২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

ইডেনের প্রতিশোধ দুবাইয়ে, বড় নির্মম সেই প্রতিশোধ

উৎপল শুভ্র

২৪ অক্টোবর ২০২১

ইডেনের প্রতিশোধ দুবাইয়ে, বড় নির্মম সেই প্রতিশোধ

মরগানের মুখের হাসিটা দেখুন

আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেয়ে নিশ্চিতভাবেই মরগানদের মনে জেগে উঠেছে সেই দুঃস্মৃতি। সাড়ে পাঁচ বছর আগে ইডেন গার্ডেনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেই ফাইনাল। কার্লোস ব্রাফেটের পরপর চার ছক্কা, ক্যারিবীয়দের উন্মাতাল উদযাপন...প্রতিশোধটা বড় নির্মমভাবেই নিয়েছে এউইন মরগানের দল।

নির্মম প্রতিশোধ বোধ হয় একেই বলে! সাড়ে পাঁচ বছর ধরে প্রতিশোধের যে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলেছে এউইন মরগানের বুকে, এতদিনে বোধ হয় তা নিভল। সেই জ্বালা নেভানোর চূড়ান্ত অঙ্কটাতে মাঠে থাকবেন বলেই হয়তো তাঁর ব্যাটিং অর্ডারে উঠে আসা। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জয়ী অধিনায়কের প্রতিক্রিয়া জানাতে আসার সময়ও দেখা গেল, পা থেকে প্যাডজোড়া তখনো খোলেননি।

সাড়ে পাঁচ বছর আগে যেমন খোলেননি মারলন স্যামুয়েলসও। অপরাজিত ৮৫ রানের ইনিংসে ম্যাচ-সেরা ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যান প্যাড না খুলেই চলে এসেছিলেন সংবাদ সম্মেলনে। এত দিন পর তা হয়তো মনেই থাকত না, যদি স্যামুয়েলস সংবাদ সম্মেলনের পুরোটা সময় প্যাড পরা ওই পা দুটি সামনের টেবিলে তুলে না রাখতেন।

ইংল্যান্ডের এমন উদযাপনের উপলক্ষ এসেছে একটু পরপরই

ইংল্যান্ড দলের কেউ তখন সেখানে ছিলেন না। তবে স্যামুয়েলসের ওই অসভ্যতার কথা তো ঠিকই গিয়েছে মরগানদের কানে। কাটা ঘায়ে যা নির্ঘাত লবন ছিটানোর কাজ করেছে। স্যামুয়েলস হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডকেই বার্তাটা দিতে চেয়েছেন, কিন্তু পরাজিত দলের গায়ে তা না লেগে পারেই না।  

সাড়ে পাঁচ বছর অনেক লম্বা সময়। কত ক্রিকেটই না হয়েছে এই সময়ে! আইসিসির দুটি বৈশ্বিক ইভেন্টও। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ। যার দ্বিতীয়টি আবার জিতেছে মরগানের ইংল্যান্ডই। তারপরও আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিশ্চিতভাবেই মরগানদের মনে জাগিয়ে তোলার কথা ইংলিশ ক্রিকেটের পুরোনো সেই ক্ষত। ইডেন গার্ডেনের সেই রাত। আদুল গায়ে ক্যারিবীয় ক্রিকেটারদের ফুটবল স্টাইলে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ানো। মাথায় হাত দিয়ে মাঠে বসে পড়া বেন স্টোকস।

টুকরো টুকরো এসব ছবি ছাপিয়ে কার্লোস ব্রাফেট। শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জিততে চাই ১৯ রান। ইংল্যান্ডই তো ছিল ফেবারিট। আগের দুই ওভারে ১৭ রান দেওয়া স্টোকসের পরপর চারটি বলকেই যে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেবেন কার্লোস ব্রাফেট...ব্রাফেটের নিজেরই তা কল্পনা করতে পারার কথা নয়।

বোলিং ওপেন করে এই প্রথম টানা চার ওভার...ম্যাচ-সেরাও মঈন আলী

এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী দিনই যখন আবার মুখোমুখি করে দিল গতবারের দুই ফাইনালিস্টকে, ফিরে ফিরে আসছিল তাই ইডেন গার্ডেনের সেই স্মৃতি। খেলায় প্রতিশোধ বলে কোনো শব্দ নাকি ব্যবহার করতে নেই। তারপরও ওই যে দাউ দাউ করে জ্বলা প্রতিশোধের আগুন দিয়ে লেখাটা শুরু করা, শুধু নাটকীয়তা তৈরি এটির উদ্দেশ্য নয়। মুখে কেউ বলুক না বলুক, ‘প্রতিশোধ’ কথাটা কখনো কখনো এসেই পড়ে। দুবাইয়ের এই ম্যাচের আগেও যেমন এসেছে, ম্যাচের পরেও। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাত্র ৫৫ রানে অলআউট করে দেওয়ায় হয়তো সেই প্রতিশোধস্পৃহার কোনো ভূমিকা নেই। তবে ইংল্যান্ডের বাড়তি তৃপ্তি বোধ করার কারণ তো আছেই।

আপনি অবশ্য বলতেই পারে, সাড়ে পাঁচ বছর আগে ইডেনের সেই ম্যাচ ছিল বিশ্বকাপের ফাইনাল, আর এটি শুধুই সুপার টুয়েলভের একটা ম্যাচ। সেই ফাইনালের সঙ্গে এটাকে মেলানো যায় নাকি! কেউ মেলাতও না, যদি ওই বিশ্বকাপ ফাইনালের দুই দলকে এবারের বিশ্বকাপ প্রথম দিনই এমন মুখোমুখি করে না দিত। যদি ওই ফাইনালটা এমন নাটকীয় সমাপ্তিতে অনন্য হয়ে না থাকত।

টি-টোয়েন্টিটা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের খেলা বলেই মোটামুটি মেনে নিয়েছে সবাই। ক্যারিবীয়দের কেয়ার ফ্রি মনোভাবের সঙ্গে খুব ভালো যায় ক্রিকেটের এই ধুমধাড়াক্কা ফরম্যাট। যায় বলেই বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের এত চাহিদা। যেটির পুরো ফায়দা তুলে নিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কথা ভুলে যেতেও দ্বিতীয়বার ভাবেন না গেইল-ব্রাভোরা। বলতে গেলে বিশ্বকাপের বছরটাতেই তাই সবাইকে একসঙ্গে পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অন্য দুই ফরম্যাটে নিভু নিভু করে জ্বলা ওয়েস্ট ইন্ডিজ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ঠিকই হয়ে ওঠে অদম্য এক দল। একাধিকবার ট্রফি হাতে নেওয়ার একমাত্র কীর্তিটিও গড়া হয়ে যায় তাদের।

সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই কী অসহায়ই না লাগল এদিন! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই প্রথম তাদের দুই অংকের রান। সর্বনিম্ন নয়, আবার এক দিক থেকে তো তাই-ই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে কম স্কোরে অলআউট হওয়ার গ্লানি আর যে একটি দলেরই, সেই নেদার‍ল্যান্ডস তো আর টেস্ট খেলুড়ে দেশ নয়। আইসিসির পূর্ণ সদস্য আর সহযোগী সদস্যের বিভাজনটা মনে রাখলে সেটিকে আলাদা করে নিলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সর্বনিম্ন স্কোরের রেকর্ডটা তো ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই হয়ে যায়।

৫৫ রানের স্কোরকার্ডে ব্যাটসম্যানদের স্কোর দিয়ে টেলিফোন নম্বর বানিয়ে ফেলা যাবে, এটাতে কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই। সেই স্কোরকার্ডে দুই অংকের রান একটাই। তা ক্রিস গেইলের। ১৩ বলে ১৩। ব্যাটে রান নেই অনেক দিন। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের মাঝপথে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ার অভাবনীয় অভিজ্ঞতাও হয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে তাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে যথারীতি। যা তুলে রীতিমতো গেইলের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে বোলিং গ্রেট কার্টলি অ্যামব্রোসকে। যাতে অনেকেই বিরক্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ভিভ রিচার্ডস নামে একজনও আছেন। মুখে জবাব না দিয়ে সেটির ভার ব্যাটের ওপরই ছেড়ে দেওয়ার যে পরামর্শ দিয়েছেন রিচার্ডস, ১৩ বলে ১৩ রান নিশ্চয়ই তা নয়। অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের এমনই দুরবস্থা যে, স্বঘোষিত ‘ইউনিভার্স বস’-কে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উপায় নেই। বাকিদের অবস্থা তো তাঁর চেয়েও খারাপ।

৫৫ রানের পুঁজি নিয়েও ইংল্যান্ডের ৪ উইকেট ফেলে দিয়ে একটু তৃপ্তি খুঁজেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

আবুধাবিতে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটা দেখে মিরপুরের কথা মনে হচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সিরিজের সেই মিরপুর। দুবাইয়ের এই ম্যাচে যা মনে হলো আরও বেশি। মঈন আলী শুধু ইংল্যান্ডের বোলিং ওপেনই করলেন না, টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো টানা চার ওভার বোলিংও করে ফেললেন। ১৭ রানে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচ-সেরাও এই অফ স্পিনারই। আমিরাতের বিশ্বকাপ যে স্পিনারদেরই হতে যাচ্ছে, তার একটা ঘোষণাও কি দিয়ে দেওয়া হলো এতে?

বিশ্বকাপের প্রতিশোধ বিশ্বকাপেই নিতে হয় বলেই এই ম্যাচ নিয়ে লেখায় ওই শব্দটার এত আনাগোনা। নইলে ইডেন গার্ডেনে ওই পরাজয়ের প্রতিশোধ তো সেই কবেই নিয়ে ফেলেছে ইংল্যান্ড। ২০১৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে অলআউট করেছে টি-টোয়েন্টিতে তাদের সর্বনিম্ন ৪৫ রানে। মাঝখানে দুদিন, পরের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭১। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওই ৪৫ ও ৭১ বিশ্বকাপের ম্যাচটির আগে দু দলের খেলা সর্বশেষ দুই টি-টোয়েন্টিতে।

এই ৫৫ তাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম দুই অংকের স্কোর হতে পারে, তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তো তা টানা তৃতীয়।

প্রতিশোধ তাহলে এভাবেই নিতে হয়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×