শেষ ওভারের নায়ক মাহমুদউল্লাহ
দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়
উৎপল শুভ্র
২০ জুলাই ২০২১
উইকেটে দুজন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান, হাতে ৬ উইকেট নিয়ে শেষ ওভারে আয়ারল্যান্ডের জিততে লাগে ১০ রান। ২০১২ সালে বেলফাস্টে টি-টোয়েন্টি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সেই ওভারটি করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। আয়ারল্যান্ডকে ১০ রান করতে না দিয়ে তিনি শেষ ওভারের নয়ক। দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়েরও।
প্রথম প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০১২। প্রথম আলো।
পঞ্চম বলটা করার পর মাহমুদউল্লাহর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘আল্লাহ, এটা কী হলো!’
ব্লকহোলে ফেলতে চেয়েছিলেন। হয়ে গেছে ফুল টস। এড জয়েস চালালেন। ছক্কা মারারই বল, কিন্তু ছক্কার বদলে লং অফে তামিম ইকবালের হাতে ক্যাচ!
এর আগের বলটাও মাহমুদউল্লাহর কথা শোনেনি। ব্লকহোল করতে গিয়ে সেটিও ফুল টস। পরের ঘটনা একই রকম। শুধু ব্যাটসম্যান-ফিল্ডারের নামটা আলাদা। ছক্কার বদলে পয়েন্টে সাকিব আল হাসানের হাতে ক্যাচ। সেবার লং অনে।
ক্রিকেটে কখনো কখনো ভাগ্যদেবী যেন আগেই ঠিক করে রাখেন কার কণ্ঠলগ্না হবেন। গত পরশু আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে কি মাহমুদউল্লাহকে আগেই পছন্দ করে রেখেছিলেন? শেষ তিন বলে ৮ রান দরকার—ওই অবস্থায় পরপর ওই দুটি ফুল টস! যে দুটিই ছক্কা হয়ে যেতে পারত। হলে কী হতো—খলনায়ক হয়ে যেতেন মাহমুদউল্লাহ? হয়তো না। খেলছেন দুজন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান, হাতে ৬ উইকেট—এ অবস্থায় টি-টোয়েন্টির শেষ ওভারে ১০ রান ঠেকাতে না পারলে বোলারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর খুব একটা সুযোগ থাকে না। তবে প্রশ্ন তখন উঠতই, শেষ ওভারটা কেন মাহমুদউল্লাহকে দিয়ে করালেন মুশফিকুর রহিম? সেটি সাকিবের জন্য বরাদ্দ রাখলেই কি ভালো হতো না!
ক্রিকেটে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এমন কথা হয়ই। তবে ফাটকা কাজে না লাগলে যদি সমালোচনা হয়, তা হলে উল্টোটা হলে প্রশংসাও প্রাপ্য। মাহমুদউল্লাহকে দিয়ে শেষ ওভারটা করানোটাকে এখন যেমন ‘মাস্টার স্ট্রোক’ বলে ফেললেও কেউ আপত্তি করবেন না। সীমিত ওভারের ম্যাচে শেষ ওভার যখন নির্ধারক হয়ে যায়, অধিনায়কের সিদ্ধান্তকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে বোলারদের কার কেমন আত্মবিশ্বাস। এদিন ১৭ ওভারের পরই মাহমুদউল্লাহ মুশফিককে বলেছিলেন, ‘মুশ, তোর যদি আস্থা থাকে, তাহলে আমাকে দিতে পারিস। ইনশাআল্লাহ, আমি করে দেব।’
সবাই যখন শেষ ওভার নিয়েই কথা বলছে, মুশফিক মনে করিয়ে দিলেন মাহমুদউল্লাহ আসল কাজটা করেছেন ১৮তম ওভারে। ৩ ওভারে যখন ২৩ রান দরকার, ওই ওভারে দিয়েছেন মাত্র ৪ রান। আয়ারল্যান্ডের জয়ের সমীকরণটা একটু কঠিন হয়ে ১২ বলে ১৯ রান হয়ে যায় এতেই।
করে দিয়েছেনও। দুই ওভারের প্রথম স্পেলে ১৬ রান দিয়েছিলেন। এর পরও মুশফিক যে ১৮তম ওভারটি করতে মাহমুদউল্লাহর হাতেই বল তুলে দিলেন, সেটির কারণ ওই আত্মবিশ্বাস। সবাই যখন শেষ ওভার নিয়েই কথা বলছে, মুশফিক মনে করিয়ে দিলেন মাহমুদউল্লাহ আসল কাজটা করেছেন ওই ১৮তম ওভারেই। ৩ ওভারে যখন ২৩ রান দরকার, ওই ওভারে দিয়েছেন মাত্র ৪ রান। আয়ারল্যান্ডের জয়ের সমীকরণটা একটু কঠিন হয়ে ১২ বলে ১৯ রান হয়ে গেল এতেই।
ভাগ্যদেবীর পক্ষপাতের কথা বলা হয়েছিল। ১৮তম ওভারটিতে মাহমুদউল্লাহ যে বোলিং করেছেন, তাতে কিন্তু ভাগ্য-টাগ্যের কোনো ব্যাপার নেই। মাত্র ৪টি সিঙ্গেল নিতে দিয়েছেন আইরিশদের। কিন্তু সেটিও যথেষ্ট কি না, সংশয় ছিল তা নিয়ে। আয়ারল্যান্ডের ইনিংস যেভাবে এগোচ্ছিল, তাতে সত্যিই কি জয়ের কথা ভাবতে পেরেছিলেন? মাহমুদউল্লাহ সরাসরি ‘হ্যাঁ’-‘না’ না বলে অঙ্কের হিসাবের আশ্রয় নিলেন, ‘৪ ওভারে মনে হয় ওদের ৩০ দরকার ছিল। ৭ উইকেট হাতে। ওদের সুযোগই বেশি ছিল। আমাদের যদি ৪০ পারসেন্ট হয়, তাহলে ওদের ৬০ পারসেন্ট ছিল বা ৬৫-৩৫ এ রকম। ওই সময়ে আমি একটা ভালো ওভার করলাম। সাকিবও একটা। এ দুটি ওভার আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল।’
শেষ ওভারে দল বা দেশের নিয়ন্তায় পরিণত হওয়ার অভিজ্ঞতাও ক্যারিয়ারে এই প্রথম হলো মাহমুদউল্লাহর। অভিষেক টেস্টেই ইনিংসে ৫ উইকেট আছে, তারপরও অফ স্পিনার তাঁর মূল পরিচয় নয়। মূলত ব্যাটসম্যান, লাগলে বোলিং করেন।
১৯তম ওভারে সাকিব দিলেন ৯ রান। শেষ ওভারের প্রথম দুই বলে দুটি সিঙ্গেলের বেশি নিতে দিলেন না মাহমুদউল্লাহ। তৃতীয় বলে কোনো রানই না। ৩ বলে ৮ রানের চাপই হয়তো ফুলটসে মরণ ডেকে আনল পয়েন্টার ও জয়েসের। শেষ বলটায় ট্রেন্ট জনস্টন ছক্কা মেরেছেন। ক্যারিয়ারে এই প্রথম ছক্কা খাওয়ার পরও মাহমুদউল্লাহর মুখে হাসি! ‘শেষ বলটা করার সময় আমার মাথায় একটাই চিন্তা ছিল—বলটা যেন ফেয়ার হয়!’
শেষ ওভারে দল বা দেশের নিয়ন্তায় পরিণত হওয়ার অভিজ্ঞতাও ক্যারিয়ারে এই প্রথম হলো মাহমুদউল্লাহর। অভিষেক টেস্টেই ইনিংসে ৫ উইকেট আছে, তারপরও অফ স্পিনার তাঁর মূল পরিচয় নয়। মূলত ব্যাটসম্যান, লাগলে বোলিং করেন। পরশুর ম্যাচের আগে ১৩টি টি-টোয়েন্টিতে বল করেছেন মোট ১৬.১ ওভার, ৪ ওভারের কোটা পূর্ণ করেছেন মাত্র ২ বার, পাঁচ ম্যাচে বোলিংই করেননি। পরশুর ২৮ রানে ২ উইকেট পরিসংখ্যানে যেমন টি-টোয়েন্টিতে তাঁর সেরা বোলিং, তাৎপর্য বিচারেও তা-ই।
এই জয়ে এক লাফে আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ের ৬ নম্বরে—এটা বিবেচনায় নিলে মাহমুদউল্লাহর শেষ ওভারটি তো বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসেই আলাদা জায়গা পেয়ে যায়।