আসল `স্বাগতিক` ভারতের বদলে পাকিস্তান, ফেবারিটও তা-ই
উৎপল শুভ্র
২৭ অক্টোবর ২০২১
মাত্র পাঁচ দিনেই ওলটপালট এই বিশ্বকাপে। পাকিস্তান যেখানে সেমিফাইনাল এক রকম নিশ্চিতই করে ফেলেছে, দুবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেখানে দুই ম্যাচেই হেরে খাদের কিনারায়। বিশ্বকাপটা তো দেখি জমেই গেছে!
কাগজে-কলমে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বাগতিক ভারত। কাগজে-কলমেই। বাস্তবে তো ‘স্বাগতিক’ পাকিস্তান। এই শারজা-দুবাই-আবুধাবিকে প্রায় এক দশক ধরেই যারা ‘ঘরবাড়ি’ বানিয়ে ফেলেছে।
কাগজে-কলমে আর বাস্তবের স্বাগতিক যেমন অদল-বদল হয়ে যাচ্ছে, এই বিশ্বকাপের ফেবারিট ‘ট্যাগ’টা নিয়েও বোধ হয় তা করার সময় হয়েছে। ভারতের গা থেকে খুলে নিয়ে এখন তা পাকিস্তানের গায়ে লাগিয়ে দেওয়াটাই কি ভালো না?
বিশ্বকাপের শিরোপা-যাত্রা দুস্তর এক পথ। অনেক খানাখন্দে ভরা। কে কোথায় হোঁচট খেয়ে পপাত ধরণীতল হবে, কেউ তা বলতে পারে না। তবে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম পাঁচ দিনেই ওই ফেবারিট ব্যাপারটার মনে হয় মীমাংসা হয়ে গেছে। ছয় দলের গ্রুপে দুই ম্যাচ খেলেই একটা দলের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলার অত্যাশ্চর্য ঘটনাও তো চোখের সামনেই ঘটতে দেখলাম। নিশ্চিত-এর আগে ‘প্রায়’ শব্দটা লিখেও ডিলিট করে দিয়েছি, কারণ ওটার আসলেই কোনো প্রয়োজন নেই। বাকি তিন ম্যাচে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড ও নামিবিয়া। ক্রিকেটের অন্য নাম যতই অনিশ্চয়তা হোক, চাইলে পাকিস্তান এখনই সেমিফাইনাল নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিতে পারে।
সমস্যা অবশ্য একটা আছে। সেমিফাইনাল নিয়ে ভাবতে হলে তো প্রতিপক্ষ সম্পর্কে একটু হলেও ধারণা থাকতে হবে। যা অনুমান করা একদমই সম্ভব নয়। প্রাথমিক পর্বে গ্রুপ জিততে না পেরে বাংলাদেশই আসলে যে ঝামেলাটা বাঁধিয়েছে। সুপার টুয়েলভের একটা গ্রুপকে বানিয়ে দিয়েছে ‘গ্রুপ অব ডেথ’, যেটিতে ছয়টি দলই টেস্ট প্লেয়িং নেশন। যেখানে আরেকটা গ্রুপে আফগানিস্তানকে হিসেবে নিলেও সেমিফাইনালের দৌড়ে চারটি দল। স্যরি, ভুল বললাম। পাকিস্তান তো কার্যত সেমিফাইনালে উঠেই গেছে। নির্ভার মনে বাকি তিনটা ম্যাচ খেলতে খেলতে তারা এখন দ্বিতীয় সেমিফাইনালিস্ট হতে ভারত, নিউজিল্যান্ড আর আফগানিস্তানের কামড়াকামড়ি দেখবে।
শুরুতে অপ্রতিরোধ্য রূপে দেখা দিয়েও শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিততে না পারার অগণ্য উদাহরণ আছে ইতিহাসে। চিরকালের অননুমেয় পাকিস্তানের তাতে আরেকটি সংযোজন হওয়ার সম্ভাবনা তো বিলক্ষণ আছে। তবে মাত্র দুই ম্যাচেই এই বিশ্বকাপ পাকিস্তানকে যা দিয়েছে, তাতে তৃপ্তির একটা ঢেঁকুর তারা তুলতেই পারে। এই দুই ম্যাচের কোনোটাই তো স্বাভাবিক ম্যাচ ছিল না। প্রথমটায় প্রতিপক্ষ ভারত। যেকোনো টুর্নামেন্টে যাদের সঙ্গে খেলা থাকলে আপামর পাকিস্তানি কোরাস তোলে, ট্রফি জিতলে ভালো, না জিতলেও ক্ষতি নেই, তবে ভারতকে কিন্তু হারানো চাই। বিশ্বকাপে যে এই চাওয়া এর আগে কোনোদিনই পূরণ হয়নি, কারই বা তা অজানা! বিশ্বকাপ, তা ৫০ ওভারের হোক বা ২০ ওভারের, একটা জিনিস তো ধ্রুবই থেকেছে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচশেষে প্রতিবারই দেখা যাবে সেই একই দৃশ্য: নতমুখ পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মাঠ ছাড়া।
সেই ১৯৯২ সাল থেকে শুরু হয়ে পরের ২৯ বছরে ১২টি ম্যাচ। বিশ্বকাপ একটার জায়গায় দুইটা হয়েছে, খেলোয়াড় বদলেছে, হয়তো খেলাটাও...কিন্তু বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ওপর ভারতের আধিপত্যের গল্পে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্রমেই যা পরিণত হয়েছে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় রহস্যে। সেই রহস্য ঘোচানোর কাজটা এবার এমনই স্টাইলে হলো যে, পাকিস্তান দলেরও তাতে একটু চমকে যাওয়ার কথা।
এমনিতে নিউজিল্যান্ড হলো ক্রিকেট বিশ্বের অজাতশত্রু দল। লয়েড-রিচার্ডসের জমানায় বিশ্বের প্রায় সব মানুষের যেমন দ্বিতীয় প্রিয় দল ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এখন সেই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে নিউজিল্যান্ড। সেই নিউজিল্যান্ডই কিভাবে পাকিস্তানের ‘চরম শত্রু’ হয়ে গেল!
ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার ইতিহাস তো অনেক পুরোনো। এই দুই দলের ক্রিকেট ম্যাচ মানেই বাতাসে আগুনের ফুলকি। এই দুই দলের ক্রিকেট ম্যাচ মানেই জর্জ অরওয়েলের দেওয়া খেলার সংজ্ঞাটার সত্যি হয়ে ওঠা: ‘খেলাধুলা হলো বন্দুক ছাড়া যুদ্ধ’। কিন্তু পাকিস্তানের দ্বিতীয় ম্যাচটাও যে শুধুই একটা ক্রিকেট ম্যাচের চেয়ে অনেক বড় হয়ে উঠে প্রায় একই রূপ নিয়ে ফেলবে, দুই মাস আগেও তা কে কল্পনা করেছিল!
এমনিতে নিউজিল্যান্ড হলো ক্রিকেট বিশ্বের অজাতশত্রু দল। লয়েড-রিচার্ডসের জমানায় বিশ্বের প্রায় সব মানুষের যেমন দ্বিতীয় প্রিয় দল ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এখন সেই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে নিউজিল্যান্ড। সেই নিউজিল্যান্ডই কিভাবে পাকিস্তানের ‘চরম শত্রু’ হয়ে গেল, বিশ্বকাপে তাদের হারানোটাকে অবশ্য কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করে দিলেন খোদ পিসিবি চেয়ারম্যান, সেই কাহিনি তো মনে হয় আপনি জানেনই। গত সেপ্টেম্বরে প্রথম ম্যাচের দিন নিরাপত্তা-শঙ্কার কথা বলে সফর বাতিল করে নিউজিল্যান্ডের দেশে ফিরে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ, অপমানিত পাকিস্তান দল যেকোনো মূল্যে এই ম্যাচটা জিততে চেয়েছিল। জিতলও এবং এই জয়েও প্রতিফলিত ‘ঘরের মাঠে’ খেলার আত্মবিশ্বাস। যেখানে ২০১৬ সাল থেকে টি-টোয়েন্টিতে তারা অপরাজিত। টানা জয়ের সংখ্যাটা ১৩ ছুঁয়ে ফেলল এই ম্যাচে।
ভারতের বিপক্ষে বল হাতে নায়ক ছিলেন শাহিন শাহ আফ্রিদি, এদিন হারিস রউফ। ব্যাট হাতে সেদিন নায়ক দুই ওপেনার, এদিন ক্লোজ হয়ে যাওয়া ম্যাচটাকে জলবৎ তরলং বানিয়ে আসিফ আলী। উইকেটে তাঁর সঙ্গী চিরনবীন শোয়েব মালিক। সফল রান তাড়ায় রেকর্ড ১৮তম বারের মতো যিনি অপরাজিত। শোয়েবকে পাকিস্তান ক্রিকেটের প্রতীক বলতে পারেন দুই অর্থেই। প্রথমটি সেই ১৯৯৯ সাল থেকে খেলছেন বলে। আর দ্বিতীয়টি শেষ মুহূর্তে যেভাবে ঢুকেছেন দলে, সে কারণে। অতীতে আনপ্রেডিক্টবল চরিত্রের উদাহরণ টুর্নামেন্ট শুরুর পর দিয়েছে পাকিস্তান, এবার শুরুর আগেই ঘোষিত দলে ওলটপালট করে।
মাত্র পাঁচ দিনেই ওলটপালট এই বিশ্বকাপেও। পাকিস্তান যেখানে সেমিফাইনাল এক রকম নিশ্চিতই করে ফেলেছে, দুবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেখানে দুই ম্যাচেই হেরে খাদের কিনারায়।
বিশ্বকাপটা তো দেখি জমেই গেছে!