২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
ফের বর্ণবাদকে জাগিয়ে তুললেন ডি কক
উৎপলশুভ্রডটকম
২৬ অক্টোবর ২০২১
`ব্ল্যাক লাইভস্ ম্যাটার` আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানোটা যেখানে ক্রীড়া বিশ্বের সর্বজনগ্রাহ্য রীতিতে পরিণত হয়েছে, সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকান উইকেটকিপার কুইন্টন ডি কক দাঁড়িয়ে গেছেন এর বিপক্ষে। দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড `টেকিং দ্য নি` বাধ্যতামূলক করে দেওয়ায় নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ থেকে। ডি ককের সমালোচনা তো হচ্ছেই, সঙ্গে উঠে যাচ্ছে এই প্রশ্নও, তাঁর ক্যারিয়ার কি এখানেই শেষ?
'ব্যক্তিগত কারণে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে কুইন্টন ডি কক। ওর বদলে রিজা হেনড্রিকস খেলবে এই ম্যাচে।'
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচের আগে টেম্বা বাভুমার এই কথা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা হওয়াটা অবধারিতই ছিল। তবে গুঞ্জনে কান পাতা ছাড়াই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে, ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকার পাঠানো দুটি বিবৃতির কারণে। যার প্রথমটায় বলা হচ্ছে, ক্রিকেটারদের সবাইকে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য হাঁটু গেড়ে বসতে হবে ম্যাচের আগে। আর ডি কককে যখন পাওয়া গেল না ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে, এরপরে পাঠানো দ্বিতীয় বিবৃতিতে বলা হলো, 'হাঁটু গেড়ে বসতে না চাওয়ার যে অবস্থান ডি কক নিয়েছেন, সেটা ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকার নজরে এসেছে। টিম ম্যানেজমেন্টের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলনের সঙ্গে হাঁটু গেড়ে একাত্মতা প্রকাশের রীতি চালু হওয়ার পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররা সমর্থন জানিয়েছেন নানাভাবেই। টেম্বা বাভুমার মতো অনেকে হাঁটু গেড়ে একাত্মতা জানিয়েছেন, ডেভিড মিলার বা আনরিখ নোর্খিয়ের মতো কেউ কেউ হাঁটু না গেড়ে কেবল মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে ধরেই সমর্থন প্রকাশ করেছেন, হেনরিখ ক্লাসেন আবার সমর্থন জানিয়েছেন দাঁড়িয়ে থেকেই। তবে ডি কক এখানে ব্যতিক্রম ছিলেন সব সময়ই। তিনি সমর্থন জানাননি কোনোভাবেই।
তবে এতদিন এই আন্দোলনে সমর্থন জানানোটা ছিল ডি ককের ইচ্ছাধীন। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচের আগেই ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়ে দেয়, আন্দোলনটা যেহেতু একই লক্ষ্যে, ক্রিকেটারদের এখানে ভিন্ন ভিন্ন পথ বেছে নেওয়ার উপায় নেই। ‘দলের সদস্যরা “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” আন্দোলনে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নেওয়াতে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ধারণা তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে, আন্দোলনটা যথাযথ সমর্থন পাচ্ছে না। যে কারণে সব প্রাসঙ্গিক দিক বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস বিবেচনায় বোর্ড মনে করছে, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে একটা একতাবদ্ধ এবং ধ্রুব অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। আর সব দেশ যেমন নিয়েছে।'
দক্ষিণ আফ্রিকার বোর্ড কর্মকর্তারা মনে করেছেন, 'টেকিং দ্য নি' নীতিই এ ক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে। ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান লসন নাইডু বলেই দিয়েছেন, ‘বর্ণবাদ নিরসনে আমরা যে অবস্থান নিচ্ছি, সেটা আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ, আরও শক্তিশালী করে তোলার কাজ করবে বলেই নিচ্ছি। আমাদের দুর্বলতা বাড়াতে নয়। বৈচিত্র্য দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দিকেই খুঁজে নেওয়া যায়, তবে বর্ণবাদের বিপক্ষে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এর কোনো স্থান নেই।’
বিপত্তি বেঁধেছে সেখানেই। এর আগে হাঁটু গেড়ে সমর্থন না জানালেও আনরিখ নোর্খিয়ে কিংবা ডেভিড মিলার এদিন রীতি মেনেই সমর্থন জানিয়েছেন এই আন্দোলনের প্রতি, তবে ডি কককে টলানো যায়নি মোটেই। বিশ্বকাপের ম্যাচে থেকে নিজেকে সরিয়ে তো নিয়েছেনই, আর কখনো তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সিতে দেখা যাবে কি না, প্রশ্ন উঠে গেছে এ নিয়েই।
অনুমিতভাবেই ডি ককের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা হচ্ছে। তাঁর এই অবস্থান তো ধাক্কা হয়ে এসেছে প্রায় সর্বজনীন রূপ নেওয়া এই আন্দোলনেই। ডি কককে দোষী বানাতে চাননি, তবে ধারাভাষ্য কক্ষে বসে সাবেক জিম্বাবুইয়ান পেসার পমি মবংওয়া তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই বলে, 'এই আন্দোলনে সমর্থন না জানানোর মানে হচ্ছে দলের ভেতর অশ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারদের প্রতি সমর্থনের অভাব, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পুরো বিশ্বেই (অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি) সমর্থনের অভাব। আমার কথাগুলো রাজনৈতিক মনে হলে ক্ষমাপ্রার্থী, কিন্তু আমি তো আমার চামড়া খসিয়ে ফেলতে পারছি না।'
দেখা যাক, এমন শক্ত-শক্ত কথা শুনে ডি ককের বোধোদয় হয় কি না। হলেও অবশ্য প্রশ্ন থাকবে। দক্ষিণ আফ্রিকার অশ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটাররা কিভাবে এমন একজনকে সতীর্থ হিসেবে মেনে নেবেন, তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে যার বিন্দুবিসর্গ ভাবনাও নেই? দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস জানা থাকলে ডি ককের এই সিদ্ধান্ত আরও বড় হয়ে উঠবে সবার কাছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বর্ণবাদের চর্চা করাতে যে দেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২২ বছর নিষিদ্ধ হয়ে ছিল, সেই দেশের এক ক্রিকেটারের এমন মনোভাব যে জানিয়ে দিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক কিছুই এখনো বদলায়নি।