সাকিবের মাথায় আবার ত্রিমুকুট
উৎপল শুভ্র
১৭ জুলাই ২০২১
এর আগেও একবার এই ত্রিমুকুট উঠেছিল সাকিব আল হাসানের মাথায়। বেশি দিন তা থাকেনি। আজ ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডটা নিজের করে নিয়ে আবার সেই ত্রিমুকুট মাথায় তুললেন। টেস্ট, টি-টোয়েন্টির মতো ওয়ানডেতেও বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেট তাঁর। নিকট ভবিষ্যতে যার কোনোটাই কেড়ে নেওয়ার সাধ্য নেই কারও।
সাকিব আল হাসানের বোলিংয়ে দেখার কিছু নেই। আবার দেখার অনেক কিছু আছেও। ‘অনেক কিছু’ অবশ্য একটু বেশি বলা হয়ে গেল। দেখার আসলে একটাই। যা আসলে দেখা যায় না। ক্ষুরধার ক্রিকেট-মস্তিষ্ক।
তাঁর বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানকে ফাঁদে ফেলতে বাঁহাতের আঙুলের কারসাজি যতটা আছে, যতটা ফ্লাইটের খেলা; তার চেয়ে বেশি মস্তিষ্ক। সাকিবের প্রতিটা বলের পেছনে আমি সেই অদৃশ্য ক্রিকেট-মস্তিষ্ককে দেখি। যা খুব দ্রুতই উইকেট বুঝে ফেলে। বুঝে ফেলে ব্যাটসম্যানদের শক্তি-দুর্বলতা। আজ হারারাতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে আবার যা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম।
সাকিবের বোলিংয়ের ক্ষেত্রে এই ‘মুগ্ধ’ শব্দটারও একটু ব্যাখ্যা লাগছে। বিষেণ সিং বেদি সারা জীবন বলেছেন, এখনো বলেন, ফ্লাইটে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করতে না পারলে আর কিসের স্পিনার! বোলিং অ্যাকশন থেকে শুরু করে বলে ফ্লাইটের বৈচিত্র্য...বেদিকে দেখে মুগ্ধ অনেক চোখ বলেছে, ‘পোয়েট্রি ইন মোশন’। বাংলাটা কি হবে.. ‘চলমান কবিতা’?
সাকিবের বোলিং দেখে কারও মাথায় কবিতা-টবিতা আসার প্রশ্নই আসে না। বেদিরা টেস্ট যুগের বোলার। সাকিবরা ওয়ানডে খেলে খেলে বড় হতে হতেই এসে গেছে টি-টোয়েন্টি। সাকিবদের কাছে স্পিন বোলিংয়ের ব্যাকরণটা তাই একেবারেই আলাদা। তা মুগ্ধতা ছড়াবে না। কিন্তু আপনার মনে সম্ভ্রম জাগাবে। ক্রিকেট-মস্তিষ্কের প্রতি সম্ভ্রম, লাইন-লেংথের ওপর অসম্ভব নিয়ন্ত্রণের প্রতি সম্ভ্রম।
বোলিংয়ে কারও চোখে মুগ্ধতার মায়াঞ্জন না বুলিয়েই সাকিব তাই পা দিয়ে ফেলেন নতুন আরেকটি শৃঙ্গে। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেট তাঁর আগে থেকেই ছিল। ওয়ানডেতেও সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক হয়ে সাকিবের এখন ‘ট্রিপল ট্রিপল’! বাংলায় বলা যায়, সাকিবের মাথায় এখন ত্রিমুকুট।
যেভাবে তা এলো, সেটিই আসলে বোলার সাকিবকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আদর্শ এক ডকুমেন্টারি। হারারে স্পোর্টস ক্লাবের উইকেট চিরকালের পেসার-বান্ধব। বাউন্স আছে, মুভমেন্ট আছে; কিন্তু স্পিনারদের জন্য বলতে গেলে কিছুই নেই। আজ মেঘলা আকাশ আর ১৭-১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা মিলে পেসারদের আরও পোয়াবারো। সেই উইকেটেই সাকিবের ৩০ রানে ৫ উইকেট! এই ৫ উইকেট যতটা না তাঁর আঙুলের কৃতিত্ব, তার চেয়ে বেশি ওই অদৃশ্য বস্তুটার। ক্রিকেট-মস্তিষ্ক।
আর্মার বরাবরই তাঁর বড় অস্ত্র। সেই আর্মারের জবাব জিম্বাবুইয়ানদের ব্যাটসম্যানদের কাছে ছিল না। সঙ্গে গতির বৈচিত্র্য। ১০ ওভারের কোটার একটা বল বাকি ছিল। ফিল্ডিংয়ের সময় চোট পাওয়ায় জিম্বাবুয়ের টিমিসেন মারুমা ব্যাটিং করতে পারেননি, নইলে কে জানে, ওয়ানডেতে প্রথম ৬ উইকেটও হয়ে যেতে পারত। এর আগে ওয়ানডেতে দুবার ৫ উইকেট নিয়েছেন। প্রথমবার এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই মিরপুরে ৪৭ রান খরচে। ২০১৫ সালে। দ্বিতীয়বার ২৯ রানে আফগানিস্তানের বিপক্ষে গত বিশ্বকাপে সাউদাম্পটনে। মাত্র ১ রান বেশি দিয়ে ফেলায় আজ যা ছুঁতে পারলেন না সাকিব।
যে ‘ট্রিপল ট্রিপল’ বা ত্রিমুকুটের কথা বলছিলাম, সেটির স্বাদ কিন্তু সাকিব এই প্রথম পেলেন, এমন নয়। ২০১৬ সালেও তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার এই ‘ট্রিপল ট্রিপল’ হয়েছিল। সেবারও আগে থেকেই অধিকারে থাকা টেস্ট আর টি টোয়েন্টি রেকর্ডের সঙ্গে ওয়ানডেরটা যোগ করেছিলেন আবদুর রাজ্জাকের ২০৭ উইকেটের রেকর্ড ভেঙে।
বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডেতে প্রথম ২০০ উইকেট রাজ্জাকের। সাকিব দ্বিতীয়, মাশরাফি তৃতীয়। দুজনের ২০০তম উইকেট অবশ্য একই ম্যাচে। ২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। পরে ওয়ানডে-উইকেটে মাশরাফি ছাড়িয়ে যান সাকিবকে। মাশরাফির ক্যারিয়ার অলিখিতভাবে শেষ। নিকট ভবিষ্যতে সাকিবের তাই এই ত্রিমুকুটের কোনো একটা হারিয়ে ফেলার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এই ম্যাচে সাকিবের সতীর্থদের মধ্যে কারও তো ওয়ানডেতে এক শ উইকেটই হয়নি (নিকটতম মাহমুদউল্লাহর ৭৬ উইকেট, মিরাজের ৫৪, তাসকিনের ৫৩)। এক শর বেশি উইকেট পাওয়া দুজন অবশ্য বাইরে আছেন। রুবেলের ১২৯ উইকেট আর মোস্তাফিজের ১২৪। পার্থক্যটা অনেক। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টির হিসাবটাতে আর না-ই বা গেলাম। সেই দুটিতেও এমনই হবে।
আজ সাকিবের বোলিং দেখতে দেখতে মোহাম্মদ সালাউদ্দীনের কথা খুব মনে পড়ছিল। সাকিবের বিকেএসপি জীবনের কোচ। এখনো যেকোনো সমস্যায় পড়লে তাঁর ‘গো টু ম্যান’। সালাউদ্দীন গত ২৪ মার্চ সাকিবের জন্মদিনে তাঁর বোলিং নিয়ে উৎপলশুভ্রডটকম ওয়েবসাইটেই একটা লেখা লিখেছিলেন। খেলা দেখতে দেখতে সেই লেখাটা আবার পড়লাম। পড়তে পড়তে মনে হলো, সাকিবকে নিয়ে আমি আর নতুন কী বলব? যা বলার, সব তো বলেই দিয়েছেন সালাউদ্দীন।
সেই লেখা থেকে দুটি অংশ তুলে দিলেই বুঝতে পারবেন, কেন একথা বলছি।
বোলার সাকিব সম্পর্কে সালাউদ্দীন-১
“বোলার সাকিবকে বিশ্লেষণ করতে বললে আমি 'গড গিফটেড’' কথাটাই বলব। এ কারণে গড গিফটেড বলছি যে, ব্যাটসম্যানকে পড়ার ক্ষমতা, ব্যাটসম্যানের মুভমেন্ট কী হতে পারে, ব্যাটসম্যান কোন শট খেলতে পারে, এসব জিনিস আগে থেকেই বুঝতে পারে ও। নিজে ব্যাটসম্যান তো, সেটাও বোধ হয় সাহায্য করে। আর বোলার সাকিবের একটা গুণ যদি বিশেষ করে জানতে চাওয়া হয়, তো ওর উইকেট বুঝতে পারার ক্ষমতাকেই আমি বেছে নেব। কোন উইকেটে কতটুকু পেস দিতে হবে, কোথায় একটু টেনে বল করতে হবে, কোথায় হাওয়ায় ভাসাতে হবে, এই সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো ও খুব ভালো বুঝতে পারে। এই গুণগুলোর সমন্বয়ই ওকে আর দশজন বোলার থেকে আলাদা করে তুলেছে।"
সালাউদ্দীনের অনেক বড় লেখা থেকে দ্বিতীয় যে অংশটা তুলে দিচ্ছি, তা ওই সাকিবের বোলিং কারও চোখে মুগ্ধতার মায়াঞ্জন বুলিয়ে দেবে না বলে যে মন্তব্যটা করেছি, তার সঙ্গে খুব প্রাসঙ্গিক।
সাকিব সম্পর্কে সালাউদ্দীন-২
“ওর বোলিংটা কিন্তু খুব সিম্পল। ব্যাপারটা ও নিজেও স্বীকার করে। একবার অশ্বিনের বোলিং দেখে ওকে আমি বলতে গিয়েছিলাম, 'ওদের দেখ্, এই দুসরা মারতেছে, আন্ডারকাটার মারতেছে। আর তোর বলে তো কোনো ভ্যারিয়েশনই নাই।' জবাবে ও যা বলেছিল, শুনে আমি একদম চুপ মেরে যেতে বাধ্য হই। ও বলেছিল, 'স্যার, মানছি, আমার ভ্যারিয়েশন নাই। অত কিছুর চেষ্টাও করতে পারি না। তবে আমি যেখানে চাই, যে লেংথে চাই, সেখানেই বল ফেলতে পারি। এ জন্যই আমি নাম্বার ওয়ান বোলার।' আমার চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না, কারণ বোলারদের র্যাঙ্কিংয়ে সাকিব তখন এক নম্বরেই ছিল।”
আপনিই বলেন, সালাউদ্দীনের এই লেখার সঙ্গে আর কিই-বা যোগ করার আছে! বোলার সাকিব সম্পর্কে যোগ করার কিছু নাই। তবে অলরাউন্ডার সাকিব সম্পর্কে একটু আছে। ওয়ানডেতে ৬ হাজার রান ও ২৫০ উইকেটের যুগলবন্দি আছে সাকিব ছাড়া আর মাত্র তিনজনের। সেই তিনজনের দুজনই আবার স্পিনার: সনাৎ জয়াসুরিয়া (৪৪৫ ম্যাচে ১৩৪৩০ রান ও ৩২৩ উইকেট) ও শহীদ আফ্রিদি (৩৯৮ ম্যাচে ৮০৬৪ রান ও ৩৯৫ উইকেট)। তৃতীয়জন পেসার-অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস (৩২৮ ম্যাচে ১১৫৭৯ রান ও ২৭৩ উইকেট)। জয়াসুরিয়া ও ক্যালিসের অনেক রান, আফ্রিদির অনেক উইকেট। তবে তিনজনের খেলা ম্যাচের সংখ্যা একটু খেয়াল করতে বলি। সাকিবের ৬৪৭৪ রান ও ২৭৪ উইকেট তো 'মাত্র' ২১৩ ম্যাচে। ওই তিনজনের তুলনায় তো মাত্রই।
অলরাউন্ডার প্রসঙ্গটা আসলে তুলেছিলাম অন্য একটা কারণে। ব্যাটিংটা অনেক দিনই ভালো হচ্ছে না সাকিবের। আজও তো শুরু থেকেই ধুন্ধুমার চালাতে গিয়ে ১৯ রানেই আউট! কিন্তু অলরাউন্ডার হওয়ার সুবিধাটা দেখেন। বোলিংয়ে এসে ওই ব্যাটিং-ব্যর্থতা ঠিকই ঢেকে দিয়েছেন সাকিব। যা দেখতে দেখতে তামিম ইকবালের আফসোস হতেই পারে!