ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংস
উৎপল শুভ্র
২৮ জানুয়ারি ২০২১
শেষ ইনিংসে কত রান করেছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান? ‘শূন্য’ বলবেন তো। টেস্ট ক্রিকেটে শেষ ইনিংসে শূন্যই, তবে শুধু ‘শেষ ইনিংস’ বললে ৪, ব্যাটিং-গড় ঠিক ১০০ করতে শেষ টেস্ট ইনিংসে যা প্রয়োজন ছিল। সিডনিতে উৎপল শুভ্রকে এই ধাঁধাতেই ফেলেছিলেন ব্র্যাডম্যান-সতীর্থ অ্যালান ডেভিডসন।
প্রথম প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর, ২০০৫। প্রথম আলো।
এ এমন এক প্রশ্ন, যেটির উত্তর ক্রিকেট ইতিহাসের সামান্যতম অনুসারী মাত্রেরই জানা। অথচ উত্তরটা শুনে ‘আগেই জানতাম, আপনি এটাই বলবেন’ জাতীয় এক হাসি দিয়ে প্রশ্নকর্তা বললেন, সবাই এই ভুলটা করে!
ভুলটা কোথায় হলো, তখনো আমি তা বুঝতে পারছি না। প্রশ্নটা খুবই সরল, স্যার ডন ব্র্র্যাডম্যান শেষ ইনিংসে কত রান করেছিলেন? শুনে প্রথমেই আমি মনে মনে হেসে নিয়েছি। একটু রাগমতোও হয়েছে। বাংলাদেশের সাংবাদিক জেনে কি ক্রিকেট-মূর্খ মনে করেছে নাকি! ১৯৪৮ সালের ইংল্যান্ড সফরে ওভালে শেষ টেস্ট ইনিংসে ব্র্যাডম্যানের শূন্য রানে আউট হয়ে গিয়েছিলেন, এটা তো ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রেরও জানা। ওই শূন্য নিয়ে এত এত লেখা পড়েছি যে, কখনো কখনো মনে হয় সব বোধ হয় নিজের চোখেই দেখেছি: দর্শকদের তুমুল করতালির মধ্যে শেষ ইনিংসে ব্যাট করতে নামছেন ব্র্যাডম্যান, ইংল্যান্ড অধিনায়ক নরম্যান ইয়ার্ডলি দলের সব খেলোয়াড়কে জড়ো করে তাঁর সম্মানে ‘থ্রি চিয়ার্স’ দিচ্ছেন। লেগ স্পিনার এরিক হলিসের প্রথম বলটি লেগ ব্রেক, ব্যাক ফুটে গিয়ে খেললেন ব্র্যাডম্যান। দ্বিতীয় বল গুগলি, তা পড়তে না পারায় ব্র্যাডম্যানের ব্যাটের ভেতরের কানা ছুঁয়ে বল ফেলে দিল অফ স্টাম্পের বেল। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত শূন্য! অথচ মাত্র ৪ রান করতে পারলেই টেস্ট ক্রিকেটে ব্র্র্যাডম্যানের ব্যাটিং গড় হতো ঠিক ১০০!
অথচ সিডনি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ব্র্যাডম্যান স্ট্যান্ডে বসেই ৭৬ বছরের এই বৃদ্ধ দাবি করছেন, শেষ ইনিংসে ব্র্যাডম্যান ৪ রানই করেছিলেন! হেসে উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ বৃদ্ধের নাম অ্যালান ডেভিডসন। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ৪৪টি টেস্ট খেলেছেন এবং ওয়াসিম আকরামের আবির্ভাবের আগে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা বাঁহাতি পেসারের মর্যাদাটা তিনিই পেতেন। ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে খেলেননি, ব্র্যাডম্যানের ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পরের বছর তাঁর শুরু।
ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে যিনি খেলেছেন, মূলত তার সঙ্গে কথা বলতেই ব্র্যাডম্যান স্ট্যান্ডে যাওয়া। ৭৭ বছরের বৃদ্ধ নিল হার্ভিকে দেখে আমি তো রীতিমতো চমৎকৃত! এই বয়সেও তাঁর বসার ভঙ্গি, কথা বলার ধরন--সব কিছু থেকেই ঠিকরে বেরোচ্ছে ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৮ সালের ইংল্যান্ড সফর ব্র্যাডম্যানের শেষ, সেই সিরিজেই নিল হার্ভির টেস্ট অভিষেক। ৭৯ টেস্টে ৪৮.৪২ গড়ে ৬,১৪৯ রান, ২১টি সেঞ্চুরি--ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের একেবারে সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও থাকে তাঁর নাম। সেই হার্ভির সঙ্গে এটা-ওটা কথা বলতে বলতে যেই ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংসের প্রসঙ্গ এল, পাশে বসে থাকা অ্যালান ডেভিডসনের ওই প্রশ্ন: ‘আচ্ছা বলো তো, জীবনের শেষ ইনিংসে ডন কত করেছিলেন?’ প্রশ্নটা শুনে কৌতুক-রাগ এসব অনুভূতির তরঙ্গ বেয়ে ‘এটা তো সবাই জানে, জিরো’ বলতেই ডেভিডসনের ওই হাসি। ‘সবাই এই ভুলটা করে। শেষ ইনিংসে ডন করেছিলেন চার’ বলে আবারও হাসি।
হঠাৎ করেই কেউ এসে, ধরুন সেই কেউ আবার জোতির্বিজ্ঞানী, ‘সূর্য পূর্ব দিক থেকে নয়, পশ্চিম দিক থেকে ওঠে’ বললে যে অনুভূতিটা হবে, আমার অবস্থাও তখন সে রকম। আরেকটা ভাবনাও যে মনে উঁকি দেয়নি, তা নয়। জীবনের আর খুব বেশি বাকি নেই, এখনো ক-ত কথা বলতে বাকি--ভেতরের এই তাড়নাটা অ্যালান ডেভিডসন এরই মধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি অ্যালান ডেভিডসন না হলে তা হয়তো ‘বুড়ো বয়সের বকবকানি’ হয়ে বিরক্তিই উৎপাদন করত। এবার সত্যি সত্যিই মনে সন্দেহ দেখা দিল, বুড়ো বয়সের সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই যেহেতু দৃশ্যমান, ডেভিডসন বয়সজনিত স্মৃতিভ্রংশ রোগেও আক্রান্ত নন তো! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কী বলব ভাবছি, ডেভিডসন নিজেই মুক্তি দিলেন এই দশা থেকে। হেসে বললেন, ‘আমি আপনাকে ব্র্যাডম্যানের শেষ টেস্ট ইনিংসের কথা নয়, শেষ ইনিংসের কথা জিজ্ঞেস করেছি। জীবনের শেষ ইনিংসে ব্র্যাডম্যান ৪ রানই করেছিলেন। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন, কারণ ওই ম্যাচে আমি আম্পায়ার ছিলাম।’
ওহ্, ঘটনা তাহলে এই! একটু লজ্জাই লাগল, সব প্রশ্নেরই এক হাত লম্বা উত্তর দিলে কী হবে, অ্যালান ডেভিডসন একটা কথাও তো উল্টোপাল্টা বলেননি। আর আমি কিনা তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েও সংশয়ে ভুগতে শুরু করেছিলাম!
ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংসের বৃত্তান্ত শুনতে উদগ্রীব আমি এবার নিল হার্ভিকে বাদ দিয়ে অ্যালান ডেভিডসনের মনোযোগী শ্রোতা। অ্যালান ডেভিডসনও শোনাতে উদগ্রীবই ছিলেন, কিন্তু ‘শেষ টেস্ট ইনিংসের মতো ব্র্র্যাডম্যানের জীবনের শেষ ইনিংসটিও ছিল ইংল্যান্ডেরই বিপক্ষে, একটি প্রদর্শনী ম্যাচে’... ক্লাসে পড়ানোর ভঙ্গিতে মাত্র বলতে শুরু করেছেন, তার এক পুরনো বন্ধু এসে ‘হাই ডেভিড, কত দিন তোমাকে দেখি না’ বলে এমন শোরগোল বাধিয়ে দিলেন যে, ডেভিডসন একটু আগের পছন্দের শ্রোতার কথা ভুলেই গেলেন। একটু পর তো বেরিয়েই গেলেন বন্ধুকে নিয়ে। বাকিটুকু শুনব বলে সুপার টেস্টের চতুর্থ দিন প্রেসবক্সের লাগোয়া ব্র্যাডম্যান স্ট্যান্ডে গিয়েও আর ডেভিডসনের দেখা পেলাম না। টেস্টের উত্তেজনা বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই, তিনি আসেননি।
অথচ ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংস নিয়ে কৌতূহলটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ব্র্যাডম্যান নিয়ে কত কিছু পড়েছি, অথচ তাঁর জীবনের শেষ ইনিংসটির কথা জানিই না! অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকদের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁরাও দেখি আমার দলেই। ‘হ্যাঁ, অবসর নেওয়ার কয়েক বছর পর স্যার ডন কী যেন একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছিলেন’--আমার চেয়ে শুধু এটুকু ব্যবধানেই এগিয়ে। কী আর করা, মেনেই নিলাম, অ্যালান ডেভিডসনের ওই বন্ধুর ওপর রাগ আর ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংসটার বিস্তারিত না জানার আক্ষেপ বেশ কিছুদিন সঙ্গী হয়েই থাকবে।
ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্র্যাডম্যান বনাম স্ট্যাথাম। স্ট্যাথামের প্রথম বলটি অন সাইডে খেললেন ব্র্যাডম্যান। অফ সাইডে পিচ পড়া পরের বলটিই ঘটাল ওই অঘটন, গুডম্যান যেটিকে বলছেন, ‘ব্ল্যাক মোমেন্ট’।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে দু দিনের মধ্যেই সেসবের অবসান। সিডনিতে যে হোটেলে ছিলাম, তার ঠিক পাশেই পুরনো বইয়ের একটা তিনতলা দোকান। খেলার বইও অনেক। সেখানে জ্যাক পোলাডের্র ‘সিক্স অ্যান্ড আউট’ নামে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট-রচনার এক সংকলন হাতে নিয়ে সূচিতে চোখ বোলাতেই চমক। একটি লেখার শিরোনাম: দ্য লাস্ট অব দ্য “ডন”, লেখকের নাম টম গুডম্যান। কদিন আগে হলেও এটিকে ‘ওভালের শূন্য’ নিয়ে হাজারো লেখার আরেকটি ভেবে দ্বিতীয়বার তাকাতাম কি না সন্দেহ! সময়টা ডেভিডসন-উত্তর বলেই শিরোনাম দেখে প্রথমেই মনে হলো, ডেভিডসন যে ম্যাচটির কথা বলেছিলেন, ডনের এই ‘লাস্ট’ কি সেটিই? শুনতে অতিনাটকীয় শোনাবে, তবে আক্ষরিক অর্থেই কম্পিত বক্ষে ২৫২ নম্বর পৃষ্ঠায় গিয়ে যে আনন্দটা হলো, গুপ্তধন খুঁজে পেলেও মানুষের এমন আনন্দই হয় বলে আমার ধারণা। হ্যাঁ, ডেভিডসন যে ম্যাচটির কথা বলেছেন, সেই ম্যাচ নিয়েই এই লেখা। ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে থাকা অ্যালান ডেভিডসন যে সে ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছিলেন, তারও উল্লেখ আছে এতে। লেখার শুরুটা এ রকম : It was a sad moment for all, including the bowler, Brian Statham, when Sir Donald Bradman was dismissed with the fifth ball he received in the one-day match between M.C.C. and the Prime MInister’s Eleven at Canberra on Wednesday, 6th February, 1963.
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী একাদশ বলেই ৫৪ বছর বয়সী স্যার ডন আবার মাঠে নেমেছিলেন, কারণ তখন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর নাম ছিল রবার্ট মেনজিস। রাজনীতি আর ক্রিকেটে আগ্রহটা সমানই ছিল ভদ্রলোকের, ষাটের দশকে অস্ট্রেলিয়ায় প্রকাশিত ক্রিকেটের কত বইয়ে যে রবার্ট মেনজিসের লেখা ভূমিকা দেখেছি, এর কোনো হিসাব নেই। টম গুডম্যানের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, মেনজিসই ব্র্যাডম্যানকে খেলতে রাজি করান, সে ম্যাচের আগে ক্যানবেরার মানুকা ওভাল মাঠে ব্র্যাডম্যান প্যাভিলিয়নের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও করেন তিনি। ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং দেখার আকর্ষণে মাঠে ভিড় করেছিল ১০ হাজার দর্শক। ইংল্যান্ডের সাংবাদিকদেরও অনেকে ছুটে এসেছিলেন এমনিতে একেবারেই পিকনিক মুডের এই ম্যাচ কভার করতে।
এমসিসি (তখন ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল এই নামেই পরিচিত ছিল) প্রথমে ব্যাটিং করে, প্রায় ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের পুরোটাই প্রথম স্লিপে ফিল্ডিং করেন ব্র্যাডম্যান। ব্যাট করতে নামার সময় তাঁর মাথায় অস্ট্রেলিয়ার ব্যাগি গ্রিন টুপি, ওভালের মতোই দর্শকদের করতালিতে স্নাত হয়ে উইকেটে যাওয়া, পুরো দলকে একসঙ্গে করে ইংল্যান্ড অধিনায়কের অভ্যর্থনা জানানো। পার্থক্য বলতে, ওভালে ছিলেন নরম্যান ইয়ার্ডলি, মানুকা ওভালে টেড ডেক্সটার। ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং পার্টনার ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য ডন চিপ। ব্র্যাডম্যানকে প্রথম বলটি করেন টম গ্র্যাভেনি, ম্যাচের মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই অফ স্টাম্পের বাইরে একটি ‘উপহার বল’। কিন্তু ব্র্যাডম্যান কেন যেন সেটিকে মাফ করে দিলেন! পরের বলটি স্টাম্পের লাইনে, ব্র্যাডম্যান স্ট্রেট ড্রাইভ করলেন। সর্বশক্তিতে নয়, তবে যতটুকু করলেন, তাতেই বল সীমানা পার। পরের বলটি আস্তে করে অন সাইডে খেললেন, কোনো রান নয়। ওভার শেষ।
পরের ওভার করতে এলেন ব্রায়ান স্ট্যাথাম। প্রথম বলে চিপ সিঙ্গেল নেওয়ায় স্ট্রাইক পেলেন ব্র্যাডম্যান। ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্র্যাডম্যান বনাম স্ট্যাথাম। স্ট্যাথামের প্রথম বলটি অন সাইডে খেললেন ব্র্যাডম্যান। অফ সাইডে পিচ পড়া পরের বলটিই ঘটাল ওই অঘটন, গুডম্যান যেটিকে বলছেন, ‘ব্ল্যাক মোমেন্ট’। ব্যাটের মাঝখান দিয়েই রক্ষণাত্মক খেলেছিলেন ব্র্যাডম্যান, কিন্তু বল ব্যাট থেকে তাঁর বাঁ পা হয়ে স্টাম্পে গিয়ে লাগল, বেল ফেলতে যতটুকু জোরে লাগতে হয়, ঠিক ততটুকু জোরেই। মাঠে শ্মশানের নীরবতা, বোলার ব্রায়ান স্ট্যাথাম দু হাত শূন্যে ছুড়লেন। আনন্দে নয়, আক্ষেপে! পরে প্যাভিলিয়নে বসে নিজের আউট হওয়ার ধরন সম্পর্কে ব্র্যাডম্যান বলেন, ‘এক হাজার বছরেও এমন হয় না!’ এরপরই জানিয়ে দেন, ‘যা-ই হোক, এটাই আমার উইকেটে শেষ উপস্থিতি।’
সবই তো জানলেন। বলার কথা একটাই, ভবিষ্যতে কেউ ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংসের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রশ্নের মধ্যে ‘টেস্ট’ কথাটা আছে কি না, ভালো করে খেয়াল করুন। নইলে বোকা বনতে হতে পারে। আমাকে যেমন বানিয়ে ছিলেন অ্যালান ডেভিডসন।