বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই প্রজন্মের মেলবন্ধন
উৎপল শুভ্র
১৬ জুলাই ২০২১
২০০৭ বিশ্বকাপের আগে মূলত বিশ্বকাপ প্রস্তুতির জন্যই বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত এক জিম্বাবুয়ে সফর। হারারেতে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ে বড় ভূমিকা অধিনায়ক হাবিবুল বাশার ও সাকিব আল হাসানের। যা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এ যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই প্রজন্মের মেলবন্ধন। দুজনের মধ্যে যে বয়সে পনের আর অভিজ্ঞতা-উচ্চাকাঙ্ক্ষায় এগার বছরের পার্থক্য।
প্রথম প্রকাশ: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। প্রথম আলো।
একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান, আরেকজন বাঁহাতি। একজন একসময় শখের অফ স্পিন করলেও অনেক দিনই একমাত্র পরিচয় স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান, অন্যজন পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার। একজনের ওয়ানডে অভিষেক ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে, অন্যজনের গত বছর আগস্টে। একজন গত আগস্টে ৩৪তম জন্মদিন পালন করলেন, অন্যজন আগামী মার্চে উনিশে পা দিচ্ছেন।
এত সব অমিলের মধ্যে একটা মিল—কাল হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে দুজনই তাদের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংসটি খেললেন। হাবিবুল বাশার ৮৭ বলে ৭৮। সাকিব-আল হাসান ৭৬ বলে ৬৮। চতুর্থ উইকেটে দুজনের ১০৫ রানের জুটি। এই জুটির কল্যাণেই শেষ ৩ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে মাত্র ১২ রান তোলার পরও বাংলাদেশের স্কোরটা জিম্বাবুয়ের নাগালের বাইরে চলে গেল। জুটির এই মাহাত্ম্য তো স্কোরকার্ডেই লেখা থাকছে। যা থাকছে না, সেটিকেই মনে হচ্ছে এর আসল তাৎপর্য। এই পার্টনারশিপটি যে বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই প্রজন্মের মেলবন্ধন।
বাংলাদেশ দলে পালাবদলের একটা হাওয়া বইছে বেশ কিছু দিন ধরেই। সেই হাওয়ায় উড়ে দল থেকে বাইরে চলে যেতে হয়েছে অনেককেই। বাংলাদেশ দলে এখন তারুণ্যের জয়জয়কার। এই প্রথম কোনো সফরে খালেদ মাসুদ না থাকায় আরও বেশি করে চোখে পড়ছে পরিবর্তনটা। কালকের ম্যাচের একাদশের কথাই ধরুন। হাবিবুল বাশার ও মোহাম্মদ রফিকের অভিষেক হয়েছিল একই সঙ্গে, ১৯৯৫ সালে শারজা এশিয়া কাপে। মোহাম্মদ আশরাফুল ও মাশরাফি বিন মুর্তজার অভিষেক ২০০১-এ। বাকি যে সাতজন, তাদের কারোর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়সই দুই-আড়াই বছরের বেশি নয়। ডেভ হোয়াটমোর-যুগেই তাঁদের সবার অভিষেক এবং অস্ট্রেলিয়ান কোচ শুধু হাবেভাবে নয়, কথাবার্তায়ও অনেকবারই বুঝিয়ে দিয়েছেন, সম্ভব হলে তিনি সংখ্যাটা আরও বাড়াতেন।
দুই প্রজন্মের মেলবন্ধন বলছিলাম, সেটি শুধুই বয়সের পার্থক্যের কারণে নয়। এরা দুজন তো বাংলাদেশের ক্রিকেটে পুরো ভিন্ন দুই যুগের প্রতিনিধিও। বেড়ে ওঠায় ভিন্ন, মানসিকতায় ভিন্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিক থেকেও ভিন্ন।
বয়সে পনের আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিজ্ঞতায় ১১ বছর আগে-পিছে থাকা দুজনের ওই জুটিটি কিন্তু কাল ঠিকই বুঝিয়ে দিল যে, তারুণ্যের মতো অভিজ্ঞতার মূল্যও কম নয়। ওয়ানডেতে তারুণ্যের প্রতি পক্ষপাত থাকাই উচিত, তবে সেই তারুণ্যকে পথ দেখানোর মতো কিছু খেলোয়াড়ও দলে থাকতে হয়। কাল সাকিবকে যেমন দেখালেন হাবিবুল। সাকিবের কাজটা তাতে একটু সহজই হলো।
দুই প্রজন্মের মেলবন্ধন বলছিলাম, সেটি শুধুই বয়সের পার্থক্যের কারণে নয়। এরা দুজন তো বাংলাদেশের ক্রিকেটে পুরো ভিন্ন দুই যুগের প্রতিনিধিও। বেড়ে ওঠায় ভিন্ন, মানসিকতায় ভিন্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিক থেকেও ভিন্ন। হাবিবুল যখন ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন, তাঁর স্বপ্নের সীমানা আইসিসি ট্রফির চেয়ে বেশি বিস্তৃত হওয়ার উপায় ছিল না। এশিয়া কাপের কল্যাণে মাঝেমধ্যে ওয়ানডে খেলার সুযোগ আসতে পারে—তাঁর কাছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অর্থ ছিল এটুকুই।
আর সাকিব যখন ক্রিকেটকে ধ্যানজ্ঞান করে নেওয়ার কথা ভাবছেন, বাংলাদেশ তখন টেস্ট খেলে। সাকিবদের স্বপ্ন তাই স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি ডালপালা মেলার সাহস পেয়েছে। পার্থক্যটা ভালো বলেছিলেন শাহরিয়ার নাফীস। গ্রামীণফোন-প্রথম আলো বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ হওয়ার পর প্রথম আলোকে যে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন, তাতে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাকিবকেই। ‘সাকিবকে দেখুন। মাঠে নামে, ব্যাটিং করে, বোলিং করে—আর কোনো কিছুই ওর মাথায় থাকে না। কারণ ও জানে এটাই ওর কাজ।’
ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং মিলিয়ে সাকিব ওয়ানডের আধুনিক যুগের আদর্শ খেলোয়াড় বলতে যা বোঝায়, তা-ই। ক্যারিয়ারের মাত্র পঞ্চম ম্যাচেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অপরাজিত ৬৭ রানের যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, সেটিকেই ছাড়িয়ে গেলেন কাল। ১৫ ম্যাচে দুটি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৪২৯ রান, সঙ্গে ১৬টি উইকেট—মাত্র মাস ছয়েকের ওয়ানডে ক্যারিয়ার নিয়ে গর্বিত হওয়ার যথেষ্টই কারণ আছে সাকিবের। এটি বললে কালকের ম্যান অব দ্য ম্যাচ নিশ্চিত প্রতিবাদ করবেন। কারণটা তো শাহরিয়ার নাফীসই বলেছেন—‘এটাই তো তার কাজ’।
যেভাবে শুরু করেছেন, তাতে ৬৮ রান খুব বেশি দিন সাকিবের ওয়ানডে-সর্বোচ্চ না থাকারই কথা। এই ইনিংসটি তাই তাঁর কাছে এমন স্মরণীয় হয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। ৭৮ রানের ইনিংসটি নিশ্চিতভাবেই যা হয়ে থাকবে হাবিবুলের কাছে। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বাকি সবার চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে, কিন্তু টেস্টের হাবিবুলের ঔজ্জ্বল্যের কাছে সবসময়ই টিমটিম করে জ্বলেছেন ওয়ানডের হাবিবুল। প্রায় ছয় বছর আগে এই জিম্বাবুয়েতেই ৭৪ রানের যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, এত দিন সেটিই হয়ে ছিল ওয়ানডেতে তাঁর সর্বোচ্চ রান। ৭৪ ছাড়াও দুটি ৭০ ছিল, একটি গত এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, অন্যটিতেও প্রতিপক্ষ ছিল এই জিম্বাবুয়ে। সেটি আসলেই অনেক অনেক দিন আগের কথা। ১৯৯৭ সালে কেনিয়ায় প্রেসিডেন্টস ট্রফিতে।
৭০-এর ঘরে চারটি স্কোর, এর তিনটিই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তবে হাবিবুলের কাছে এই ৭৮ আলাদা হয়েই থাকার কথা। সেটি শুধুই সর্বোচ্চ স্কোর বলে নয়। সিরিজের প্রথম ম্যাচে এমন একটা পথ দেখানো ইনিংস খেলতে পারলে যে অধিনায়কের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।