বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি
স্টিভ স্মিথকে প্রথম চিনেছিলাম যে ম্যাচে
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১০
উৎপল শুভ্র
৩১ জুলাই ২০২১
ব্রিজটাউনের কেনসিংটন ওভালের গতিময় উইকেটেও বাংলাদেশের স্পিনারদের কল্যাণে ৬৫ রানে অস্ট্রেলিয়ার ৬ উইকেট নেই। এরপরও ১৪১ হলো, মাইক হাসির সঙ্গে তখন একেবারেই অখ্যাত এক তরুণ ৭৪ রানের জুটি গড়ে ফেলায়। সেই তরুণের নাম স্টিভ স্মিথ। ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ সেই ম্যাচ।
অস্ট্রেলিয়া: ২০ ওভারে ১৪১/৭। বাংলাদেশ: ১৮.৪ ওভারে ১১৪। ফল: অস্ট্রেলিয়া ২৭ রানে জয়ী
ম্যাচ শুরু হওয়ার ঘণ্টা তিনেক আগেও জেমি সিডন্স বলছিলেন, 'না মেইট! নো চান্স! গায়ানা টায়ানার মতো উইকেটে খেলা হলে একটা কথা ছিল। বারবাডোজের এই উইকেটে অস্ট্রেলিয়ান কুইকস... তার ওপর আবার তামিম নেই।'
অস্ট্রেলিয়ান ইনিংসের ১৬ ওভার পর্যন্তও সেই জেমি সিডন্সেরও বোধ হয় মনে হচ্ছিল, হয়েও যেতে পারে। ৪ ওভার বাকি থাকতে অস্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটে ৮৯। বাংলাদেশের বোলাররা যেভাবে চেপে ধরেছে, কতই আর হবে!
হলো ১৪১। শেষ ৪ ওভারে ৫২!
অস্ট্রেলিয়া ১৪১ করে ফেলার পরই আসলে ম্যাচ শেষ। তারপরও প্রেসবক্সে হিসাব-নিকাশ হলো। পাকিস্তানি সাংবাদিকের তৎপরতাই বেশি। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানালেন, বাংলাদেশ ১৯ ওভারে জিতে গেলেই পাকিস্তান আউট! বাংলাদেশের ইনিংস মাঝপথে যেতে না যেতেই অবশ্য খেলা দেখা বাদ দিয়ে ওই সাংবাদিক মেতে উঠলেন তুমুল আড্ডায়।
১৯ ওভার দূরে থাক, ২০ ওভারেও বাংলাদেশের জয়ের আশা যে ততক্ষণে তিরোহিত। প্রথম ওভারেই গতিতে ইমরুল কায়েসের চোখ ঝলসে দিলেন শন টেইট। শেষ বলটিতে আউট হলেন অবশ্য টেইট গতি কমিয়ে দেওয়ায়। দ্বিতীয় উইকেটটিতেও টেইটের ভূমিকা আছে। ন্যানেসের পরের ওভারে আশরাফুলের আপারকাটটিকে দারুণ এক ক্যাচ বানালেন তিনিই। ৪ ওভার শেষ হওয়ার আগেই আফতাব ও মাহমুদউল্লাহকেও হারিয়ে বাংলাদেশের ৪ উইকেট নেই। রান মাত্র ১৫!
সাকিব ও মুশফিকের ৪৮ রানের জুটিটি উইকেটে যাওয়া-আসার মিছিলটা কিছুক্ষণের জন্য ঠেকাল। এর বেশি কিছু নয়। সাকিবের পক্ষেই সম্ভব ছিল কিছু একটা করা। করতে পারলেন না মাইক হাসির কারণে। ২৯ বলে অপরাজিত ৪৭ করে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশকে পুড়িয়েছেন, ফিল্ডিংয়েও পোড়ালেন স্কয়ার লেগে অসাধারণ এক ক্যাচ নিয়ে সাকিবকে ফিরিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং বরাবরই ভালো। গলায় চেপে বসা ফাঁস থেকে মুক্তির আনন্দে সেটিকে আরও ধারালো বলে মনে হলো এ দিন। ক্যাচ উঠলেই হলো, আর রক্ষা নেই।
ম্যাচের শুরুটা ছিল স্বপ্নের মতো। মাশরাফির প্রথম ওভারে মাত্র ২ রান। পরের ওভারের প্রথম বলেই ওয়াটসনের উইকেট। সাকিব চতুর্থ ওভারেই বল হাতে নিয়ে দ্বিতীয় বলেই ফেরালেন টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানদের একজন ওয়ার্নারকে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাঁচ বোলারকেই বোলিং করালেন প্রথম ১০ ওভারের মধ্যেই। তাঁদের মধ্যে তিনজন আবার স্পিনার।
কেনসিংটন ওভালের পেস-বান্ধব উইকেটেও স্পিন অপাঙ্ক্তেয় নয় বলে প্রমাণ করলেন তিনজনই। প্রথম তিন ওভারে সাকিব দিলেন মাত্র ১৩ রান, রাজ্জাক ১৫, আশরাফুল ১৬। আশরাফুল তো পর পর দুই বলেই উইকেট পেয়ে গিয়েছিলেন প্রায়। মাইকেল ক্লার্ককে লং অফে ক্যাচ বানানোর পরের বলেই ডেভিড হাসিও ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ওখানেই। কিন্তু এবার সেটি হাতে নিয়েও ফেলে দিলেন টি-টোয়েন্টিতে অভিষিক্ত জহুরুল। প্রথম তিন ওভারে সবচেয়ে মিতব্যয়ী মাশরাফি (৩-০-১১-১)। শেষ ওভারেই দিয়ে ফেললেন এর চেয়ে ৬ বেশি।
মাশরাফির চতুর্থ ওভার দিয়ে শুরু অস্ট্রেলিয়ার শেষ চার ওভারের তাণ্ডবের। প্রথম বলটিই ফুলটস, তাতে ছক্কা মারলেন মাইক হাসি । চতুর্থ ও পঞ্চম বলে আরও দুটি চার—রান এল ১৭। সাকিব-রাজ্জাকের পরের দুই ওভারে ১২ ও ১৪। শফিউলের শেষ ওভারটি সে তুলনায় যথেষ্টই ভালো। ওয়াইডের কারণে একটি বাড়তি বল করেও ৯ রান।
এক সময় মাইকেল বেভান যেটি নিয়মিতই করতেন, অস্ট্রেলিয়ার এই দলে সেই ভূমিকাটা এখন মাইকেল হাসির মাঝখানে কিছুদিন একটু ম্রিয়মাণ ছিল ব্যাট, কাল আবার ত্রাণকর্তার ভূমিকায় । সঙ্গী পেলেন স্টিভ স্মিথকে। মিচেল জনসন চোট না পেলে অস্ট্রেলিয়া হয়তো চার ফাস্ট বোলার খেলায়, তা হলে আর স্টিভ স্মিথ দলে থাকেন না। স্মিথের ১৮ বলে ২৭ আর মাইক হাসির সঙ্গে ৭ ওভারে ৭৪ রানের জুটিটির সময় জনসনের ইনজুরিকে শাপে বর বলেই মনে হওয়ার কথা অস্ট্রেলিয়া দলের।
সেই ২০০৭ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর টানা ১১ ম্যাচে পরাজয়ের গ্লানিকে সঙ্গী করে এই ম্যাচে নেমেছিল বাংলাদেশ। আর অস্ট্রেলিয়া গত বছর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেওয়ার পর টি-টোয়েন্টিতে আর হারেনি। অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয়টা তাই একদমই অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে ৬ উইকেটে ৬৫ বানিয়ে ফেলেও হারতে হওয়ায় যন্ত্রণাটা একটু বেশিই হচ্ছে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের পর 'যদি এটা না হতো’ ‘যদি ওটা হতো'—এমন অনেক 'যদি' ভিড় করেছিল। এই ম্যাচ সেই ভিড় আরেকটু বাড়িয়ে দিল বাংলাদেশের জন্য এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হয়ে থাকল আক্ষেপের আরেক নাম!