বড় দুঃখে বলেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা
‘আমি জানতাম, এটা দুই ম্যাচের ব্যাপার’
উৎপল শুভ্র
৩১ জুলাই ২০২১
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পরদিন ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ। অথচ আলোচনায় সেটি ছাপিয়ে ঘুরে ফিরে আসছিল আগের দিন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ। যেটিতে মাশরাফি বিন মুর্তজার অধিনায়কত্ব ও দলে তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে। বেঙ্গালুরুর রিটজ-কার্লটন হোটেলে নেওয়া অস্বস্তিকর এই ইন্টারভিউয়ে মাশরাফিকে তাই অপ্রীতিকর প্রশ্নগুলোই করতে হয়েছিল।
প্রথম প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০১৬। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: পরিস্থিতি বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটাই কি আপনার অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারের কঠিনতম ম্যাচ?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: বলতে পারেন। দুইজন মূল বোলার নেই (বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তাসকিন ও আরাফাত সানি), মোস্তাফিজকে পেলাম, আবার তামিম খেলতে পারল না। আমাদের পুরো শক্তির দল নিয়েই যেখানে বড় দলগুলোর সঙ্গে জেতাটা কঠিন, সেখানে এমন হলে কাজটা আরও কত কঠিন হয়ে যায় বুঝতেই পারছেন। আর টি-টোয়েন্টিতে তো আমরা এমন ভালো কোনো দল ছিলাম না। এশিয়া কাপ থেকেই না একটু ভালো খেলতে শুরু করেছি।
শুভ্র: আপনি নিজে মাত্র এক ওভার বোলিং করেছেন। কারণটা কী, পুরো ফিট ছিলেন না?
মাশরাফি: না, ফিটনেস নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। আমাদের প্ল্যানই ছিল, স্পিন দিয়ে ওদের আক্রমণ করা। ওটাই অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের দুর্বল দিক। এ কারণেই সাকলাইন আর সাকিবকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনছিলাম। পেসারদের মধ্যে মোস্তাফিজকে বাইরে রাখেন, ও আলাদা, যেকোনো উইকেটেই ভালো করতে পারে। স্পিনারদের ওপর ভরসা করেই আমি মাঝখানে আর আসিনি। ম্যাচটা ক্লোজ হলে আমার প্ল্যান ছিল, শেষ ওভারটা আমি করব।
শুভ্র: ১৬তম ওভারটা সাকলাইন সজীবকে দিয়ে করানোটা কি ঠিক ছিল? ওই ওভারেই তো ম্যাচটা শেষ হয়ে গেল...
মাশরাফি: ওই ওভারে ১৪ রান হয়ে যাওয়ায় এখন সবাই ভুলই বলবে। তবে ম্যাচের অবস্থাটা মনে করে দেখেন, অস্ট্রেলিয়ার তখন ৩০ বলে ৩৬ লাগে। তখন পর্যন্ত ম্যাক্সওয়েল মাত্র ৬টা বল খেলেছে, মিচেল মার্শ ২টা। মার্শের সবচেয়ে বড় সমস্যা স্পিনে। ম্যাক্সওয়েলও আগের ম্যাচে স্পিনেই আউট হয়েছে। তখন আমার কী মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল—স্পিনার আনা, না পেসার? আমাদের একাদশ দেখেন। আমরা তো স্পিন আক্রমণ নিয়েই নেমেছি। আর এটা শুধু আমি একা ঠিক করি না, টিমেরও একটা প্ল্যানিং থাকে। কোচিং স্টাফের কথা থাকে। মাঠের বাইরে থেকে দেখে অনেকের অনেক কিছু মনে হয়। তবে এর বাইরেও অনেক কিছু থাকে। সব বলতে চাই না। তবে ঘটনা হলো, অধিনায়ক হিসেবে জবাবদিহি আমাকেই করতে হয়।
শুভ্র: সাকলাইনের এটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। মাত্রই বেঙ্গালুরুতে এসেছে। ওর ওপর ভরসা করাটা কি ঠিক হয়েছে?
মাশরাফি: দেখেন, ও স্পেশালিস্ট স্পিনার হিসেবে খেলছে। আমাকে তো ওর ওপর ভরসা করতেই হবে। ওর অনভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করেই তো আমি ওকে টানা দুই ওভার করাইনি। এক ওভার-এক ওভার করিয়ে ওকে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছি। মোস্তাফিজের একটা ওভার রেখে দিতে চেয়েছিলাম। তাহলে অপশন কী ছিল, সাকলাইনকে আনব না আমি বা আল আমিন। সাকলাইন মোটামুটি একটা ওভার করে দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস ছিল। হয়নি, কী করা যাবে! আপনার মনে আছে কি না, পরের ওভারেই মুস্তাফিজ কিন্তু ২টা ছয় খেয়েছে।
শুভ্র: তাসকিন-সানির চেয়ে তামিমের অনুপস্থিতিটাই কি বেশি ভোগাল? প্রথম ৬ ওভারে মাত্র ৩৩ রান করেই তো পিছিয়ে পড়ল বাংলাদেশ...
মাশরাফি: আমি কোনোটাকেই কম ক্ষতি বলব না। তামিম খেললে হয়তো প্রথম ৬ ওভারে আরও বেশি রান হতো। আবার না-ও হতে পারত। তবে আপনি তো অবশ্যই আপনার দলের সেরা ব্যাটসম্যানকে পেতে চাইবেন। তবে আমি বলব, শুধু ব্যাটিং নয়, বোলিংয়েও আমরা প্রথম ৬ ওভারে খারাপ করেছি। ওই সময় তাসকিনকে তো মিস করেছিই। মোস্তাফিজ আমাদের সেরা বোলার, কিন্তু ওকে তো অনেকগুলো ম্যাচে আমরা পাইনি। যদি খেয়াল করে দেখেন, মোস্তাফিজের অনুপস্থিতিতে গত এশিয়া কাপ থেকে তাসকিনই ছিল আমাদের সেরা বোলার। ও সব সময় ব্রেক থ্রু দিয়েছে।
শুভ্র: অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনের পর সাংবাদিকদের সামনে অমন ভেঙে পড়া কি ঠিক হয়েছে? কেউ যদি বলে, অধিনায়ক নিজেই অমন ভেঙে পড়লে দল তো হতোদ্যম হয়ে পড়বেই...
মাশরাফি: কারও যদি অমন মনে হয়, কী করার আছে! আমি কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে কাঁদিনি। সেটি পেশাদারিভাবেই শেষ করেছি। বেরিয়ে আসার পর যখন সাংবাদিকেরা পিছু পিছু এসেছে, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমিও তো মানুষ। আমারও আবেগ আছে। আর একই ঘটনা একেকজনের মনে একেকভাবে লাগে। টিমমেটের জন্য একেকজন একেকভাবে ফিল করে।
শুভ্র: এবার একটা অপ্রীতিকর প্রশ্ন করি। আপনি মাত্র এক ওভার করায় অনেকে দলে আপনার জায়গা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলেছে। যতটা না বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম, তার চেয়ে বেশি বাইরের লোকজন। এমন প্রশ্ন শুনতে তো আপনি অভ্যস্ত নন, তাই না?
মাশরাফি: অবশ্যই না। দেখেন, গত বছরও ওয়ানডেতে দলের পক্ষে আমার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট ছিল। আমি সব সময়ই বলে এসেছি, খেলোয়াড় হিসেবে দলে থাকাটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি কত সংগ্রাম করে খেলি, এসব বলে কারও সহানুভূতি পেতে চাই না। কেউ প্রশ্ন তুললে আমি প্রতিক্রিয়াও দেখাই না। আর কে প্রশ্ন তুলেছে বললেন?
শুভ্র: শচীন টেন্ডুলকারের বইয়ের অনুলেখক এক ভারতীয় ক্রিকেট লেখক...
মাশরাফি: ওহ্, ওতে আমার কিছু আসে যায় না। বাইরের কেউ যা ইচ্ছা বলতে পারে। আমি বাংলাদেশের জন্য খেলি। বাংলাদেশের মানুষ কী বলল, শুধু সেটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
শুভ্র: গত বছর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে আপনি হিরো, আর এবার আপনাকে নিয়ে প্রশ্ন। জীবনের মতো ক্রিকেটও কি তাহলে সব রূপই দেখায়?
মাশরাফি: ক্রিকেটটাও জীবনের মতোই কঠিন। মানসিকভাবে আপনি যত শক্তই হোন, প্রতিক্রিয়া তো হয়ই। তবে এমন যে হতে পারে, আমি তা আগে থেকেই জানি। যখন জিতে চলেছি, তখন মানুষ মাথায় তুলে নিয়েছে। তখনো আমি জানতাম, এটা দুই ম্যাচের ব্যাপার। দুইটা ম্যাচ খারাপ করলেই কী হতে পারে, সব সময়ই আমার তা জানা ছিল।
শুভ্র: এই বিশ্বকাপ শেষে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত কি তাহলে চূড়ান্ত?
মাশরাফি: এখনই বলতে চাইছি না। সবাই যদি একটু ধৈর্য ধরে, সময়মতো ঠিকই জানতে পারবে। এমনও হতে পারে, কালকের (পরদিন ভারতের বিপক্ষে) ম্যাচের পরই অবসর নিয়ে নিলাম।
শুভ্র: বলেন কী, ভারতের বিপক্ষে খেলছেন তো?
মাশরাফি: কেন খেলব না! অবশ্যই খেলব।