দুই আফ্রিদির গল্প

উৎপলশুভ্রডটকম

২৬ অক্টোবর ২০২১

দুই আফ্রিদির গল্প

দুই আফ্রিদির মধ্যে সম্পর্কটা কি?

শাহিন শাহ আফ্রিদির গল্পটা ‘ভিনি, ভিডি, ভিসি’। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের প্রথম জয়ের গল্প লিখেছেন অসাধারণ বোলিংয়ে। ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ও তিনি। ওদিকে শহীদ আফ্রিদি তাঁর টুইটারে শেয়ার করছেন তাঁর ও শাহিনের উদযাপনের ছবি। দুজনই আফ্রিদি, কিন্তু বাস্তবে তাঁদের মধ্যে সম্পর্কটা কী?

শাহিন শাহ আফ্রিদিকে বাংলাদেশ ভোলে কিভাবে! ওদিকে শহীদ আফ্রিদি তো ভোলার উপায়ই নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর কীর্তির জন্যই নয়, বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও খেলেছেন কতবার। বিপিএল শুরু হওয়ার পর তো একরকম নিয়মিতই। এই দুই আফ্রিদিকে এখন ভারতেরও ভোলার উপায় নেই। খেলোয়াড়ি জীবনে শহীদ আফ্রিদি ভারতকে কম ভোগাননি। এবার তো বিশ্বকাপে প্রথম হারের তেতো স্বাদ নিতে হল শাহিন শাহ আফ্রিদির কারণে। তাঁকেও ভারত কখনো ভুলবে না। দুই আফ্রিদির কাউকে ভোলার উপায় নেই ক্রিকেট রোমান্টিকদেরও। তা দুই আফ্রিদির সম্পর্কটা কী?

শাহিন শাহ আফ্রিদির শিশুসুলভ হাসির সঙ্গে মাঠের ভয়ঙ্কর চরিত্রটা ঠিক যায় না। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার শাহিন আসলে শহীদ আফ্রিদির ছেলে কি না, তা নিয়েও নেটজগতে একসময় অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু শহীদের তো ছেলে নেই। সবই মেয়ে। তাহলে কি ভাই? শহীদের মতো শাহিনও ‘ভিনি, ভিডি, ভিসি’। মানে এলাম, দেখলাম, জয় করলাম টাইপের। শহীদ আফ্রিদি তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর প্রথম ইনিংসেই ৩৭ বলে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছিলেন। সেটিও ১৭ ছোঁয়ার আগেই। যদিও আত্মজীবনীতে শহীদ আফ্রিদি নিজেই জানিয়েছেন, ওটা তাঁর আসল বয়স নয়। ১৯৯৬ সালে শহীদ আফ্রিদির রেকর্ড গড়ারও চার বছর পর শাহিন শাহ আফ্রিদির জন্ম। এই মিলেনিয়ামের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে পাকিস্তান দলে অভিষেক তাঁর। ২০১৮ সালে। বুঝতেই পারছেন ১৮ বছর বয়সে।
ভারতকে হারানোর সেলফি তুলছেন শাহিন শাহ আফ্রিদি

প্রসঙ্গটা এভাবে ঘুরে গেলে চলবে কেন? ক্যারিয়ারের শুরু থেকে লাইম লাইটের আলোয় থাকা শাহিন বারবার ইন্টারভিউতে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। শহীদ আফ্রিদি তাঁর কী হয়? বারবারই বলেছেন, দুজনের মধ্যে আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবু ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ম্যাচে হিরো হয়ে যাওয়ার পর আবারও একই প্রশ্ন, শাহিন শাহ আফ্রিদি শহীদ আফ্রিদির কী হন?

এই গত মে মাসে পাকিস্তানের একটা টেলিভিশন অনুষ্ঠানে শহীদ আফ্রিদির সামনেও প্রশ্নটা এলো। তা কী বলেছিলেন তিনি? ‘আমাদের আফ্রিদিদের মধ্যে আটটা উপজাতি আছে। শাহিন আর আমরা দুটি ভিন্ন উপজাতি থেকে এসেছি।’ ওখানেই একরকম শেষ সম্পর্কের কথা। শহীদ আফ্রিদি সেখানেই অবশ্য জানান, তাঁর বড় মেয়ে আকসা আফ্রিদি চিকিৎসা বিদ্যায় পড়াশুনা করছেন। এরপর পাকিস্তানে থাকবেন, না ইংল্যান্ডে যাবেন আরও পড়তে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এটা অবশ্য আসল কথা নয়। আফ্রিদি জানিয়ে দেন, সব ঠিক থাকলে তাঁর মেয়ের সঙ্গে শাহিন শাহ আফ্রিদির বিয়ে হবে।

‘শাহিনের পরিবার থেকে আমার মেয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আমরা দুই পরিবারই যোগাযোগের মধ্যে আছি। জুটি তৈরি হয় বেহেশতে।’ শহীদ আফ্রিদি এই টুইটটা অবশ্য করেছিলেন গত মার্চ মাসে, ‘আল্লাহ চাইলে এই জুটিটাও হবে। মাঠ ও মাঠের বাইরে শাহিনের সাফল্যের জন্য আমি প্রার্থনা করি।’ 

গতকাল ৩১ রানে ৩ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের প্রথম জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন শহীদের হবু জামাতা শাহিন। রোহিত শর্মা, লোকেশ রাহুলের পর উইকেটে জমে যাওয়া ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলিও ফিরেছেন তাঁর বলেই। এমন স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা পেয়েছেন মাত্র ২১ বছরের ওই বাঁহাতি ফাস্ট বোলার। রোহিত ইয়র্কার সামলাতে পারেননি। সুইংয়ে বোকা বনে গেছেন রাহুল। আর কোহলি বাউন্সারে পরাভূত। স্বপ্নের মতো একটা দিন গেছে শাহিনের। 
একই নাম, একই নম্বর, নতুন যুগ!

পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক এবং দেশটির সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি শহীদ আফ্রিদি গেল রাতেই একটা ছবি টুইট করেছেন। যেটা আইসিসির অফিসিয়াল টুইটার থেকে নেওয়া। তার মতো দু হাত ওপরে তুলে পা দুটো হালকা ফাঁকা রেখে মাথা উঁচিয়ে উদযাপন করছেন শাহিন। ক্যাপশনে লেখা, ‘একই নাম, একই নম্বর, নতুন যুগ’।

শহীদ আফ্রিদি দীর্ঘদিন পাকিস্তান দলে ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলেছেন। এখন সেই জার্সির উত্তরসূরি শাহিন। এবং উদযাপনেও দুজনের কত মিল! ১৯৯৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের হয়ে তিন সংস্করণ মিলিয়ে শহীদ আফ্রিদি খেলেছেন ৫২৪ ম্যাচ। রান ১১১৯৬। সেঞ্চুরি ১১টি। আর উইকেট শিকার ৫৪১টি।

পাকিস্তান ক্রিকেটে শহীদ আফ্রিদি অধ্যায় শেষ হওয়ার আরও দু বছর পর দৃশ্যপটে আগমন শাহিনের। দুজনই পশতুন। একই খাইবার থেকে আসা। আফ্রিদি দুজনই। দুজনই সাহসী পুরুষ। শাহিনের ক্রিকেটে আসা অবশ্য বড় ভাই রিয়াজ আফ্রিদির আগ্রহে। শাহিন যাঁকে নিজের প্রথম কোচ বলেন। রিয়াজ ২০০৪ সালে পাকিস্তানের হয়ে তাঁর একমাত্র টেস্টটি খেলেছিলেন। 
২০১৫ সালে ভাইয়ের মাধ্যমেই প্রথম ক্রিকেট বলে খেলেন শাহিন। তার আগে টেনিস আর টেপ টেনিসে ভালো নাম কুড়িয়েছিলেন। ভাই ক্রিকেট একাডেমিতে দেন। সেখান থেকে পাকিস্তানের বয়সভিত্তিক দলে। আপনার মনে থাকতে পারে ২০১৭ সালে বিপিএলে তখনকার ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে খেলে গিয়েছিলেন শাহিন। ২০১৮ অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে খেলেন। ১২ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারীও হয়ে যান। 

এরপর ২০১৮ এর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানের সব সংস্করণের ক্রিকেটে খেলা হয়ে যায়। তিন ফরম্যাটেই এখন অটোমেটিক চয়েস শাহিনকে বাংলাদেশ মনে রাখবে ২০১৯ বিশ্বকাপের জন্য। ৫ জুলাই, লর্ডসে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ। যেটিতে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ম্যাচে ৫ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েন শাহিন। শুধু তাই নয়। তার ম্যাচ ফিগার (৬/৩৫) বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ইতিহাসের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডও। এখন পর্যন্ত ১৯টি টেস্ট, ২৯টি ওয়ানডে এবং ৩১টি টি-টোয়েন্টি খেলা হয়ে গেছে। উইকেট যথাক্রমে ৭৬, ৫৩ ও ৩৫।

সেই আফ্রিদি বিশ্বকাপে ভারতকে ১০ উইকেটে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচের পর টুইটারে লেখেন ‘বিনয়’। পরিবার পরিজনকে ধন্যবাদ দিয়ে মনে করিয়ে দেন, ‘বিশ্বাস রাখতে হবে পাকিস্তান।’ শহীদ আফ্রিদির ওপর যেমন বিশ্বাস রাখত পাকিস্তান, এখন শাহিন আফ্রিদির ওপরও তা রাখা তো আরও বাধ্যতামূলক হয়ে গেল!  

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×