আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
এশিয়া কাপ ২০১৪
উৎপল শুভ্র
১৯ জুলাই ২০২১
দুই বছর আগে এশিয়া কাপের ফাইনালে ২ রানে হারার পর মুশফিক-সাকিবদের কান্না কাঁদিয়েছিল পুরো দেশ। ২০১৪ এশিয়া কাপে সেই পাকিস্তানের বিপক্ষে এই ম্যাচটিও কম কষ্টের ছিল না। ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বোচ্চ ৩২৬ রানের রেকর্ড গড়েও হারতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। যে ম্যাচের রিপোর্ট লিখতে গিয়ে মনে পড়ছিল হেলাল হাফিজের কবিতার লাইন।
প্রথম প্রকাশ: ৫ মার্চ ২০১৪। প্রথম আলো।
কষ্ট নেবে কষ্ট...
এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ মানেই কি তবে সেই কষ্ট ফেরি করে বেড়ানোর কবিতা!
দুই বছর আগে ফাইনালে ২ রানে পরাজয়ের দুঃখ বাংলাদেশের ক্রিকেটে দগদগে এক ক্ষত হয়ে আছে এখনো। শুধু তো জয় হারিয়ে যাওয়ার কষ্টই নয়, হাতছোঁয়া দূরত্বে জ্বলজ্বল করতে থাকা ট্রফিটার মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার কষ্টও ছিল সেখানে। তার পরও কি সেটিকে ছাড়িয়ে গেল কালকের কষ্ট?
বাংলাদেশের ইনিংস শেষে স্কোরবোর্ডে যখন ৩ উইকেটে ৩২৬, কেমন যেন অতিপ্রাকৃত দেখাচ্ছিল সেটিকে। গত কিছুদিনের হতাশার অন্ধকার থেকে এভাবে আলোতে ফিরে এল বাংলাদেশ! পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার ছত্র তখন আকাশে-বাতাসে গুঞ্জরিত—
অলৌকিক এইভাবে ঘটে।
হঠাৎ একদিন ফাঁক হয়ে যায় সাদাসিধে ঝিনুক,
ভিতর থেকে ঠিকরে বেরোয় সাদা জোৎস্না।
কে জানত, শেষ পর্যন্ত পূর্ণেন্দু পত্রী নন, সত্যি হয়ে উঠবেন হেলাল হাফিজই! ফ্লাডলাইটের ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া আলোয় ম্লানমুখ মুশফিকুর রহিম যখন সংবাদ সম্মেলনে আসছেন, পুরো বাংলাদেশকে আচ্ছন্ন করে রাখবে কবিতার ওই লাইনটি—
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট!
‘কালো’র সেই কষ্টে ডুবে যাওয়ার আগে কী আলোই না ছড়াল বাংলাদেশ! গত কিছুদিন বিতর্কে জর্জরিত, সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত দলটি সবকিছু উড়িয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল মাঠে। শেষ পর্যন্ত ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচগুলোর একটি ৩ উইকেটে পরাজয়ে শেষ হলেই বা কী, বাংলাদেশের এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প তো ক্রিকেটীয় রূপকথাকেও হার মানানোর মতো।
বাংলাদেশের ইনিংস নিয়ে ‘অলৌকিক এইভাবে ঘটে’ লাইনটি যেমন খুব খেটে যায়, পুরো ম্যাচটি নিয়েও কি নয়! গত তিন বছরেরও বেশি ২৬০ রানের বেশি তাড়া করে জেতেনি যে পাকিস্তান, তারাই কি না পেরিয়ে গেল বাংলাদেশের গড়া ৩২৬ রানের পাহাড়!
সেই পাহাড়কে আরও উঁচু মনে করাচ্ছিল ইতিহাস। পাকিস্তানকে তো ইতিহাসই গড়তে হতো এই ম্যাচ জিততে। ভেঙে দিতে হতো প্রায় ছয় বছর আগে মোহালিতে ভারতের বিপক্ষে ৩২১ রান তাড়া করার রেকর্ড। কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের গৌরব আর হতাশার মাখামাখি এক ভুতুড়ে রাতে সেটি তারা করেও ফেলল!
ম্যাচটাই তো আসলে ভুতুড়ে! এ এমন এক ম্যাচ, যেটিতে এক বোলারের বোলিং বিশ্লেষণ হবে ০-০-৮-০! এমন এক ম্যাচ, যেটিকে বল স্টাম্পে লাগার পরও বেল পড়বে না! এমন এক ম্যাচ, যেখানে রেকর্ড নিয়ে ভাঙা-গড়ার খেলা চলবে। শেষ পর্যন্ত, শেষ পর্যন্ত ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বোচ্চ স্কোর করেও হেরে যাবে বাংলাদেশ!
তা কার কাছে হারল বাংলাদেশ? আহমেদ শেহজাদের নাম আসবে। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো খেলতে নেমেই যাঁর ব্যাট থেকে সেঞ্চুরি। আসবেন ফাওয়াদ আলম। সাড়ে তিন বছর পর ওয়ানডে খেলতে নেমে রান আউট হয়ে ফেরার সময় যাঁর পেছনে বাংলাদেশের স্বপ্নের ধ্বংসাবশেষ! কিন্তু শেষ পর্যন্ত এরা নিমিত্ত মাত্র। স্বপ্নভঙ্গ তো আসলে শহীদ আফ্রিদির ব্যাটেই।
বিশ্ব ক্রিকেটে তাঁর আবির্ভাবই ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়ে। ১৭ বছর ধরে শহীদ আফ্রিদি সেই আদি ও অকৃত্রিম রূপে—চার মারার চেয়ে ছক্কা মারা যাঁর কাছে অনেক সহজ! আগের ম্যাচে তাঁর ছক্কার তোড়েই এশিয়া কাপ থেকে ভেসে গেছে ভারত। আর কাল রাতে ফ্লাডলাইটের আলোয় উজ্জ্বল মিরপুর স্টেডিয়ামে আঁধার নামিয়ে আনল আফ্রিদির ছক্কার মিছিল।
এ এমন এক ম্যাচ, যেটিতে এক বোলারের বোলিং বিশ্লেষণ হবে ০-০-৮-০! এমন এক ম্যাচ, যেটিকে বল স্টাম্পে লাগার পরও বেল পড়বে না! এমন এক ম্যাচ, যেখানে রেকর্ড নিয়ে ভাঙা-গড়ার খেলা চলবে। শেষ পর্যন্ত, শেষ পর্যন্ত ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বোচ্চ স্কোর করেও হেরে যাবে বাংলাদেশ!
যখন নেমেছেন, ৫২ বলে প্রয়োজন ১০২ রান। চোট পাওয়া পা আর মিড অফ থেকে সাকিবের দুর্দান্ত থ্রো যখন ৪৭তম ওভারে রান আউট করে দিল, সমীকরণটা হয়ে গেছে অনেক সরল। ১৯ বলে ৩৩ রান।
তারপরও আশা ছিল। আফ্রিদি-ঝড়ে নিবুনিবু বাংলাদেশের আশার প্রদীপ তাঁর বিদায়ে আবারও আলো ছড়াচ্ছিল। রাজ্জাকের একটি ওভারই আবার তা নিভিয়ে দিল। আফ্রিদি যতক্ষণ ছিলেন, ফাওয়াদ ছক্কা-টক্কার দিকে মনই দেননি। পরিস্থিতির দাবি মেটাতে সেই তিনিই অবলীলায় দুটি ছক্কা মেরে দিলেন! সেই ওভারে ১৮ রানের পরই আসলে ম্যাচ শেষ!
জয় থেকে মাত্র ৩ রান দূরত্বে শুরু শেষ ওভারের প্রথম চারটি বল যেন আশার ছলনে ভোলাল বাংলাদেশকে। আল আমিনের প্রথম দুটি বল ডট, পরের বলে সিঙ্গেল, চতুর্থ বলে রান নেওয়ার মরিয়া চেষ্টায় ফাওয়াদ রান আউট। দুই বল, দুই রান—পঞ্চম বলে উমর আকমলের চারে শেষ বলটির আর আলোর মুখই দেখা হলো না।
পরপর দুই ম্যাচে অবিশ্বাস্য দুই জয়ে পাকিস্তান তখন উল্লাসে মাতোয়ারা। আর মাঠে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা চোখে অবিশ্বাস আর বুকে যন্ত্রণা নিয়ে সেদিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে। এত দিন কিছুই হয়নি। যেদিন হলো, সেদিনও শেষ অঙ্কে সেই পরাজয়ই লিখে রেখেছিল নিয়তি!
অথচ ম্যাচের শুরু থেকেই তো বাতাসে আনন্দের আগমনী। উদ্বোধনী জুটিতে ১৫০ রান। বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, সর্বোচ্চটি সেই টেস্ট যুগপূর্ব সময়ের কাহিনি। সেঞ্চুরি করলেন এনামুল। সে জন্য অভিনন্দন তো পাবেনই, এনামুলের ধন্যবাদ প্রাপ্য আরেকটি কারণেও। একেবারে ঠিক সময়ে আউট হয়েছেন বলে!
৪০তম ওভারের শুরুতে বাংলাদেশ ১ উইকেটে ২০৪। শেষ ১০ ওভারে কত রান হবে—৭০? ৮০? হাতে ৯ উইকেট, ৯০-ও তো হয়ে যেতে পারে!
কিন্তু এই দিনটা যে অন্য রকম! যেদিন কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে বাস্তব। যেদিন যা হওয়ার নয়, সেটিও হয়ে যাবে। সাকিব আর মুশফিকের ব্যাটে এমন ঝড় উঠল যে, শেষ ১০ ওভারে চার আর ছক্কার বন্যায় ১২১!
হ্যাঁ, ১২১-ই! শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড? হয়তো বা! যেখানে ‘হয়তো বা’ লাগছে না, সেটি হলো, যখন কেউ কল্পনাও করেনি, তখনই ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড! এনামুল-ইমরুল-মুমিনুলের সাজিয়ে দেওয়া মঞ্চে মুশফিক ও সাকিবের প্রলয় নাচনে পাকিস্তানের বোলাররা নেমে এল পাড়ার বোলারদের স্তরে। ৩৩ বলে মুশফিকের অপরাজিত ৫১। সাকিব তো আরও বিধ্বংসী—অপরাজিত ৪৪ মাত্র ১৬ বলে।
তখন কে জানত, সবকিছুকে ম্লান করে দিতে ব্যাটে শাণ দিচ্ছেন শহীদ আফ্রিদি!
কষ্ট নেবে কষ্ট...
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩২৬/৩। পাকিস্তান: ৪৯.৫ ওভারে ৩২৯/৭। ফল: পাকিস্তান ৩ উইকেটে জয়ী।