২০ রান করেও যেভাবে তামিমের `হাফ সেঞ্চুরি`!
উৎপল শুভ্র
১৯ জুলাই ২০২১
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তামিম ইকবাল করেছেন ২০ রান। তাহলে তাঁর হাফ সেঞ্চুরি করার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে? কেন, ফিল্ডিংয়ের সময় যে ক্যাচটা নিয়ে মাদেভেরেকে ফিরিয়ে দিলেন, তা কত রান বাঁচাল, সেটিকে হিসাবে ধরবেন না?
প্রথম ওয়ানডেতে শূন্য রানে আউট হয়েছেন। দ্বিতীয় ম্যাচে কত করলেন তামিম ইকবাল? ২০ বলবেন তো?
আমি বলব, ‘হাফ সেঞ্চুরি’ করেছেন বাংলাদেশ-অধিনায়ক।
অবাক হচ্ছেন? হওয়ারই কথা। ২০ রানে আউট হয়ে যাওয়ার পরও তামিম ‘হাফ সেঞ্চুরি’ করেন কিভাবে?
ব্যাটসম্যান তামিম ২০-ই করেছেন, বাকি ৩০ রান করেছেন ফিল্ডার তামিম।
৪৫তম ওভারে যে ক্যাচটা নিয়ে ওয়েসলি মাদেভেরেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাতে জিম্বাবুয়ের স্কোরটা নিশ্চিতভাবেই ২৫-৩০ রান কম হয়েছে। কে জানে, সেট হয়ে যাওয়া মাদেভেরে যেমন খেলছিলেন, তাতে রানসংখ্যাটা আরও বেশিও হতে পারত। ওই রানটা তামিমের ঘরে যোগ হওয়া উচিত নয়, বলেন?
ক্রিকেটে এভাবে হিসাব হয় না, আমি জানি। তারপরও এভাবে ভাবছি, তামিমকে নিয়ে একটা বিস্ময়ের কথা বলতে। সেই বিস্ময় তামিমের ফিটনেস ও ফিল্ডিং নিয়ে। ভালো ফিল্ডার বললে যে ক্ষিপ্রতা, অনুমানক্ষমতা এবং অ্যাথলেটিসিজম বোঝায়, তামিমের মধ্যে নেই। কখনোই ছিল না। এমনকি ১৭ বছরের চনমনে বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের সময়ও না। বরং ফিল্ডার তামিম তখন একটু বিরক্তিই জাগাত মনে। এত অল্প বয়সী একটা ছেলে, কোথায় উড়ে উড়ে ফিল্ডিং করবে, তা না, নড়তে চড়তেই যেন রাজ্যের আলস্য।
সেই তামিম যেভাবে নিজেকে বদলে ফেলেছেন, বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে তা আদর্শ বলে বিবেচিত হতে পারে। এখনো বাংলাদেশের সেরা ফিল্ডার হিসেবে তাঁর নাম বলবে না কেউই। কিন্তু আগের তামিমের কথা মনে রাখলে এই তামিমকেই অনেক ভালো বলে মানতে হবে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, অলরাউন্ড ফিল্ডার হিসেবে দুর্দান্ত না হয়েও দারুণ সব ক্যাচ নেওয়ার ক্ষমতা। লং অফ থেকে অনেকটা সামনে দৌড়ে ডাইভ দিয়ে ধরা আজকের ক্যাচটা দেখে নিশ্চয়ই আউটফিল্ডে তামিমের এমন আরও অনেক ক্যাচের ছবি ভেসে উঠছে আপনার চোখেও।
মজাটা এখানেই। তামিম অবশ্যই বাংলাদেশের সেরা ফিল্ডারদের একজন নন, তবে গত আট/দশ বছরে আউটফিল্ডে বাংলাদেশের ফিল্ডারদের নেওয়া সেরা ক্যাচের একটা তালিকা করতে বসলে দেখবেন, তাতে বারবারই আসছেন তামিম ইকবাল। এর রহস্যটা কোথায় লুকিয়ে ফিটনেস নিয়ে সচেতনতায়। ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ/ছয় বছর যা একেবারেই ছিল না।
যে জিম্বাবুয়ে সফরে তামিমের একটা ক্যাচ দেখে এসব কথা লিখতে লিখতে দশ বছর আগে এই জিম্বাবুয়েতেই বাংলাদেশের আরেকটি সফরের কথা মনে পড়ছে। মিড অফ/মিড অনে দাঁড়ানো তামিমের দিকে বল ঠেলে দিয়ে অনায়াসে রান নিয়ে নিচ্ছেন জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যানরা। ব্যাটিংয়ের সময়ও তাঁর গদাই লস্করি চালের রানিং বিটুইন দ্য উইকেট রীতিমতো দৃষ্টিকটু লাগছে। সেই সিরিজ শেষে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের রেটিং করার সময় লেখাতে যা উল্লেখ করতেই হয়েছিল। তামিমের তা ভালো লাগার কথা নয়। তা বুঝিয়ে দিতেও একদমই সময় নেননি। জিম্বাবুয়ে থেকে ফেরার পথে দোহা এয়ারপোর্টে যাত্রা বিরতির সময় দেখা হতেই মুখে ব্যঙ্গের হাসি এনে বলেছিলেন, ‘স্যার, প্লিজ নাম্বারটা একটু বাড়িয়ে দিন না!’
ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের পর্যালোচনা করে ১০-এর মধ্যে নাম্বারিংও করেছিলাম, সেটির দিকে ইঙ্গিত করেই তামিমের ওই ব্যঙ্গ। আমার পাথুরে মুখ দেখে তামিম আর বেশি কথা বাড়াননি।
তামিমের সমস্যাটা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। তামিম তখনো খেলা নিয়ে পরিশ্রম করতেন না, এমন নয়। কিন্তু তখন তামিমের কাছে প্র্যাকটিস মানেই ছিল নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটিং করা। শরীরটা ঠিক না থাকলে যে তা পুরো কাজে আসবে না, এই উপলব্ধিটা আসতে তাঁর সময় লেগেছে। মাঝখানে ওজন এমন বেড়ে গিয়েছিল যে যত না বোলার, তার চেয়ে বেশি ক্লান্তিই তাঁর উইকেট নিয়ে নিচ্ছিল।
ব্যাপারটা চরমে পৌছাল সম্ভবত ২০১৩ সালের দিকে। ঘটনাচক্রেই যেটির দালিলিক প্রমাণ পেয়েছিলাম বাংলাদেশ দলের শ্রীলঙ্কা সফরে। টেস্ট ম্যাচের সকালে টিম হোটেলে জিম করতে গেছি। ওয়াশরুমে একটা ক্লিপে আটকানো একটা কাগজ দেখে কৌতূহল হলো। ক্রিকেটারদের হাইড্রেশন টেস্টের রিপোর্ট। যাতে তাঁদের ওজনও লেখা আছে। তামিমের নামের পাশে ‘৯৩ কেজি' দেখে তো আমি হতবাক।
সেই রাতেই তাজ সমুদ্র হোটেলের বিলিয়ার্ড রুমে তামিমের সঙ্গে দেখা। সকালে তাঁর বর্তমান ওজন জানার পর থেকেই মনটা একটু খারাপ হয়ে ছিল। সেটি গোপন রেখেই আমি তামিমকে বললাম, ‘এক সময় আপনি বিশ্বসেরাদের একজন হওয়ার যে স্বপ্ন দেখতেন, সেটি তো হারিয়ে ফেলেছেন।'
আমার কথাটা যে তামিমের মনে খুব লেগেছে, তাঁর মুখ দেখেই তা বুঝতে পারলাম। থমথমে মুখে বললেন, 'এটা আপনার কেন মনে হলো? আমি এখনো তা হতে চাই।'
আমি বললাম, ‘সেটা তো সবাই চায়। ইংরেজিতে "উইশ" আর "ডিজায়ার" বলে দুটি শব্দ আছে। একটা হলো চাওয়া আর একটা মনেপ্রাণে জীবন দিয়ে চাওয়া। আপনার এখন যা আছে, সেটি উইশ, ডিজায়ার নয়। তামিম আরও গম্ভীর, 'আপনার এমন মনে হলো কেন?’
তাঁর ওজন এত বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটা তুলতেই হলো, 'এই ফিটনেস নিয়ে আপনি বড় কিছু কীভাবে করবেন?'
তাঁর উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কত হওয়া উচিত—এ নিয়ে কিছুক্ষণ তর্ক করে একসময় তামিম চুপ হয়ে গেলেন। আরও বেশ কিছুক্ষণ সেখানে থাকলেও আর কোনো কথা বলেননি। বললেন সেই সফরেই ওয়ানডেতে প্রায় তিন বছর পর সেঞ্চুরি করার পর। ম্যাচ রিপোর্ট লেখার চাপে আমি সেই সংবাদ সম্মেলনে যেতে পারিনি। সেই রাতে বিলিয়ার্ড রুমে উপস্থিত বন্ধু সাংবাদিক ফিরে এসে বললেন, 'তামিম তো আপনার কথা বলল। বলল, আপনাদেরই একজন কদিন আগে আমার বিশ্বসেরাদের একজন হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। ওই কথাটা আমাকে ইনস্পায়ার করেছে।'
এরও তিন বছর পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের পর তামিমের ইন্টারভিউ করছি। তাঁর বদলে যাওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তামিম হঠাৎই বললেন, 'আপনাকেও আমার একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।'
আমি অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, 'কেন, আমি আবার কী করলাম?'
তামিম কলম্বোর সেই রাতের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সত্যি বলছি, আপনার কথাটা সেদিন একটুও ভালো লাগেনি। খুব গায়ে লেগেছিল। আমি খুব ইমোশনাল ছেলে আর কথাটা ছিল আঘাত পাওয়ার মতোই। আপনার সঙ্গে তর্কও করেছিলাম। পরে আপনার কথাটা নিয়ে ভেবেছি। এখন স্বীকার করছি, আমার ওই ধাক্কাটা দরকার ছিল। ওটা আমার অনেক কাজে এসেছে। আমি হয়তো তখন ফিফটি করেই সন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম।'
ফিটনেসের জন্য শুধু শারীরিক পরিশ্রমই নয়, খাদ্যাভ্যাসেও আমূল পরিবর্তন এনেছেন। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী নবাবী খাবার-দাবারের দিকে যে ঝোঁক ছিল, সেটিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছেন কবেই। দারুণ সব ক্যাচ নেওয়াতে অবশ্যই বড় ভূমিকা এসব 'ত্যাগ'-এর। তামিমের কাছ থেকে বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের অনেক কিছুই শেখার আছে। তার মধ্যে এটাও একটা।