শাপগ্রস্ত দক্ষিণ আফ্রিকাকে উড়িয়ে ফাইনালে ভারত
পুরোনো গল্পের নতুন মঞ্চায়ন
উৎপল শুভ্র
১ অক্টোবর ২০২১
বাস্তব কোনো কারণ না খুঁজে পেলে মানুষ অতিপ্রাকৃত কিছুর সন্ধান করে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ব্যাখ্যা করতেও তেমন কিছুরই আশ্রয় নিতে হচ্ছে। গল্পে-পুরাণে অভিশাপে রাজকুমার পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। গাছে পরিণত হয় জলজ্যান্ত মানুষ। ক্রিকেটের দক্ষিণ আফ্রিকাকেও কি তাহলে তাড়া করছে তেমন কোনো অভিশাপ! তোরা বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠবি, কিন্তু ফাইনালের দেখা পাবি না!
প্রথম প্রকাশ: ৫ এপ্রিল ২০১৪। প্রথম আলো।
দক্ষিণ আফ্রিকা : ২০ ওভারে ১৭২/৪। ভারত: ১৯.১ ওভারে ১৭৬/৪। ফল: ভারত ৬ উইকেটে জয়ী।
ইতিহাস বদলায়। তবে কিছু ইতিহাস বোধ হয় বদলানোর নয়।
যেমন বদলাল না ইতিহাসের এই দুটি পৃষ্ঠার লিখন—
মহেন্দ্র সিং ধোনি কখনো সেমিফাইনাল হারেন না। দক্ষিণ আফ্রিকা কখনো বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল জেতে না।
দুটির মধ্যে কোনটিকে বেশি আশ্চর্য বলবেন? প্রশ্নটাই ফালতু। ক্রিকেট দুনিয়ায় রাঁচির তরুণের আবির্ভাবের কত আগে থেকেই তো নিয়মিত মঞ্চায়ন ওই দৃশ্যের। ফাইনালের দুয়ারে এসে দক্ষিণ আফ্রিকানদের মুখ থুবড়ে পড়া।
আধুনিক ক্রিকেটের এমন এক আশ্চর্য ধাঁধা, যেটির উত্তর কারও জানা নেই। বরং দিন দিন তাতে যোগ হচ্ছে আরও রহস্যময়তা। বাস্তব কোনো কারণ না খুঁজে পেলে মানুষ অতিপ্রাকৃত কিছুর সন্ধান করে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ব্যাখ্যা করতেও তেমন কিছুরই আশ্রয় নিতে হচ্ছে। গল্পে-পুরাণে অভিশাপে রাজকুমার পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। গাছে পরিণত হয় জলজ্যান্ত মানুষ। ক্রিকেটের দক্ষিণ আফ্রিকাকেও কি তাহলে তাড়া করছে তেমন কোনো অভিশাপ! তোরা বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠবি, কিন্তু ফাইনালের দেখা পাবি না!
এর আগে চারটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে একই গল্প। কাল মিরপুরে আরেকটি সেমিফাইনালের শেষ অঙ্কে কোনো বদল নেই। তবে এর আগে যা হলো, সেটিতে আছে। আবারও ফাইনালের মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার দুঃখ একই রকম হওয়ার কথা, তবে এবার বোধ হয় আক্ষেপ-টাক্ষেপের আড়ালে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগও নেই দক্ষিণ আফ্রিকার। যে দাপটে ভারত আক্ষরিক অর্থেই উড়িয়ে দিল তাদের, এরপর সেসব অজুহাতের মতো শোনাবে।
ব্যতিক্রম কি এখানেও যে, আরেকটি সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার হারকে এবার আর সাদা চোখে ‘চোকিং’ মনে হচ্ছে না! নাকি সেটি দৃশ্যমান হলো না তারা পরে ব্যাটিং না করায়! মিরপুরে আগের পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই জিতেছে প্রথম ব্যাটিং করা দল। টস জিতে ফাফ ডু প্লেসিসের ব্যাটিং নেওয়ার আরেকটি কারণও থাকতে পারে। চোকিংয়ের যে ছায়া ভূতের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে, রান তাড়া করার সময়ই যে সেটি ঘাড় মটকায়।
কিন্তু মিরপুরের এই উইকেটে ১৭২ রান করার পরও এমন উড়ে যাওয়াও তো ‘চোকিং’-ই! ভারতের অসাধারণ ওই রান তাড়ার সময়টাতে অসংখ্যবার টেলিভিশন ক্যামেরা ক্লোজআপে ধরল ডাগআউটে বসে থাকা অ্যালান ডোনাল্ডকে। দক্ষিণ আফ্রিকান বোলিং কোচ ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত, বিরক্ত এবং সেটি গোপন রাখার কোনো চেষ্টাই করছেন না। মাঠে শিষ্যদের জঘন্য বোলিংয়ে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের ভূত আর তাড়ানো হচ্ছে না, সেটি যে ডোনাল্ড বুঝে ফেলেছেন। বিষম ওই বোঝাটা তো তিনি নিজেও বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেক দিন।
অথচ শেষ ১০ ওভারে ১০৬ রানে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোরটা ১৭০ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর দুই ইনিংসের মাঝে সামান্য বিরতির সময়টাতে ধোনিদের বিদায়ঘণ্টাই বাজছিল। টি-টোয়েন্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকা এত রান করে কোনো দিন হারেনি। ফাইনালের সঙ্গে চিরবৈরিতার সেই গল্পটা কি তাহলে বদলাবে এবার?
বদলাল তো না-ই, বরং ম্যাচের প্রতীকী চিত্র হয়ে থাকল ম্যাচের শেষ লগ্নের ওই দৃশ্যটা। দুই দলের স্কোর যখন সমান, হেনড্রিকসের বলটা তাচ্ছিল্যভরে ব্যাট দিয়ে ঠেকালেন মাত্রই নামা ধোনি। চাইলেই জয়সূচক রানটা নিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু বিরাট কোহলির ব্যাটেই ম্যাচটা শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রতিপক্ষ এত বড় একটা স্কোর গড়ার পরও বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো একটা ম্যাচ যেভাবে খুশি শেষ করা যায়—এটাই বলে দিচ্ছে এই ম্যাচের গল্পটা।
ম্যাচের আগে অমিত মিশ্র বনাম ইমরান তাহির-জাতীয় একটা আলোচনা হচ্ছিল। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম ম্যাচ, যেটিকে অনেকে 'দুই লেগ স্পিনারের লড়াই' পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন। ম্যাচ শেষে দেখা গেল, কেন্দ্রীয় দূরে থাক, দুজনের কেউ পার্শ্বচরিত্রও নন। অমিত মিশ্র তো কোটাই শেষ করতে পারলেন না। এই ম্যাচের আগে ৫.৩৩ ইকোনমি রেট আর ৯-এর কম গড়, আর কাল ৩ ওভারে ৩৬! ইমরান তাহির একটা উইকেট পেলেন, তবে ডি ভিলিয়ার্সের দুর্দান্ত ক্যাচে যুবরাজ ফিরে যেতে যেতে ম্যাচের ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে।
মিশ্র-তাহিরের ব্যর্থতা খুব অবাক করার মতো নয়। প্রথম ওভারেই আমলাকে ক্যারম বলে বোল্ড করা রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ২২ রানে ৩ উইকেটও নয়। এই ম্যাচে আশ্চর্য বলে যদি কিছু থাকে, তা হলো এত বড় রান তাড়া করতে নেমেও ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের এমন ‘এটা কোনো ব্যাপার নাকি’ ভঙ্গিটা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেটির তাল কাটেনি এবং চতুর্থ ওভারে নামার পর থেকেই যার নেতৃত্বে বিরাট কোহলি।
ইতিহাসের বিখ্যাত সব ব্যাটসম্যানের সঙ্গে তুলনা হচ্ছে তাঁর। তবে একটা জায়গায় বোধ হয় অতীতের অনেক রথী-মহারথীকে এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছেন কোহলি। রান তাড়া করায় এমন অনায়াস কাউকে ক্রিকেট আর দেখেছে কি না সন্দেহ! এই ম্যাচের আগে টি-টোয়েন্টিতে পরে ব্যাটিং করার সময় তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৭০.৬৬! ৪৪ বলে অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংসটির পর আরেকটু বিস্ময় যোগ হলো অঙ্কটাতে।
না, ধোনি ঠিকই করেছেন। জয়সূচক রানটা বিরাট কোহলির ব্যাট থেকেই আসা উচিত ছিল!