশ্য ব্যাপার মনে হচ্ছে না কোনো। নিজের প্রথম ক্লাব ত্রিয়েস্তিনা ক্যালসিওর বিপক্ষে গোল করে খাতা খোলা সিজারে এরপর গোল করেছেন আর মাত্র দুটি। পাওলো মালদিনির ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ২৯! শুরুটা ডিফেন্ডার হিসাবে করলেও যুব দলের কোচের পরামর্শে উঠে এসেছিলেন আক্রমণভাগে। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেই খেলছেন এখন। দানিয়েল যে তাঁর পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে যাবেন, এ নিয়ে বাজি ধরতে কেউ আগ্রহী হবেন বলে মনে হয় না।
দানিয়েল নিশ্চয়ই জানেন, শুধু গোলসংখ্যায় ছাড়িয়ে গেলেই অবশ্য মিলান সমর্থকদের তুষ্ট করা যাবে না। মালদিনি পরিবারের কাছে তো তাদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা!