সাকিবের প্রিয় সংখ্যা কি ৯৬?

উৎপল শুভ্র

১৯ জুলাই ২০২১

সাকিবের প্রিয় সংখ্যা কি ৯৬?

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের সর্বশেষ ৯৬। যথারীতি ম্যাচ-সেরা! ছবি: টিভি থেকে

জার্সি নাম্বার ৭৫ হতে পারে, হয়তো প্রিয় সংখ্যাও এটিই। তবে সাকিবের প্রিয় সংখ্যা যদি `৯৬`-ও হয়, তাতে একটুও বিস্মিত হব না। ৯৬ রান করা মানেই যে ম্যাচ-সেরা হওয়ার নিশ্চয়তা। তা তিনি পরাজিত দলে থাকলেই বা কি! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের ৯৬ রানের চারটি ইনিংসেই তো এই গল্প!

সাকিবের প্রিয় সংখ্যা কি ৯৬? 

কখনো তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। জার্সি নম্বর যেহেতু ‘৭৫’, এটাই হয়তো সবচেয়ে প্রিয় হবে। 

লিওনেল মেসির সঙ্গে যেমন নাম্বার টেন আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে ‘সেভেন’ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, ক্রিকেটে জার্সি নাম্বার ফুটবলের মতো এত গুরুত্ববহ না হলেও ‘সেভেনটি ফাইভ’-ও এক রকম প্রতীকই হয়ে গেছে সাকিব আল হাসানের। ‘CR7’-এর মতো ‘SAH75’-ও বাণিজ্যের বাহন হয়ে গেছে এরই মধ্যে।

তাহলে হঠাৎ ‘৯৬’ সাকিবের প্রিয় সংখ্যা কি না, এই প্রশ্ন মনে জাগল কেন?

জাগল একটু আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সাকিবের ম্যাচ উইনিং অপরাজিত ৯৬ রানের ইনিংসটা দেখে। ২০১৯ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের পর আবার স্বরূপে ফেরায় এই ইনিংসের বাড়তি গুরুত্ব আছে। যদিও বিশ্বকাপের পর কালকের আগ পর্যন্ত ওয়ানডেতে সাকিবই খেলেছেনই মাত্র ৭টি ইনিংস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচে একটা হাফ সেঞ্চুরিও (৫১) আছে, এর আগের ম্যাচেই অপরাজিত ৪৩। ব্যর্থ বললে শুধু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজটাই। যাতে তিন ম্যাচে সাকিবের রান মোট ১৯, যার ১৫-ই আবার এক ইনিংসে।

১৫, ০ ও ৪ রানের সেই সিরিজের পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ১৯ রানে আউট হয়ে যাওয়ায় ব্যাটসম্যান সাকিবকে নিয়ে একটা হায়-হায় রব উঠে গিয়েছিল। তা শুধু রান কম করেছেন বলে নয়, নেমেই যেভাবে উন্মাতাল ব্যাট চালাতে শুরু করেছিলেন, সে কারণেও। আক্রমণকেই প্রতিরক্ষার সেরা উপায় ভাবাটা যখন ফলপ্রসূ হয়, তখন তা দেখতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু ব্যর্থ হলে তা আবার খুব চোখেও লাগে। প্রথম ম্যাচে সাকিবের ব্যাটিং দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, রানে নেই বলে তিনি একটা ফাটকা খেলছেন।

তাতে কাজ হয়নি বলেই হয়তো আজ দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তাঁর অনেক স্থিতধী রূপ। সাইফউদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাচটা বের করে নিয়ে এসেছেন, তাতে প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে হওয়ার পরও ইনিংসটা ‘স্পেশাল’ হয়ে থাকছে। 

সাকিব আজকের অপরাজিত ৯৬ যেমন মনে রাখবেন, নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, মনে রেখেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগের তিনটি ৯৬-ও। কারণ আজকের ৯৬-এর মতো আগের তিনটি ৯৬-ও যে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।

ম্যাচের শেষ দিকে ‘১০’-এর একটা খেলা হলো। বাংলাদেশের জয়ের জন্য ১০ রান দরকার, ওয়ানডেতে সাকিবের ১০ নম্বর সেঞ্চুরির জন্যও ১০ রান। স্বাভাবিক নিয়মে সেই সেঞ্চুরি হওয়ার কথা নয়। হলোও না। জয়সূচক বাউন্ডারিতে  ৯৬ পর্যন্ত যেতে পারলেন। হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময় সাকিবের নামের পাশে ‘৯৬’ দেখেই তাঁর ক্যারিয়ারের আরও তিনটি ‘৯৬’-এর কথা মনে পড়ে গেল। তিনটিই টেস্ট ম্যাচে। ৯৬ সাকিবের প্রিয় সংখ্যা কি না, এই প্রশ্নটা মনে জেগে ওঠার কারণও এটাই। এমনিতে ‘৯৬’ কোনো ব্যাটসম্যানের প্রিয় সংখ্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার থেকে একটা মাত্র বাউন্ডারি দূরত্বে থেমে যাওয়া কোন ব্যাটসম্যান মনে রাখতে চাইবেন?

কিন্তু সাকিব আজকের অপরাজিত ৯৬ যেমন মনে রাখবেন, নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, মনে রেখেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগের তিনটি ৯৬-ও। আজকের ৯৬-এর মতো আগের তিনটি ৯৬-ও যে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। একটু ঘুরিয়ে বললে, সাকিবের ব্যাটে ৯৬ রান মানেই তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ! দল না জিতলেও, এমনকি বড় ব্যবধানে হারলেও।

ছক্কা মেরে টেস্ট ও সিরিজ জয়। ৪ রানের জন্য সেঞ্চুরি না পাওয়ার দুঃখের কোনো জায়গা আছে নাকি! গ্রেনাডা, ২০০৯। ছবি: এএফপি

চারটি ৯৬-এর মধ্যে দুটিতে তিনি অপরাজিত। সেই দুটিতেই বাংলাদেশ জিতেছে। সর্বশেষ অপরাজিত ৯৬-এর স্মৃতি তো একেবারেই টাটকা। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। এর আগে যে একটাই অপরাজিত ৯৬, তা প্রায় এক যুগ আগে। তারপরও সেই স্মৃতি সাকিবের মনে চিরদিনই ‘চিরসবুজ’ হয়ে থাকবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরে মাশরাফির ইনজুরির কারণে হঠাৎ ক্যাপ্টেনসি পেয়ে সেন্ট ভিনসেন্টে সিরিজের প্রথম টেস্টেও জয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন। তবে রেকর্ড বইয়ে সেই টেস্টের অধিনায়ক হিসেবে লেখা আছে মাশরাফির নামই। বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে সাকিবের আনুষ্ঠানিক অভিষেক গ্রেনাডায় সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে। যেটিতে জিতে দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র টেস্ট সিরিজ জয়। সেই জয় এসেছিল সাকিবের ছক্কাতে। ওই ছক্কাতেই অপরাজিত ৯৬, যে কারণে সেঞ্চুরি না পাওয়ার কষ্ট সাকিবকে একটুও ছুঁতে পারেনি। আজও যেমন সেঞ্চুরি না পাওয়ায় তাঁর কোনো আক্ষেপ থাকার কথা নয়।

এর আগে ও পরের দুটি ৯৬-এ যা ছিল। প্রথমটিতে একটু বেশিই। কারণ তখনো সাকিবের টেস্টে কোনো সেঞ্চুরি নেই। ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুরে সেই প্রথম ৯৬। বাংলাদেশ ১০৭ রানের বড় ব্যবধানে হারার পরও যাতে সাকিব ম্যাচ-সেরা। শ্রীলঙ্কা ৫২১ রানের অসম্ভব এক লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের সামনে। কিন্তু প্রথমে আশরাফুলের সেঞ্চুরি ও পরে সাকিবের ওই ৯৬ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার অবাস্তব একটা সম্ভাবনাও জাগিয়ে তুলেছিল দূর আকাশে। সাকিবকে ৯৬ রানে বোল্ড করার করার পর শ্রীলঙ্কান পেসার ধাম্মিকা প্রসাদ যে দৌড়টা দিয়েছিলেন, তাঁর পিছু পিছু  শ্রীলঙ্কার বাকি খেলোয়াড়েরাও, সেই দৃশ্যটা এখনো পরিষ্কার চোখে ভাসে। কারণ অমন দৃশ্য ফুটবলে গোল করার পর নিয়মিতই দেখা যায়, ক্রিকেটে কোনো বোলার উইকেট পাওয়ার পর কালেভদ্রে।

এই ৯৬-এ দুঃখটা একটু বেশিই ছিল। বাংলাদেশ অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন দেখছিল, তখনো কোনো টেস্ট সেঞ্চুরিও ছিল না সাকিবের। ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুরে সাকিবের প্রথম ৯৬। ছবি: এএফপি

সাকিবের ম্যাচ-সেরা হওয়ায় অবশ্য ওই ৯৬ রানের সঙ্গে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৬ উইকেটেরও (৫+১) ভূমিকা ছিল। দুই বছর পর মিরপুরেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিবের আরেকটা ৯৬। এর কিছুদিন আগেই নিউজিল্যান্ড ট্যুরে টেস্টে প্রথম সেঞ্চুরি পেয়ে গেছেন বলে সেঞ্চুরি হারানোর দুঃখটা হয়তো এতে একটু কম ছিল। তবে কে জানে, সেঞ্চুরি তো সেঞ্চুরিই। ২০/২৫টা করে ফেলার পরও হয়তো ৯৬ রানে আউট হওয়ার দুঃখ খুব একটা কমে না।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল ৯ উইকেটে। অ্যালিস্টার কুক অপরাজিত সেঞ্চুরি করেছেন। প্রথম ইনিংসে ইয়ান বেল ১৩৮। তারপরও এত বড় ব্যবধানে পরাজিত দলের কারও ম্যাচ-সেরা হওয়াটা একটু বিস্ময়কর মনে হচ্ছে না?

২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরে ৯৬-এর আরেকটি ইনিংস খেলার পথে সাকিব। ছবি: এএফপি

তা আর হবে না, যখন জানবেন, শুধু দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৬ রানই ওই টেস্টে সাকিবের একমাত্র কীর্তি ছিল না। প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ব্যাট হাতে করেছিলেন ৪৯ রান আর বল হাতে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। তারপরও বড় ভূমিকা রেখেছিল তো ওই ৯৬-ই।

সাকিবের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে চারটি ৯৬-এর বৃত্তান্ত জানার পর এখন আপনারও কি মনে হচ্ছে না, এই সংখ্যাটা সাকিবের প্রিয় হলেও হতে পারে!

আউট হয়ে যান বা অপরাজিত–৯৬ রান মানেই যে সাকিবের হাতে ম্যাচ-সেরার ট্রফি!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×