১৭৬-এর চেয়েও `বড়` ১০২!

উৎপল শুভ্র

১৭ জুলাই ২০২১

১৭৬-এর চেয়েও `বড়` ১০২!

হারারের সেঞ্চুরিতে লিটনের ব্যাটসম্যানশিপের অন্য দিকটাও সামনে। ছবি: জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট

ওয়ানডেতে তাঁর হাফ সেঞ্চুরির চেয়ে সেঞ্চুরির সংখ্যা বেশি। এই কনভার্সন রেটে মুগ্ধ হতে গেলেই মনে পড়ে যায়, লিটন দাসের প্রায় ৪২ শতাংশ ইনিংসই এক অঙ্কের। চার সেঞ্চুরির মধ্যে রানসংখ্যায় সবচেয়ে কম হারারের সেঞ্চুরিটাই কি টার্নিং পয়েন্ট হতে যাচ্ছে লিটনের ক্যারিয়ারের? এটিকে যে তাঁর চার সেঞ্চুরির মধ্যে সবচেয়ে বড় মনে হচ্ছে, এমনকি ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১৭৬ রানের চেয়েও!

একজন ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ার রেকর্ড ঘাঁটতে গিয়ে দেখলেন, ওয়ানডেতে তাঁর ৩টি হাফ সেঞ্চুরি আর ৪টি সেঞ্চুরি। ওই ব্যাটসম্যানের ইনিংস বড় করার ক্ষমতার প্রতি আপনার শ্রদ্ধা জাগতে বাধ্য। এর অর্থ তো পঞ্চাশ ছোঁয়া সাতটি ইনিংসের চারটিকেই সেঞ্চুরিতে রূপ দিয়েছেন ওই ব্যাটসম্যান। হাফ সেঞ্চুরির চেয়ে সেঞ্চুরি বেশি! কী দুর্দান্ত কনভার্সন রেট!

ছবি আর লেখার ভূমিকাই ব্যাটসম্যানের নাম বলে দিচ্ছে বলে নাটকীয়তা তৈরির চেষ্টা মাঠে মারা যেতে বাধ্য। সেটি আর তাই করছি না। বুঝতেই তো পারছেন, কার কথা হচ্ছে। ভাবসম্প্রসারণের ভাষায়–আলোচ্য ব্যাটসম্যানের নাম লিটন কুমার দাস। ৪৫ ম্যাচ শেষে যাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ার-রেকর্ড আসলেই একটু বিস্ময় জাগাতে বাধ্য।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে লিটনের সেঞ্চুরির পর তাঁর ৪৫টি ইনিংসের স্কোরিং প্যাটার্নটা একটু ঘেঁটে দেখলাম। দেখে যা পেলাম, তা একটু ব্যতিক্রমীই। ইনিংসের শুরুতে সব ব্যাটসম্যানই একটু নড়বড়ে থাকে, কিন্তু লিটন একটু বেশিই। শূন্য রানে আউট হয়েছেন সাতবার। শূন্য থেকে ৯– এক অঙ্কের রানে মোট ১৯ বার। 

তার মানে মোট ইনিংসের প্রায় অর্ধেক। একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে বললে ৪২ শতাংশেরও বেশি ইনিংসে লিটনের দুই অঙ্ক ছোঁয়া হয়নি। যার মানে এটাও যে, ইনিংসের শুরুতেই লিটন আউট হয়ে ফিরে আসছেন, এই দৃশ্য দেখতে দেখতে তা সবার মনে প্রায় গেঁথে গেছে।

এ কারণেই ব্যাটসম্যান হিসেবে এমন অমিত প্রতিভাবান হওয়ার পরও, তাঁর ব্যাটিং দৃষ্টির জন্য এমন প্রশান্তি হওয়ার পরও, বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ইনিংস খেলার রেকর্ডটি তাঁর হওয়ার পরও লিটনকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। শেষটাই বেশি, মানে সমালোচনা। এমন একটা সেঞ্চুরিও যা পুরো থামাতে ব্যর্থ দেখে একটু বিস্মিতই হয়েছি।

এমন একটা সেঞ্চুরি মানে কেমন সেঞ্চুরি? আমি তো বলব, লিটনের চার সেঞ্চুরির মধ্যে সেরা। অবাক হচ্ছেন জানি। লিটনের প্রথম দুটি সেঞ্চুরি যেখানে ১২১ ও অপরাজিত ১২৬ রানের; সর্বশেষটি ওই রেকর্ড ১৭৬, আর আমি কি না সেরা বলছি এই ১০২-কে! মাথা-টাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো! 

না, ভাই, মাথা ঠিকই আছে। তা না থাকলে লিটনের আগের সেঞ্চুরিগুলো কীভাবে বলে দিলাম! রান-সংখ্যায় সবচেয়ে কম, কিন্তু অন্য অনেক বিবেচনায় হারারের এই সেঞ্চুরির মহিমা সবচেয়ে বেশি। এতটাই যে, কেন যেন মনে হচ্ছে, এই সেঞ্চুরিই লিটনের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াতে পারে।

হারারেতে সেঞ্চুরি করার পর লিটন দাস। ছবি: জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট

কেন এমন মনে হচ্ছে, সেটির ব্যাখ্যা তো দিতেই হবে। এর আগে লিটনের আগের তিনটি সেঞ্চুরিতে একটু ঘুরে আসি। প্রথমটি ২০১৮ সালে এশিয়া কাপ ফাইনালে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ, তার ওপর ফাইনাল! দুবাইয়ে লিটনের ওই ইনিংস খেলার সময় ভারতীয় সাংবাদিকদের বিস্ময়াভূত চোখমুখ এখনো মনে পড়ে। প্রায় তিন বছর আগে ফতুল্লায় ভারতের বিপক্ষে লিটনের টেস্ট অভিষেকে হার্শা ভোগলের চোখেমুখেও যে মুগ্ধতামিশ্রিত বিস্ময় দেখেছিলাম। মাত্র ৪৪ রানই করেছিলেন লিটন, তবে তা ৪৫ বলে। ৮ চার ও ১ ছয়ে ৩২ রানই বাউন্ডারি থেকে। কিন্তু রান-বল-চার-ছয়ের এই  যেমন মারকাটারি ব্যাটিং বোঝায়, লিটনের ইনিংসটা দেখতে মোটেই অমন ছিল না। কারণ ওই লাবণ্যময় স্ট্রোক-প্লে। অনায়াস স্ট্রোক খেলার যে সৌন্দর্য লিটনের ব্যাটিংকে বাকি সবার থেকে আলাদা করে দেয়, সেটিই এত ক্রিকেট দেখা হার্শা ভোগলেকেও স্পর্শ করেছিল। কমেন্ট্রিতে তো তা বলেছিলেনই, পরে দেখা হওয়ার পরও।

এশিয়া কাপ ফাইনালের সেঞ্চুরিটি ম্যাচ উইনিং হতে হতে হয়নি, এতে লিটনের কোনো দায় নেই। পরের দুটি সেঞ্চুরিই তা হয়েছে। সেই দুই সেঞ্চুরি তিন ম্যাচের মধ্যে। গত বছর মার্চে বাংলাদেশ সফরে আসা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। শেষটা আবার অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার বিদায়ী ম্যাচে। সিলেটে লিটনের ওই ইনিংসটি ছিল যেন অধিনায়ককে দেওয়া তাঁর বিদায়-অর্ঘ্য। ১৪৩ বলে ১৭৬ রানের ইনিংসটি খেলার সময় মনে হচ্ছিল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নয়, যেন পাড়ার ক্রিকেট খেলছেন লিটন। টি-টোয়েন্টির এই যুগে অন্য দেশের অনেক ব্যাটসম্যানকেই আমরা এমন চার-ছয়ের বন্যা বইয়ে দিতে দেখি। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান এমন খেয়াল খুশিমতো চার-ছয় মারছেন এবং মেরেই যাচ্ছেন, এই দৃশ্য তো খুব সহজদৃষ্ট নয়।

বৃষ্টির কারণে ওই ম্যাচটায় বাংলাদেশ ইনিংস মাঝখানে থেমে গিয়ে ৪৩ ওভারে সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারপরও প্রবল সম্ভাবনা ছিল লিটনের ডাবল সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার। ১৭৬ তো ইনিংসের ১৪ বল বাকি থাকতেই। যার শেষ ৭৬ রান মাত্র ২৯ বলে, যার ৬০-ই চার-ছয়ে (৮টি ছয় ও ৩টি চার)।

সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রেকর্ড ১৭৬ রানের ইনিংস খেলার পথে সেঞ্চুরিতে পৌঁছানোর পর। মার্চ, ২০২০। ছবি: এএফপি

ওই সেঞ্চুরি মাঠে বসে দেখার পরও টেলিভিশনে দেখা হারারের ১০২-কে এগিয়ে রাখাটা আপনার মনে প্রশ্ন তুলতেই পারে। রাখছি একাধিক কারণে। উইকেটের বিবেচনায়, ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায়, লিটনের নিজের ওপর চাপ বিবেচনায়। সিলেটে লিটনের ওপেনিং পার্টনার তামিম ইকবালও অন্য প্রান্তে ভালোই চালাচ্ছিলেন। আগের দুই ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ সিরিজ জিতে গেছে বলে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চাপের কোনো বালাই ছিল না, এক ম্যাচ আগেই সেঞ্চুরি করেছেন বলে ব্যক্তিগত কোনো চাপও নয়। এশিয়া কাপ ফাইনালে দুবাইয়ের উইকেট আর পরের দুই সেঞ্চুরির সিলেটের উইকেটও ছিল ব্যাটসম্যানদের জন্য মৃগয়াক্ষেত্র।

উদযাপনও কেমন নিরাবেগ! লিটনের সব কিছুই একটু অন্যরকম! ছবি: জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটআর হারারেতে বল বাউন্স করছে, মুভ করছে...ওপেনিং পার্টনার তামিম ইকবালকে ইনিংসের ১৩তম বলে যখন আউট হয়ে যেতে দেখছেন, স্কোরবোর্ডে রানের ঘরে তখনো শূন্য। সেখানে ৭৪ তুলতেই ৪ উইকেট নেই। এটা তো ছিল দলীয় চাপ। এর সঙ্গে লিটনের একান্তই ব্যক্তিগত চাপটাও যোগ করে নিন। রেকর্ড ভাঙা ওই ১৭৬ রানের পর ৮ ইনিংসে করেছেন মোট ১০১ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যর্থ দুই সিরিজের পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচে তো বাদই পড়ে গেছেন। এক ম্যাচ পরই আবার ফিরেছেন দলে, তাতে কি! হারারের প্রথম ওয়ানডে তো লিটনের প্রত্যাবর্তন-ম্যাচই। এই নানামুখী চাপ সামলে লিটন যে ইনিংসটা খেললেন, সেটি তাঁর ব্যাটসম্যানশিপের অন্য একটা দিক সামনে নিয়ে আসছে। যেটির অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় ছিল অনেকের। 

সেটি কী? শুধুই সহজাত প্রবৃত্তিচালিত না হয়ে উইকেট এবং পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী ব্যাটিং। এই উইকেট একটু পুরোনো যুগের ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ দাবি করছিল। শুরুতে রয়ে সয়ে খেলো, পরে তা পুষিয়ে দেওয়ার সময় পাবে। তামিম ও সাকিব কেউই তা বুঝতে চাননি। লিটন বুঝেছেন বলেই ৭৮ বলে আসা হাফ সেঞ্চুরিতে মাত্র ৩টি চার। দ্বিতীয় ফিফটি ৩৯ বলেই, তাতেও চার মাত্র ৫টি। আগের তিনটি সেঞ্চুরিই যেখানে চার-ছয়ের ওপর দাঁড়িয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বিশ্বকাপে তাঁর প্রথম ম্যাচে প্রায় সেঞ্চুরিটিও (ওই প্রমত্ত ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে ৮ চার ও ৪ ছয়ে ৬৯ বলে অপরাজিত ৯৪), এখানে লিটন পাড়ানির কড়ি মেনেছেন খুচরো রানকে। এই পরিণতিবোধের কারণেই সেঞ্চুরিটাতে আলাদা মহিমা যোগ হয়ে যাচ্ছে। আরেকটু ধারাবাহিক লিটনের দেখা পাওয়ার যে প্রত্যাশা সবার, যা না মেটায় ক্ষোভও, সেই প্রত্যাশা পূরণের পথে যাত্রা শুরুও হতে পারে এই ইনিংস দিয়ে।

সেই প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে, না-ও পারে। আপাতত লিটনের উদ্দেশে একটা করতালি তো আমরা দিতেই পারি! বিরুদ্ধ কন্ডিশনে, বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে এমন একটা সেঞ্চুরি করার পরও অতীতে কবে কোথায় ব্যর্থ হয়েছেন, সেটি মনে রেখে তাঁকে অভিনন্দন না জানানোটা বড় অন্যায় হবে।

অভিনন্দন লিটন!

আরও পড়ুন:
ট্রল পরিমাণ প্রশংসা পাচ্ছেন তো লিটন?

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×