এলোমেলো মেসি-কথন
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
৩১ আগস্ট ২০২১
তিনি মাঠে এলেন, ধারাভাষ্যকার হয়ে গেলেন মেসি-সমর্থক। তাঁর কণ্ঠে বেজে উঠল বন্দনাগান, ছ’বারের বর্ষসেরার জন্য। তিনি বল ধরছেন, পাস দিচ্ছেন, কাটাচ্ছেন, কাটাতে চেয়ে পারছেন না, বল পায়ে লেগে থাকছে, কখনো বেরিয়েও যাচ্ছে, বিপক্ষ ডিফেন্ডার পায়ের সঙ্গে হাতও চালাচ্ছেন যা কানে লেগে যাওয়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ নিজের কানের লতিতেই হাত বোলাচ্ছিলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক – ক্যামেরাও ছাড়তে পারল না তাঁকে।
- অ্যাঁ?
- আরে, অ্যাঁ নয়, হ্যাঁ। আমাকে ফরাসি ভাষাটা একটু শেখা না, প্লিজ।
- বুঝলাম, মেসি এখন পারি-তে, তোর উৎসাহের আসল কারণ। তবে, ওই ‘অ্যাঁ’-টা জরুরি। ফরাসি শব্দের উচ্চারণ একটু নয়, বেশ খটমটে। আর বহু বানান বাংলায় লিখতে ওই স্বরে অ-য় য-ফলার সঙ্গে মাথার ওপর চন্দ্রবিন্দুটা মাস্ট। আপাতত এটুকু মনে রাখ, পরে ভেবে দেখছি। ভাগ্যিস মেসি পাড়ি দিল পারি-তে, তাই ফোনটা করলি, আপাতত এটাই শান্তি!
এই কথোপকথন সপ্তাহ তিনেক আগের। সদ্য পারি স্যাঁ জারম্যাঁ-তে সই করেছেন লিওনেল মেসি। দীর্ঘকালের বাড়ি বার্সেলোনা ছেড়ে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ‘ঘর’-এ ফিরতে তখনও দিন কুড়ি বাকি। একজন ঘরছাড়া তো আর একজনের ঘরে ফেরা। যদিও মাদেইরার ক্রিস্টিয়ানোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে প্রত্যাবর্তনকে কেন ‘ঘরে ফেরা’ বলা হচ্ছে, বুঝিনি। বুদ্ধি আমার চিরকালই কম, গোড়ায় ধোঁয়া দিলে কিছু-কিছু বেরোয় কখনও সখনও, বেশিরভাগ সময়ই অ-জ্ঞান!
যাই হোক, ফেরা যাক ফরাসি ভাষা শিক্ষাপ্রসঙ্গে। দীর্ঘদিনের বন্ধুর সঙ্গে ফোনালাপের শুরুটা লিখেছি। সে-বন্ধু কলকাতার একটি স্কুলে ইংরেজির মাস্টারমশায়। ফরাসি ভাষা শিখেছে শুধু নয়, এখন শেখায়ও। ফরাসি সাহিত্য ফরাসি ভাষাতেই পড়ে এবং বাংলায় অনুবাদ করে। হাতের কাছে এমন বন্ধু থাকলে যা করা উচিত, আমিও করেছিলাম তাই-ই। পড়াশোনা শুরু হয়নি এখনও। তবে ওই যাকে সূত্রপাত বলে, ফরাসি লিগের সর্বোচ্চ বিভাগের কুড়িটি ক্লাবের নামের বাংলা বানান ঠিক কী হওয়া উচিত ফরাসি উচ্চারণবিধিতে, লিখে পাঠিয়ে মুখস্থ এবং কীবোর্ডস্থ করার বিধান পাওয়া গিয়েছে। আমার ফরাসি ভাষাশিক্ষার লেসন নাম্বার ওয়ান!
ফুটবল আসলে এমনই। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে বিস্ময় নিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ছবিতে গুপী গাইন যেমন গেয়ে বলেছিলেন, ‘দুনিয়ায় কত আছে দেখবার/ কত কী জানার কত কী শেখার’, বাঘা বাইন রূপী রবি ঘোষ তখন ঢোল বাজিয়ে বোল তোলেন, ‘সবই তো বাকি/ কিছুই দেখা হয় নাই’, আমাদের অবস্থা তেমন। কিছুই জানিনি শিখিনি। ফুটবলের কারণে একটু ভূগোল-ইতিহাস পড়ার চেষ্টা, সে-দেশের ভাষা সম্পর্কে পল্লবগ্রাহী হওয়ার ইচ্ছে, দেশটাকে, সেই দেশের শহরগুলোকে, মানুষজনকে জানা-বোঝার প্রয়াস। আরও একবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’-র পাতা উল্টে নিজেকে বিরাট বিজ্ঞ প্রমাণের চেষ্টা। আসলে যা অজ্ঞতা ঢাকতে নেম-ড্রপিং!
জীবনের যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে এমন ঐশ্বর্য পথের ধারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখার জন্যই-- মনে হয়-- খেলার জগতে এতটা ঐশ্বর্যবান হয়ে উঠেছে ফুটবল। নিজেকে নিরন্তর পরখ করা, নিজের উন্নতিসাধনে মগ্ন থাকার শিক্ষাও দিয়ে যায় মেসিদের এই খেলাটাই। বিশ্ব বৈচিত্র্যময়, ছোটবেলায় পড়ার বইতে পড়েছিলাম, কিন্তু অর্থ বুঝিনি, মুখস্থ করেছিলাম স্রেফ। এখন এই গত বছর তিরিশেক ফুটবল-ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গে খেলাটাই একসময় পড়ার বই-এর পাতার বাইরে এসে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে এবং বুঝিয়ে গিয়েছে তখনকার সেই সব অবোধ্য ‘টেক্সট’-গুলো। পুরোটা না হলেও খানিকটা তো বটেই।
আর এই সবই ওই মেসি নামক এক চির-আকর্ষণের কারণে! তাঁর খেলা সরাসরি দেখার অমোঘ আকর্ষণে কখনো বাংলাদেশ, কখনো ব্রাজিল-রাশিয়া। গত বছর সতেরো টেলিভিশন-ফেসবুক-মোবাইলে লাইভ স্ট্রিমিংয়ে যাঁর খেলার এক মুহূর্তও হারানোর প্রশ্নই ওঠে না। প্রাথমিক বছর দুয়েক প্রধান আকর্ষণ ছিল রোনালদিনহো। তাঁকে দেখতে গিয়েই চিনে নেওয়া লম্বা চুলের আর্জেন্টাইনকে। তারপর কখন যে তিনিই সব গাছ ছাড়িয়ে মাথা তুললেন আকাশে, মনে রাখার দায় ছিল না আর!
প্রশ্ন তুলতেই পারেন, তা হলে জিনেদিন জিদানকে খেলতে দেখে, এমনকি মিশেল প্লাতিনিকে খেলতে দেখেও ফরাসি শেখার ইচ্ছে প্রকাশ কেন করিনি? সঙ্গত প্রশ্ন। প্লাতিনির খেলা এভাবে রোজ দেখা হয়নি, তখন সেই বন্দোবস্ত ছিল না। সিরি আ অর্থাৎ ইতালির সেরা লিগ নিয়ে যেটুকু প্রাথমিক জ্ঞান, শুরু হয়েছিল সেই আটের দশকের শুরুর দিকে। পরে জিদানও সিরি আ থেকে লা লিগায়, আর স্পেন সম্পর্কিত একটু-আধটু তথ্যভাণ্ডার ভারী। এবার মেসি গিয়েছেন ফ্রান্স-এ, থুড়ি, ‘ফ্রাঁসে’। তাই (ফরাসির) ধান ভানতে শিবের (মেসির) গীত!
সেই মেসি যখন কুড়ি বছরের ‘ঘর’ বার্সেলোনা ছেড়ে 'বেঘর' হতে বাধ্য হন, অন্য উৎসাহ তৈরি হয় দেখার, কেমন ভাবে মেলে ধরবেন নিজেকে। সাতাশিতে জন্মে দু’হাজার সালেই বার্সেলোনা। বার-তের বছর ছিলেন দেশে। পরের কুড়ি বছরে নিজেকে যেভাবে গড়েপিটে নিয়েছিলেন, প্রকৃত অর্থে ঘর বা আজন্মলালিত শব্দের সার্থক ব্যবহার এক্ষেত্রে মানানসই। তাই তো নতুন দেশে এলেও বিপক্ষের মাঠে টিকিটের চাহিদা বেড়ে যায় তাঁর অভিষেকলগ্ন চাক্ষুষ করার দুর্নিবার ইচ্ছের কারণে। ‘মেসি যে দিন প্রথম খেলেছিল লিগ ওয়ানে, স্তাদ অগুস্ত দ্যলনে, আমি ছিলাম গ্যালারিতে’, আজ থেকে দশ-কুড়ি-তিরিশ বছর যতজন বলবেন কথাগুলো, সংখ্যাটা বিক্রিত টিকিটের ওই কুড়ি হাজর পাঁচ শ পঁচিশের (২০,৫২৫) দশগুণে না পৌঁছলে আর মেসি কেন!
দেশের লিগে সেই ফুটবলার বিপক্ষের জার্সি গায়ে মাঠে নামছেন, দর্শকরা স্বাগত জানাচ্ছেন --- এমনও আবার হয় নাকি! হলো, স্তাদ অগুস্ত দ্যলন জুড়ে শোরগোল মাত্রাছাড়া। ম্যাচের ৬৫ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে তাঁর মাঠে প্রবেশ। কার জায়গায়? নেইমার! যাঁর পিঠে জার্সি নম্বর দশ এবং যিনি অবশ্যই পারি স্যাঁ জারম্যাঁ-তে গত বছর চারেক ধরে তা দিয়েছেন ইউরোপ জয়ের নতুন স্বপ্নে। এমনকি এডিনসন কাভানির মতো তারকাকেও ছেড়ে দিয়েছে পিএসজি, তিনি ছিলেন বলেই। তবুও গ্যালারি এবং টেলিভিশন/মোবাইলে সরাসরি খেলা দেখতে-বসা মানুষও আনন্দে উদ্বেল।
তিনি মাঠে এলেন, ধারাভাষ্যকার হয়ে গেলেন মেসি-সমর্থক। তাঁর কণ্ঠে বেজে উঠল বন্দনাগান, ছ’বারের বর্ষসেরার জন্য। তিনি বল ধরছেন, পাস দিচ্ছেন, কাটাচ্ছেন, কাটাতে চেয়ে পারছেন না, বল পায়ে লেগে থাকছে, কখনো বেরিয়েও যাচ্ছে, বিপক্ষ ডিফেন্ডার পায়ের সঙ্গে হাতও চালাচ্ছেন যা কানে লেগে যাওয়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ নিজের কানের লতিতেই হাত বোলাচ্ছিলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক – ক্যামেরাও ছাড়তে পারল না তাঁকে। ক্যামেরায় চোখ রেখেছিলেন যাঁরা, জানতেন, ম্যাচের বাকি ওই ২৪-২৫ মিনিট এবং সংযুক্ত সময়টুকুতে তাঁদের কাজের তালিকায় ‘ফোকাস’-এর অগ্রাধিকার কোথায়! জানত বোধহয় জড় লেন্সটাও!
শঁপ্যাঁ-র রাজধানী শহর হিসাবে পরিচিত র্যাঁস--- এই তথ্য কি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় না বসলে আপনি জানতেন? কিংবা, এই র্যাঁস শহরেই ফ্রান্সের রাজাদের রাজ্যাভিষেক হত? ফরাসিরা রাজশাসনে ছিলেন দীর্ঘদিন। ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান কাগজ লিখেছে, হাজার বছরের বেশি সময় ধরে, ৮১৬ সাল থেকে ১৮২৫ পর্যন্ত, ‘Reims was the city where France consecrated its kings’। ‘কনসেক্রেটেড’, কী গম্ভীর, রাজসিক শব্দ! রাজপ্রতিষ্ঠার পবিত্রতা যেন শব্দেই মালুম, আভিজাত্য ঠিকরে বেরোয়। কে বলেছে শব্দের প্রাণ নেই? রাজার অভিষেকের সঙ্গে লাগসই এমন একটা শব্দ লিখে ফেলে লেখকের মনটা যেমন খুশি-খুশি হয়ে ওঠে, পড়ে ফেললে পাঠকেরও দিলখুশ।
মেসিরও রাজ্যাভিষেক দেখল সেই একই শহর। র্যাঁস, আগে ইংরেজি উচ্চারণ অনুসারে যাকে রেইমস বা রিমস বলে জানতাম, ফুটবলের আর এক ফরাসি সম্রাটের রাজ্য ছিল। তিনি রেমদঁ কোপা। প্লাতিনি-জিদানের আগে ফ্রান্সে ফুটবলের একচ্ছত্র সম্রাট। প্রথম ইউরোপীয় কাপ (এখন যা চ্যাম্পিয়নস লিগ) জেতার সময় কোপার র্যাঁস-কে হারাতে গলদঘর্ম আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর রিয়াল মাদ্রিদ। প্রথম দশ মিনিটে দুটি গোল করে এগিয়েছিল র্যাঁস-ই। ডি স্টেফানোরা শেষে ৪-৩ জেতেন এবং রিয়াল পরের তিন মৌসুমের জন্য তুলে নেয় গ্যালাকতিকো কোপাকে। তাঁর পাশে খেলতেন বলেই পেলের অভিষেকের বিশ্বকাপে তের গোলের রেকর্ড করেছিলেন ফরাসি জুস্ত ফঁতে। ১৯৫৮-র পর কত স্ট্রাইকার এলেন-গেলেন, সেই ছয় ম্যাচে ১৩ গোলের বিশ্বকাপ রেকর্ডের কাছাকাছিও যেতে পারেননি কেউ।
ফরাসি ফুটবলের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা আগ্রহী, জেনে নিতে পারেন, সেই প্রথম ইউরোপীয় ফাইনালে র্যাঁসের কোচ আলবের বাতু-র নামও। ফ্রান্সের দায়িত্ব নিয়ে ‘অ্যাটাকিং থার্ড’-এ এসে ফরাসি ফুটবলের যাবতীয় সৃজনশীলতা কার্যকরী করে তোলার যে মন্ত্রে তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন র্যাঁস, ফ্রান্স এবং তখনকার ফুটবলারদের, পরে মিশেল হিদালগোর হাতে পড়ে তা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। তাই এই র্যাঁস-তে মেসির অভিষেক মানে কোপা-বাতু-হিদালগোদেরও মনে করা, নতমস্তক। পারি-তে ঘরের মাঠে এই অভিষেক সত্যিই হয়ত এতটা রাজসিক এবং ঐতিহাসিক হতো না।
খেলার দিক দিয়ে তেমন মনে রাখার মতো মুহূর্ত হয়তো নেই মেসির ওই ২৪ যোগ ৬, মোট ৩০ মিনিটের ফুটবলে। বার দুই গতি বাড়ানোর চেষ্টা, তাঁর সঙ্গে যাঁর সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে ফুটবল-মিডিয়া বেশ চিন্তিত সেই কিলিয়ান এমবাপ্পেকে বাড়ানো গোটা তিনেক পাস, ব্যস। তিনি মাঠে নামার আগেই কাজ শেষ করে ফেলেছিলেন এমবাপ্পে, জোড়া গোলে। আর দ্বিতীয় গোলের সময় মরক্কোর আশরাফ হাকিমি মাঠের ডান দিক থেকে যে পাসটা বাড়িয়েছিলেন বাঁ দিক থেকে অলক্ষ্যে ধেয়ে আসা এমবাপ্পের জন্য, বার্সেলোনায় তেমন বেশ কিছু গোল নেইমারকে দিয়ে করিয়েছিলেন মেসি, সাক্ষী রয়েছে ফুটবল-দর্শক। হাকিমির সেই পাসে আগমার্কা মেসি-ছাপ বললেই ঠিক।
তিরিশ মিনিটের কাব্যে আপাতত এখানেই দাঁড়ি। ১২ সেপ্টেম্বর ক্লেরমঁ ফুত-এর বিরুদ্ধে ঘরের মাঠ পারি শহরে খেলার দিন যা নিয়ে আবারও চর্চা। ১৫ সেপ্টেম্বর ক্লাব ব্রুগের বিরুদ্ধে ইউরোপে নতুন অভিযান শুরু মেসির, সব ঠিকঠাক থাকলে ২৮ সেপ্টেম্বর ঘরের মাঠে পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির বিরুদ্ধে খেলার দিন যা নিয়ে জল্পনা উঠবে তুঙ্গে।
তত দিনে মেসি নিজেকে মানিয়ে নেবেন ফ্রান্সে নিশ্চিত। এমবাপ্পের থাকা বা না থাকা নিয়েও কথা উঠবে না আর। হয়তো, দেখা যাবে এম-এন-এম একসঙ্গে। কিংবা নয়। কিন্তু শুরু থেকে মাঠে থাকবে সেই বাঁ পা, যাঁর কাজ দেখার জন্য বিশ্বজুড়ে আকুতি একই রকম থাকবে ফুটবল-দর্শকের, নিশ্চিত।