হেলায় আফগানিস্তান জয়

উৎপল শুভ্র

৫ মার্চ ২০২২

হেলায় আফগানিস্তান জয়

ছয় মেরে জয়!

কাগজে-কলমে প্রতিপক্ষের নাম আফগানিস্তান ছিল বটে, আসল প্রতিপক্ষ তো ছিল ‘চাপ’। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের আসল সময়ে দর্শক হয়ে যাওয়ার শঙ্কা। সেই চাপ, সেই শঙ্কাকে বাংলাদেশ যেভাবে উড়িয়ে দিল, সেটির প্রতীকী প্রকাশও এনামুলের ওই ছক্কায়। 

প্রথম প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০১৪। প্রথম আলো।

আফগানিস্তান: ১৭.১ ওভারে ৭২। বাংলাদেশ: ১২ ওভারে ৭৮/১। ফল: বাংলাদেশ ৯ উইকেটে জয়ী।

এনামুল হক বাতাসে ব্যাট ছুড়লেন। ছুড়তেই পারেন। চিৎকার করে কিছু বললেনও। বলতেই পারেন। ছক্কায় ম্যাচ শেষ করার পর ব্যাটসম্যানের অমন প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক।

একটু অস্বাভাবিকও! ওই ছক্কা মারা না-মারায় যে এই ম্যাচের কিচ্ছু আসত-যেত না। আফগানিস্তানের স্কোর ছুঁয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। হাতে ৯ উইকেট এবং ৮ ওভার। এনামুল আউট হয়ে গেলেই বা কী! স্বল্পায়ু এই ম্যাচ মিনিট দুই-তিন বেশি দীর্ঘ হতো, এই যা!

তারপরও এনামুল যে আবেগের রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিলেন, প্রতীকী হয়ে সেটিই বুঝিয়ে দিল এই ম্যাচের আগে-পরের বাংলাদেশকে। এটি তো জয়ের উদযাপন নয়। গত কিছুদিন ঘিরে থাকা দুঃসহ চাপকে উড়িয়ে দেওয়া।

এ কারণেই এনামুলের মুখে হাসি নেই। সেখানে রাগ-ক্ষোভের মাখামাখি। যেটিতে ছড়িয়ে দেওয়া বার্তা—এই আফগানিস্তান নিয়ে এত কথা! ওদের কাছে একটা ম্যাচ হেরেছি বলেই আমরা ‘ফালতু’ দল হয়ে গেছি নাকি!

রাগ-ক্ষোভের কারণ আরও অনেকই ছিল। স্বাগতিক বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক পর্বে খেলতে হওয়াটাই তো একটা ‘অপমান’। চুপিসারে চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া সেই সিদ্ধান্ত প্রকাশ্য হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছিল দুরুদুরু অপেক্ষা—গ্রুপে আফগানিস্তান, না আয়ারল্যান্ড?

বাংলাদেশকে বেছে নিতে বললে নির্ঘাত সেটি আয়ারল্যান্ডই হতো। গ্রুপে পড়ল আফগানিস্তান। অস্বস্তির একটা চোরকাঁটাও সঙ্গী সেদিন থেকেই। এশিয়া কাপে পরাজয় যেটিকে আরও বড় করে দিল। সবকিছু মিলে ‘পুঁচকে’ আফগানিস্তানই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচের আকার নিয়ে ফেলল। 

আফগানিস্তানের কাছে লজ্জাজনক হার! ছবি: এএফপি

কাগজে-কলমে প্রতিপক্ষের নাম আফগানিস্তান ছিল বটে, আসল প্রতিপক্ষ তো ছিল ‘চাপ’। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের আসল সময়ে দর্শক হয়ে যাওয়ার শঙ্কা। সেই চাপ, সেই শঙ্কাকে বাংলাদেশ যেভাবে উড়িয়ে দিল, সেটির প্রতীকী প্রকাশও এনামুলের ওই ছক্কায়। 

ক্রিকেটে সব দলেরই কখনো কখনো এমন দিন আসে, যেদিন কিছুই ঠিকমতো হয় না। আবার এমন দিনও আসে, যেদিন সবকিছুই মনে মনে লিখে রাখা পাণ্ডুলিপি মেনে এগোয়। ফতুল্লার ওয়ানডেটি যদি প্রথম দিনটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে থাকে, কাল বাংলাদেশ দলের জন্য এল দ্বিতীয় দিনটি। 

যেদিন টসে জিতে মুশফিকুরের প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অস্বস্তি প্রথম বলে উইকেট নিয়েই উড়িয়ে দেবেন মাশরাফি। যেদিন সহজ ক্যাচ ফেলে পরের বলেই এর চেয়ে অনেক কঠিন ক্যাচ ধরে সাব্বির কয়েক মুহূর্তের বেশি আত্মদহনে ভুগবেন না। যেদিন মাঝখানে ফিল্ডিংও ভুলে যাওয়া বাংলাদেশ ডিরেক্ট থ্রোতে দুটি রানআউট করে দেবে। যেদিন আবদুর রাজ্জাক তাঁর আততায়ী আর্ম বল ফিরে পেয়ে বুঝিয়ে দেবেন, তাঁকে ‘শেষ’ বলে ঘোষণা করে দেওয়ার সময় এখনো আসেনি।

ফতুল্লা আর মিরপুরের সবচেয়ে বড় পার্থক্যের কথাটা তো বলাই হয়নি। না, না, সেটি ওয়ানডে আর এটি টি-টোয়েন্টি—এই পার্থক্য নয়। এটি তো বরং অস্বস্তি বাড়ানোর কাজই করেছিল। যে দলের ব্যাটসম্যানরা বল পেলেই সেটিকে কাবুলে পাঠিয়ে দিতে চায়, তারা তো ওয়ানডের চেয়ে টি-টোয়েন্টিতে আরও বেশি বিপজ্জনক।

পনেরো দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান দুই ম্যাচে সবচেয়ে বড় পার্থক্যের নাম আসলে সাকিব আল হাসান। যে কারণে এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ফতুল্লার ম্যাচটিতে দর্শক হয়ে থাকতে হয়েছিল, মুহূর্তের জন্য নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার সেই কাণ্ড এই মিরপুরেই। কালকের ম্যাচের আগে সাকিবের কি তা মনে পড়ছিল? বাড়তি একটা জেদ কাজ করছিল মনে?

চ্যাম্পিয়ন আল হাসান! ছবি: এএফপি

সাকিব উল্টো দাবি করছেন, জীবনে আর কোনো ম্যাচ নাকি এতটা নির্ভার হয়ে খেলতে নামেননি! চ্যাম্পিয়নদের বাকিদের চেয়ে আলাদা করে দেয় আত্মবিশ্বাস। সাকিবের সর্বাঙ্গ থেকে ফুটে বেরোনো সেই আত্মবিশ্বাসের আগুনেই পুড়ে ছাই আফগানিস্তান। চতুর্থ ওভারেই আক্রমণে এসে দ্বিতীয় ওভারে পরপর দুই বলে উইকেট। আফগানিস্তানের ইনিংস শেষও হলো তাঁর হাতেই।

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষকে অলআউট করার কীর্তি এই প্রথম। আফগানিস্তানের ৭২ বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে সর্বনিম্ন স্কোরও। এর আগে ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ উইকেটে ১১৮ রানে আটকে রাখাই ছিল বাংলাদেশের বোলারদের সেরা কীর্তি। তবে বৃষ্টির কারণে জোহানেসবার্গের সেই ম্যাচটি তো টোয়েন্টি-টোয়েন্টির বদলে হয়ে গিয়েছিল ‘ফোরটিন-ফোরটিন’।

বল পেলেই তেড়েফুঁড়ে মারতে যাওয়ার আফগান বীরত্ব পেস বোলিংয়ে যতটা কার্যকর, স্পিনে তা ততটাই আত্মবিধ্বংসী। বিশেষ করে উইকেটে যদি এমন টার্ন থাকে। কাল তাই শক্তির চেয়ে দক্ষতা ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটিতে দুই দলের মধ্যকার পার্থক্যটাই মূর্ত ম্যাচের ফলাফলে। সেটি এমনই যে ম্যাচটিকে বলতে পারেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের নিকৃষ্টতম বিজ্ঞাপন। বিশ্বকাপের মতো একটা মহাযজ্ঞের উদ্বোধনের জন্যও এর চেয়ে বাজে ম্যাচ আর হতে পারে না।

আরে, এসব নিয়ে কে মাথা ঘামায়! এখন আনন্দের সময়। চূড়ান্ত পর্বের পথে বিছিয়ে থাকা সবচেয়ে বড় কাঁটাটা এমন তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দেওয়া গেছে। হংকং-নেপাল তো ম্যাচ প্র্যাকটিসের নিমিত্ত মাত্র।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে এখন মেতে ওঠাই যায়! 

 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×