আফ্রিদি এবং বিশ্বকাপের ‘গেরো’
উৎপল শুভ্র
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
আজ পাকিস্তান বা শহীদ আফ্রিদির প্রতিপক্ষ তো যত না ভারত, তার চেয়ে বেশি ওই ‘বিশ্বকাপ’ কথাটা! ক্রিকেটের অমীমাংসিত এক চরম রহস্য লুকিয়ে রেখেছে ওই ‘বিশ্বকাপ’। বিশ্বকাপ, তা সেটি ৫০ ওভারের হোক বা ২০ ওভারের, পাকিস্তানের কাছে কীভাবে যেন অজেয় হয়ে যায় ভারত!
প্রথম প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০১৪।প্রথম আলো।
শহীদ আফ্রিদি আজ কী করবেন?
লাখ টাকার প্রশ্ন। না, একটু কমই হয়ে গেল! আগের দিনে অঙ্কটা হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু টাকার বর্তমান মূল্যমান বিবেচনায় প্রশ্নটা আসলে ‘কোটি টাকার’!
যে প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না। সবচেয়ে কম জানেন বোধ হয় শহীদ আফ্রিদি স্বয়ং!
সেটির কারণ ক্রিকেটের গৌরবময় অনিশ্চয়তা নয়। ক্রিকেট আর কী অনিশ্চিত, শহীদ আফ্রিদি হলেন ‘অনিশ্চয়তার বাবা!’ কবীর সুমনের গানের লাইনটা কি এই পাঠানকে নিয়েই লেখা— ‘কখন কী ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না!’ দুই দলে এত তারকার ভিড়। তারপরও এত আফ্রিদি-আফ্রিদি কেন! ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখছি না। আজ মিরপুরে ‘আসল’ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর দিনেই ভারত-পাকিস্তান। মাত্র ১৮ দিন আগে এশিয়া কাপের ম্যাচটির দীর্ঘ ছায়া পড়েছে যেটির ওপর। সেদিন আফ্রিদির ম্যাচ জেতানো ছক্কার পর থেকেই ক্রিকেটাড্ডা সরগরম করে তোলা আলোচনাটা এখন তুঙ্গস্পর্শী। এটিও কি পাক-ভারত মহারণে দেড় যুগ আগে শারজায় জাভেদ মিয়াঁদাদের বিখ্যাত সেই ছক্কার মতো সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে?
১৯৮৬ সালের ১৮ এপ্রিল অস্ট্রেলেশিয়া কাপ ফাইনালের শেষ বলে মিয়াঁদাদের ওই ছক্কার মতো প্রভাবশালী কিছু ক্রিকেট ইতিহাস আর দেখেনি। যেটি বদলে দিয়েছিল ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের রংই। ওই ম্যাচের আগে ওয়ানডেতে জয়-পরাজয়ের হিসাব ভারতের পক্ষে ৮-৭। পরের ১১ বছরে দুই দলের ৩৪টি ম্যাচের ২৫টিতেই পাকিস্তানের জয়। মিয়াঁদাদের ওই ছক্কা পরের প্রজন্মের পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মনও ‘শেষ পর্যন্ত আমরাই জিতব’ আত্মবিশ্বাসে রঙিন করে দিয়েছিল আর ভারতীয়দের মনে গেঁথে দিয়েছিল হীনম্মন্যতার কাঁটা।
ওই সময়টায় পাকিস্তানি আত্মবিশ্বাসের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি ওয়াসিম আকরাম মিরপুরে এশিয়া কাপের ম্যাচটির আগের দিন বলছিলেন, ‘আমাদের সময় তো ভারত পাত্তাই পেত না। গত কিছুদিন ওরা খুব জিতছে। আশা করি, কাল চিত্রটা বদলে যাবে।’
আফ্রিদির ঝোড়ো ইনিংসে তা গিয়েছিলও। শুধু ম্যাচ জেতানো বলেই নয়, মিয়াঁদাদ আরও বেশি করে আসছেন ২৮ বছর আগে-পরে একই রকম আলোচিত দুই ছক্কার ম্যাচে অদ্ভুতুড়ে কিছু সাদৃশ্যের কারণে। ভারতের ‘২৪৫’ স্কোর, পাকিস্তানের ইনিংসে দুটি রানআউট, মিয়াঁদাদ-আফ্রিদির ইনিংসে তিন ছক্কা...এমন দশ-দশটি অবিশ্বাস্য মিল শারজা আর মিরপুরের মধ্যে!
শারজার ওই ম্যাচে ভারতের অধিনায়ক ছিলেন কপিল দেব। শেষ ওভারের আগেই নিজের কোটা শেষ করে ফেলে চেতন শর্মাকে দিয়ে কেন সেটি করাতে গেলেন—এই প্রশ্ন তাঁকে অনেক দিন তাড়া করে বেড়ানোর কথা। সেই কপিল দেব গত পরশু ধারাভাষ্য দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কবার প্রেসবক্সে পরিচিত সাংবাদিকের সঙ্গে আড্ডা মারতে এলেন। সেই আড্ডায় ‘ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে কে ফেবারিট’ প্রশ্নটা শুনে ‘এটা কোনো প্রশ্ন হলো’ ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্যভরে বললেন, ‘অবশ্যই ভারত।’
অবশ্যই দেশপ্রেম থেকে উৎসারিত জবাব। তবে টুর্নামেন্টের নামও তাতে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে। এটা ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি, মুখে মুখে যেটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হয়ে গেছে। আজ পাকিস্তান বা শহীদ আফ্রিদির প্রতিপক্ষ তো যত না ভারত, তার চেয়ে বেশি ওই ‘বিশ্বকাপ’ কথাটা!
ক্রিকেটের অমীমাংসিত এক চরম রহস্য লুকিয়ে রেখেছে ওই ‘বিশ্বকাপ’। বিশ্বকাপ, তা সেটি ৫০ ওভারের হোক বা ২০ ওভারের, পাকিস্তানের কাছে কীভাবে যেন অজেয় হয়ে যায় ভারত! পাকিস্তানের ওই একাধিপত্যের সময়টায়ও এই সত্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে দুই দলের ৫টি ম্যাচেই জিতেছে ভারত। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনবারের দেখাতেও তা-ই। ২০০৭ প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুই দলের প্রথম ম্যাচটি অবশ্য রেকর্ড বইয়ে ‘টাই’ হিসেবে লেখা আছে। টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের একমাত্র ‘বোওল আউট’-এ সেটিতেও শেষ পর্যন্ত আসলে ভারতই ‘জয়ী’!
শুধু বিশ্বকাপই নয়, ভারতের বিপক্ষে মহারণে ‘বিশ্ব’ শব্দটাই যেন পাকিস্তানের জন্য জুজু! ১৯৮৫ সালে ভিক্টোরিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত টুর্নামেন্টটিতে দুটি ম্যাচেই ভারতের কাছে হেরেছিল পাকিস্তান। কারণ কী জানেন? ওই টুর্নামেন্টটির নামেও ‘বিশ্ব’ শব্দটা ছিল! বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব ক্রিকেট!
এই ইতিহাস শহীদ আফ্রিদির অজানা থাকার কথা নয়। পাকিস্তানের এই দলে সেই যন্ত্রণার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী তো তিনিই। বড় আর ছোট দুই বিশ্বকাপেই তিনবার করে ভারতের বিপক্ষে নতমুখ বেরিয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে। ২০১১ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে তো পাকিস্তানের অধিনায়কের নামও ছিল শহীদ আফ্রিদি।
পাকিস্তানের এই দলের কোচ মঈন খান আশায় বুক বাঁধছেন, এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই বিষম ওই ‘গেরো’টা কেটে যাবে। তাঁর আশা সত্যি হলে ঘুচে যাবে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় রহস্যটা।
সবচেয়ে খুশি হবেন বোধ হয় শহীদ আফ্রিদিই। বিশ্বকাপে ‘ভারত-গেরো’ কাটানোর সুযোগ তিনি আর পাবেন বলে তো মনে হয় না!