উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
যে ইনিংসে শোয়েব মালিকের বয়স কমেছে ১৫ বছর
ইফতেখার নিলয়
৮ নভেম্বর ২০২১
বয়স যে নিছকই একটা সংখ্যা, এই বিশ্বকাপে কী দারুণভাবেই না তা প্রমাণ করে যাচ্ছেন শোয়েব মালিক। সর্বশেষ প্রমাণ স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০০ স্ট্রাইক রেটে খেলা ইনিংসটি, যা তাঁর বয়সকে যেন এক ঝটকায় কমিয়ে এনেছে পনের বছর!
শেষ ওভারে ক্রিস গ্রিভসকে কী অনায়াসেই না সীমানা পার করলেন! স্লোয়ার বলে ব্যাট চালাতে গেলে টাইমিংয়ে গড়বড় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। শোয়েব মালিকের কোনো সমস্যা হয়নি বলেই তো তিনি ব্যতিক্রম। আর বদলে যাওয়া ক্রিকেট সংস্কৃতিতে তো ব্যতিক্রমীদেরই তো বেশি কদর।
টি-টোয়েন্টিকে বলা হয় তারুণ্যের খেলা। পড়ন্ত বেলার শোয়েব মালিক সেখানে পাত্তা পাবেন না, এমন ভাবা যে কতটা অযৌক্তিক ছিল, তা এরই মধ্যে প্রমাণ করেছেন এই বিশ্বকাপে। অভিজ্ঞতার জোরে দলে সুযোগ পেলে তাঁর প্রতিদান শোয়েব মালিকের মতো এভাবেই দিতে হয়।
যিনি পারেন, তিনি সব বয়সেই পারেন। বয়স কোনো বাধাই হতে পারে না। ৩৯ বছর বয়সে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০০ স্ট্রাইকরেটে খেলা ইনিংসটি যেমন শোয়েব মালিকের বয়সকে এক ধাক্কায় 'কমিয়ে' এনেছে অনেকটাই।
যতটা সহজ খেলতে দেখা গিয়েছে তাঁকে, ততটা সহজ ছিল না বিশ্বকাপ দলে তাঁর জায়গা পাওয়ার বিষয়টা।
র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষস্থান দখল করেও দল ঘোষণার পর বাবর বিশ্বকাপ দলে শোয়েব মালিককে চেয়েছিলেন নির্ভার থাকতে। বাবরের এমন বক্তব্য পছন্দ না হওয়ায় তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে খেলায় মনযোগী হতে বলেন পিসিবি চেয়ারম্যান রমিজ রাজা। অভিজ্ঞতার মূল্য বাবর বুঝলেও প্রথমে তা বুঝে উঠতে পারেনি টিম ম্যানেজমেন্ট।
বাবরের আশা শেষমেশ পূরণ হয়ে যায় শোয়েব মাকসুদের ইনজুরিতে। কারও ইনজুরিতে উল্লাস করাটা অরুচিকর মনে হতেই পারে। তবে আড়ালে-আবডালে বাবর ও পাকিস্তানের ভক্ত-সমর্থকেরা মাকসুদের ইনজুরিটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কি না, সেই প্রশ্নও তো এখন উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ১২১ আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে নামা শেষ। এখন শোয়েব মালিকের নাম উচ্চারণ করলে চোখে ভেসে ওঠে শারজায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০০ স্ট্রাইকরেটে ১৮ বলে ৫৪ রানের ঝোড়ো ইনিংসের টাটকা স্মৃতি। যে ইনিংস শোয়েবের বয়স যেন ১৫ বছর কমিয়ে এনেছে। এখন তাঁকে দেখে ২৪-২৫ বছরের যুবক বলে মেনে নিতেই মন বেশি সায় দিচ্ছে।
নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেয়নি টি-টোয়েন্টি। তবে নব্বইয়ের শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মাঠে জন্ম নিয়েছিলেন শোয়েব মালিক নামের লিকলিকে এক তরুণ। কত শত বাজিই না তাঁকে ঘিরে ধরা হলো। বিবর্তনও কত রকম! শুধুমাত্র অফ স্পিনার হিসেবে আবির্ভূত হওয়া একজন ক্রিকেটার পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান থেকে টি-টোয়েন্টির পাওয়ার হিটার।
বাইশ বছরের ক্যারিয়ারে কত রূপেই না আবির্ভাব শোয়েব মালিকের। টি-টোয়েন্টির যুগে অভিষেক না হওয়া মালিক কিভাবে যে বনে গেলেন এই ফরম্যাটের একজন তারকা, তা এক বিরাট বিস্ময়। এই বিশ্বকাপে প্রতিনিয়তই যা উপহার দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তিন ইনিংসে মোট ৯৯ রানের ৬৪ রান করেছেন বাউন্ডারিতে। চার মেরেছেন চারটি আর ছয় এর দ্বিগুণ। তিন ইনিংসের প্রতিটা রান বড় ভূমিকা রেখেছে পাকিস্তানের জয়ে।
স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ডিপ এক্সট্রা কাভার, লং অন, মিড উইকেট, কাউ কর্নারে হাঁকানো ছয়গুলোর কথা মনে করে দেখুন। শোয়েবের ব্যাট সুইংয়ে ছিল না বয়সের ভারে নুয়ে পড়ার ছবি। রানিং বিটুইন দ্য উইকেটেও দারুণ সাবলীল। দলের সবাই তাঁর জুনিয়র হলেও কারও সঙ্গে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটেই কোনো সমস্যা হচ্ছে না তাঁর। বাবর ও আসিফ কয়েকবার দুই রান নিয়েছেন। শেষ ৫ ওভারে অবশ্য বেশি দৌড়াতে হয়নি। যখন পাকিস্তানের ইনিংসের ৭৭ রানের ৫৪ রানই এসেছে মালিকের ব্যাট থেকে।
শোয়েবের ব্যাট যেন আলাদীনের চেরাগ, যে চেরাগে ঘষা দিলে মুহূর্তেই চার-ছয় বেরিয়ে আসে। আবার রূপকথার চাদরের সাথেও তুলনা চলে, পাকিস্তান সমর্থকরা তো তার ব্যাটে ভর করেই স্বপ্নে বিচরণ করছে। ঊনচল্লিশ বছর বয়সেও শোয়েব মালিক দেখা দিচ্ছেন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে।
রপকথার আলোচনা ছেড়ে বাস্তবে ফিরলে চোখে ভাসে মাঠের ফিল্ডিংয়ে তার দূরন্তপনা। একজন স্লো ফিল্ডারকে নিয়ে বিপাকে পড়েন অধিনায়ক। কোন পজিশনে তাকে লুকাবেন সারাক্ষণ এই চিন্তায় মগ্ন থাকতে হয়। ৩৯ বছর বয়সী মালিককে নিয়ে সেই দুশ্চিন্তার ছিটেফোঁটাও নেই বাবরের।
বয়সের কথা উঠে আসলে বাদ যান না মোহাম্মদ হাফিজও। জীবনের বয়সে শোয়েব থেকে দুই বছর এগিয়ে থাকলেও ক্যারিয়ারের বয়সে পিছিয়ে হাফিজ। তবে দুই 'বুড়ো' সদস্যে ভর করেই তো শেষ ম্যাচ জিতে অপরাজিত থেকে সেমির ম্যাচে মাঠে নামবে পাকিস্তান।
শোয়েব মালিকের ইনিংসটা বর্ণনা করতে নিজের ক্রিকেটীয় নিকনেমকে টেনে এনে টুইট করেছেন শহীদ আফ্রিদি, 'শোয়েব মালিকের ইনিংসটা ছিল বুমবুম।' নিজের দল বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়লেও শোয়েব মালিকের ইনিংসকে 'ক্লাসি' বলে আখ্যা দিতে কার্পণ্য করেননি হরভজন সিং। শোয়েব আখতারের মতে শোয়েব মালিক '৪০ বছর বয়সী তরুণ।'
কোয়ালিফায়ারে ওমানের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের পর সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, 'দিন যত যাচ্ছে, অভিজ্ঞরাই এই ফরম্যাটে ভালো করছে।' সাকিবের কথার সত্যতা প্রমাণ করতে মাঠে নামেননি মালিক। তবে ১৮ বলে অপরাজিত ৫৪ রানের ইনিংসটিতে তো ঠিকই সাকিবের কথার প্রমাণ মিলেছে।
বয়স কোনো বাধাই নয়, যদি একজনের পরিশ্রম ও নিবেদনের মাত্রা যথাযথ থাকে। শোয়েব মালিক ঠিক তাই! নিজের ক্যারিয়ার বাইশ বছর টেনে নিয়ে এসে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন বাকি সবার জন্য।