বাংলাদেশের জন্য জিম্বাবুয়ে সফর মানেই...

উৎপল শুভ্র

১৪ জুলাই ২০২১

বাংলাদেশের জন্য জিম্বাবুয়ে সফর মানেই...

জিম্বাবুয়ে ট্যুরে অনেক দুর্ঘটনার সাক্ষী এবং শিকার কোচ ডেভ হোয়াটমোর ও অধিনায়ক হাবিবুল বাশার

মাহমুদউল্লাহর টেস্ট ক্রিকেট থেকে হঠাৎ অবসর জিম্বাবুয়ে ট্যুরে দুর্ঘটনা-বিতর্কের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন। বাংলাদেশের প্রতিটি জিম্বাবুয়ে ট্যুরেই এমন কিছু না কিছু ঘটেছে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত চারটি ট্যুরে কী হয়েছিল, তা নিয়েই এই লেখা। এর পরেরগুলো না হয় যোগ করে নিলেন!

প্রথম প্রকাশ: ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। প্রথম আলো।

আবার জিম্বাবুয়ে সফরে এলে রওনা হওয়ার আগে একটা মিলাদ পড়িয়ে আসার কথা ভাবছেন হাবিবুল বাশার! কেন, হঠাৎ মিলাদ পড়ানোর পরিকল্পনা কেন?

গত আগস্টে (২০০৬) এখানে জিততে জিততে উল্টো সিরিজ হারতে হয়েছে। টানা আটটি ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে হারানোর পর এবার আরেকটি হোয়াইটওয়াশ যখন খুবই বাস্তব সম্ভাবনা বলে মনে হচ্ছিল, তখনই দ্বিতীয় ম্যাচে গোহারা হেরে বসেছে বাংলাদেশ। অভাবনীয় এসব বিপর্যয় অধিনায়ককে অদৃষ্টবাদী বানিয়ে দিতেই পারে। মিলাদ পড়ানোর চিন্তা মাথায় আসাটাও তাই বিচিত্র কিছু নয়।

কিন্তু হাবিবুল বাশার যে রসিকতা করে বললেন, ‘ভাবছি, এরপর জিম্বাবুয়ে আসার আগে দেশে একটা মিলাদ পড়িয়ে আসব’, সেটির কারণ জয়-পরাজয় নয়। মিলাদ যদি পড়ানই, দু হাত তুলে একটাই প্রার্থনা হবে তার—‘কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই যেন জিম্বাবুয়ে থেকে ফিরে আসতে পারি।’

এর আগে যা পারেনি বাংলাদেশ, এবারও পারছে না। বাংলাদেশের কাছে জিম্বাবুয়ে সফর মানেই একটা না একটা দুর্ঘটনা। সে তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন গত পরশু দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ভুসিমুজি সিবান্দার হেলমেটের ধাক্কায় মোহাম্মদ রফিকের রক্তাক্ত নাক। জিম্বাবুয়েতে বাংলাদেশের এটি চতুর্থ সফর এবং আগের তিনটিতেই এমন কোনো না কোনো দুর্ঘটনা আছে।

এক এক করে বলি—

* ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে বাংলাদেশের প্রথম সফরে বুলাওয়ে টেস্টের তৃতীয় দিন সকালে ওয়ার্মআপের সময় এমনভাবেই উইকেটকিপার খালেদ মাসুদের পা মচকাল যে তাঁকে দেশে ফিরে যেতে হলো।

* সফরের মাঝখানে বাংলাদেশের এক খেলোয়াড়ের দেশে ফিরে যাওয়ার ঘটনা ঘটল ২০০৪ সালে দ্বিতীয় সফরেও। সিরিজের শেষদিকে এসে হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠের ড্রেসিংরুমে হঠাত্ই বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত মোহাম্মদ রফিক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের ওপর এমনভাবেই চড়াও হলেন যে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পরদিন সকালেই বিমানে তুলে দেওয়া হলো তাঁকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি, এরপরও নয়।

* গত বছরের (২০০৬) জুলাই-আগস্টে সর্বশেষ যেবার বাংলাদেশ এখানে এল, সেবারের শিকার হাবিবুল বাশার। তৃতীয় ওয়ানডেতে ফিল্ডিংয়ের সময় ক্যাচ ধরতে গিয়ে হাত ভেঙে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাকি দুটি ওয়ানডে তো বটেই, ছিটকে পড়লেন কেনিয়া সিরিজ থেকেও।

গত পরশু রফিকের ঘটনাটাই যদি এই সফরের শেষ হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে, এবারই সবচেয়ে অল্পের ওপর দিয়ে গেল। মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার পরও রফিকের নাক থেকে যেভাবে রক্ত পড়ছিল, তাতে এই সিরিজ তো বটেই, বিশ্বকাপটাই মিস করে বসেন কি না, সেই শঙ্কাও জাগছিল। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে করা এক্স-রে রিপোর্টটা শুধু রফিকের মনেই নয়, স্বস্তির একটা হাওয়া বইয়ে দিয়েছে পুরো বাংলাদেশ দলেই। না, রফিকের নাকের হাড় ভাঙেনি।

ভাঙেনি, ঠিক আছে। কিন্তু রান আউটের হাত থেকে বাঁচতে ক্রিজে ফিরতে চাওয়া সিবান্দার হেলমেট বল ধরতে যাওয়া রফিকের নাকে এমনই জোর ধাক্কা দিয়েছে, যে রক্তক্ষরণটা বন্ধই হচ্ছিল না। নাকের ফুটোতে গজ ঢুকিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ায় পরশু রাতেও নাকের রক্ত বেরিয়ে আসছিল রফিকের মুখ দিয়ে। কাল সকাল থেকে অবশ্য অবস্থা অনেক ভালো। স্পেশালিস্ট দেখানোর পর গজ-টজ বের করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাঠে নামার অনুমতিও দিয়ে দিয়েছেন তিনি। যার মানে, আগামীকাল তৃতীয় ওয়ানডেতেও রফিকের খেলতে বাধা নেই। রফিক তো পারলে কালই প্র্যাকটিসে নেমে পড়েন। তবে ঝুঁকি এড়াতে কালকের ম্যাচে তাঁকে না খেলানোর সিদ্ধান্তটা মোটামুটি চূড়ান্তই করে ফেলেছে টিম ম্যানেজমেন্ট।

ক্রাচে ভর দিয়ে এয়ারপোর্টের পথে খালেদ মাসুদ। ছবির বাকি তিনজন ২০০১ জিম্বাবুয়ে ট্যুরের অধিনায়ক নাঈমুর রহমান, ম্যানেজার মাহবুবুল আলম ও মুশফিক বাবু ২০০১ সালের প্রথম সফরে ডেভ হোয়াটমোর ছিলেন না। তবে সর্বশেষ তিনটি ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি এবং সে তিনটিই হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে বলে তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে আরেকটি মাঠের কথা। ক্যান্ডির আসগিরিয়া স্টেডিয়াম। ‘এর ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। তবে কিছু মাঠ থাকেযেগুলোতে এমন অভাবিত ইনজুরি বা ঘটনা বেশি ঘটে। যেমন ক্যান্ডি’—বলার পর হোয়াটমোর ২০০১ সালে সেই মাঠে ব্রায়ান লারার ইনজুরির প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা দিলেন, ‘লারা ক্রিজের দিকে ব্যাট বাড়িয়ে দিয়েছে, আর আতাপাত্তু ছুটে এসে তার বাড়ানো বাঁ হাতে ধাক্কা খেল। ব্যাং!’

প্রথমে ‘ব্যাং’ মানে ধরা হয়েছিল, লারার হাতই ভেঙে গেছে। পরে অবশ্য একটু কম খারাপ খবর পান লারা। ভাঙেনি, কনুইয়ের একটা হাড় নড়ে গেছে। ওই ঘটনার দু বছর আগে এই ক্যান্ডিতেই যা ঘটেছিল, সেটি তো ক্রিকেট মাঠে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা বলেই স্বীকৃত। মাহেলা জয়াবর্ধনের তুলে দেওয়া ক্যাচ ধরতে গিয়ে ধাক্কা খেলেন স্টিভ ওয়াহ ও জ্যাসন গিলেস্পি। ওয়াহর নাক ভাঙল আর গিলেস্পির হাত-পা দুটোই। সনাৎ জয়াসুরিয়ার আর্মি কানেকশনের কল্যাণে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার এসে মাঠ থেকে ওয়াহ-গিলেস্পিকে তুলে নিয়ে যায় কলম্বোর হাসপাতালে। পরে স্টিভ ওয়াহ বলেছিলেন, ‘বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। যে ধাক্কা খেয়েছিলাম, তাতে নাকটা আমার মস্তিষ্কে ঢুকে গেলে অস্বাভাবিক কিছু হতো না।’ ক্রিকেটে মানসিক দৃঢ়তা ও ইতিবাচক চিন্তার প্রতীক হয়ে ওঠা সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক আরেকটা মজার কথা বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, সব ঘটনারই একটা ভালো দিক আছে। তবে এটির ভালো দিকটা যে কী, তা বুঝতে পারছি না।’

বাংলাদেশের জন্যও যেমন জিম্বাবুয়েতে এত সব দুর্ঘটনার কোনো ভালো দিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। খালেদ মাসুদের ঘটনাটা বুলাওয়েতে বলে বাংলাদেশের জন্য ‘অপয়া’ হিসেবে শুধু হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাচ্ছে না, বলতে হচ্ছে পুরো জিম্বাবুয়ের কথাই। সবগুলো ঘটনারই সাক্ষী এবং এবারের আগে সর্বশেষ দুটির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা হাবিবুল বাশারের কাছেও স্বাভাবিকভাবেই এর কোনো ব্যাখ্যা নেই, ‘জিম্বাবুয়ের সবগুলো ঘটনাই কেমন ভুতুড়ে! রফিক যেভাবে ব্যথা পেল, ক্রিকেট মাঠে এমন খুব ঘটে না। গতবার আমারই যা হলো, ক্যাচ ধরতে গিয়ে সচরাচর এভাবে হাত ভাঙে না। পাইলটের ইনজুরিটাও তো ছিল ব্যতিক্রমী—ওয়ার্মআপের সময়।’ সবকিছু মিলিয়ে হাবিবুল বলে ফেলছেন, ‘জিম্বাবুয়ে আসতেই এখন ভয় করে!’

প্রতি সফরেই একটি করে দুর্ঘটনা ঘটে বলে ‘এবারের কোটা শেষ’ ভেবে আপাতত নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন হাবিবুল। তাতে এমন ‘ভুতুড়ে’ দুর্ঘটনার ভয় না হয় মন থেকে দূর করা গেল, কিন্তু অন্য একটা ভয় তো থাকছেই। দ্বিতীয় ম্যাচে হেরে বসায় এখন যে সিরিজ হারার ভয়টাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশ দল পরশুর ম্যাচটাকেও একটা ‘দুর্ঘটনা’ বলেই ধরতে চায়। যে কারণে কোচ ডেভ হোয়াটমোরও রুদ্রমূর্তি ধারণ করার বদলে খেলোয়াড়দের পিঠে হাত দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা ভেবেছিলে মাঠে নামবে আর জিতে যাবে। জয়টা তোমাদের অধিকার। ক্রিকেট এত সোজা খেলা নয়।’

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টানা আট ম্যাচে জয় পাওয়ার পর ‘সোজা’ মনে থাকা খেলাটাকে বাংলাদেশ দলের কাছে এখন আর অত সোজা লাগছে না। বিশ্বকাপের আগে বড় দলের সঙ্গে খেলার সুযোগ যখন পাওয়াই যায়নি, ‘ভালো একটা পরীক্ষা হচ্ছে’ ভেবে এই চাপটাকে ‘শাপে বর’ মনে করলেই তো পারে বাংলাদেশ! ডেভ হোয়াটমোরের খুব পছন্দ হলো কথাটা। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এভাবে ভাবলেই তো ভালো।’

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×