অজন্তা-রহস্যে এশিয়া কাপ শ্রীলঙ্কার
এশিয়া কাপ ক্রিকেট ২০০৮
উৎপল শুভ্র
৬ জুলাই ২০২১
ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই স্পিন খেলতে পারে! করাচিতে ২০০৮ এশিয়া কাপ ফাইনালটা এ কারণেই আরও বড় বিস্ময় হয়ে আছে। অজন্তা মেন্ডিস নামে এক `রহস্য স্পিনার` একাই শেষ করে দিয়েছিলেন ভারতের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইন আপকে। শেষ পর্যন্ত ১৩ রানে ৬ উইকেট, আসলে তো এই ৬ উইকেট প্রথম ৬ ওভারে মাত্র ৯ রানেই। এই ম্যাচ তাই বিখ্যাত হয়ে আছে `অজন্তা মেন্ডিসের ম্যাচ` হিসেবেই।
প্রথম প্রকাশ: ৭ জুলাই ২০০৮। প্রথম আলো।
শ্রীলঙ্কা: ৪৯.১ ওভারে ২৭৩। ভারত: ৩৯.৩ ওভারে ১৭৩। ফল: শ্রীলঙ্কা ১০০ রানে জয়ী
শ্রীলঙ্কার ইনিংস শেষ করে দিয়ে মাঠ ছাড়ার সময় ভারতীয় খেলোয়াড়দের দেখে মনে হলো, ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধটা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। এশিয়া কাপ তাঁরা জিতেই গেছেন!
মুখে হাসি, একে অন্যের সঙ্গে ‘হাই ফাইভ’— দেখে কে বলবে, জিততে হলে বড় একটা রানই তাড়া করতে হবে।
বড়? বড় কোথায়! স্বাভাবিক ওয়ানডেতে ২৭৩ বড় হতে পারে, কিন্তু এই এশিয়া কাপে স্বাভাবিক ওয়ানডে হচ্ছে নাকি!
রসিকতা করে হলেও যে উইকেটে নিরাপদ স্কোর বলতে দুই অধিনায়কই ‘চার শ’ বলে দিয়েছেন, সেখানে ২৭৩ তো ‘খুবই কম’ রান। ভারতীয় খেলোয়াড়দের আগাম উদযাপনে তাই বিস্ময়ের কিছু ছিল না। তখন তো আর তাদের জানা ছিল না, অজন্তা মেন্ডিস নামে রহস্যময় ওই স্পিনার এই ২৭৩-কেও কেমন পাহাড়সমান বানিয়ে দেবেন! মোরাতুয়ার তরুণের মায়াজাল তাঁদের কাছে এমনই দুর্বোধ্য মনে হবে যে, মাত্র ১৭৩ রানে শেষ হয়ে হারতে হবে ১০০ রানে!
এই এশিয়া কাপে এর আগে যা হয়েছে, সেটিকে শুধু বলের ওপর ব্যাটের প্রাধান্য বললে বোঝানো যায় না, বলতে হয় বলের ওপর ব্যাটের সীমাহীন দৌরাত্ম্য। কী বৈপরীত্য, সেই টুর্নামেন্টের ফাইনালেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ এক বোলার! ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টও! ৮ ওভারে ১৩ রানে ৬ উইকেট, মরা উইকেটে ৫ ম্যাচে ১৭—অজন্তা মেন্ডিস ছাড়া আর কে পাবেন এই পুরস্কার!
এই উইকেটে ২৭৩ রান বড় নয়, শেবাগ-ঝড়ে প্রথম ৯ ওভারেই ভারতের ৭৬ হয়ে যাওয়ায় সেটিকে আরও ছোট মনে হচ্ছিল। বড়-ছোট কথাগুলো কতটা আপেক্ষিক, বল হাতে নিয়েই তা প্রমাণে নেমে গেলেন অজন্তা। দ্বিতীয় বলে শেবাগকে দিয়েই শুরু। স্টাম্পড হয়ে ফেরার সময় ভারতের ৭৬-এর ৬০-ই শেবাগের একার, সেটিও মাত্র ৩৬ বলে। মাঝখানে এক বল, তার পরই বোল্ড যুবরাজ সিং! তৃতীয় ও চতুর্থ ওভারে নিলেন সুরেশ রায়না ও রোহিত শর্মাকে। ৪ ওভার শেষে মেন্ডিসের বোলিং ফিগার: ৪-০-৮-৪ আর ভারত ৫ উইকেটে ৯৭!
দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে পরপর দুই বলে ইরফান পাঠান ও আর পি সিং—৬ ওভারে ৯ রানে ৬ উইকেট! ভারতের দুই উইকেট তখনো বাকি, চামিন্ডা ভাসের ওয়ানডে-সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড (৮/১৯) তখন কাঁপছে!
শেষ পর্যন্ত সেটি অক্ষতই, কারণ জয়াবর্ধনে দ্বিতীয় স্পেলে অজন্তাকে দুই ওভারই দিলেন। দুই ওভারের তৃতীয় স্পেলে আর উইকেট পাননি অজন্তা, তাতে কিছুই আসে যায়নি। ম্যাচ তো ততক্ষণে শেষ। বছরের শুরুতে ঢাকায় কিটপ্লাই ফাইনালের মতোই একা কিছুক্ষণ লড়লেন ধোনি, যে লড়াইয়ের ফল তাঁর নিজেরও জানা ছিল।
স্পিন খেলাটা যাদের কাছে সব সময়ই ডালভাত, সেই ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের অজন্তা মেন্ডিসে এমন হাবুডুবু খেতে দেখাটা রীতিমতো এক বিস্ময়। তবে এই বিস্ময়ের দেখা মিলেছে তো পরে। বিরতির সময় বিস্ময়ের যদি কিছু থেকে থাকত, তা শ্রীলঙ্কার ওই ২৭৩ রানে। ফাইনালের আগে এই মাঠে বড় দলগুলোর ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিং করা দল মাত্র একবারই তিন শ রানের কম করেছে। সেটিও ২৯৯। ২৭৩-কে ‘সামান্য’ দেখানোর আরেকটা কারণ ছিল, এই ম্যাচে একজন বোলার কমিয়ে ভারত নেমেছিল সাত ব্যাটসম্যান নিয়ে।
এই মাঠে বড় বড় রান অনায়াসে তাড়া হতে দেখেও টস জিতে প্রথমে ব্যাটিংই করে যাচ্ছিল দলগুলো। অথচ কাল ধোনি টসে জিতে ফিল্ডিং নিলেন। কারণ কী? শ্রীলঙ্কাকে টার্গেট দাঁড় করানোর চাপে ফেলা। কত রান নিরাপদ, কেউই যে তা জানে না! দলে সাতজন ব্যাটসম্যান নিয়ে রান তাড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারত যেন শ্রীলঙ্কার অস্ত্রেই শ্রীলঙ্কাকে বধ করতে চাইল। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা তো এ-ই করত।
প্রতিপক্ষ দলে বোলার একজন কম, তারপরও ২৭৩ হলো কেন? শুধু ভারতীয় বোলারদের ভালো বোলিংয়ের কথা বললে তা অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, আগের ম্যাচগুলোতে বেধড়ক মার খেয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরের সুখস্মৃতি ভুলে যেতে বসা ইশান্ত শর্মা প্রথম স্পেলে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। প্রথম ৫ ওভারেই তাঁর ৩ উইকেট। এটাও সত্যি যে, শ্রীলঙ্কান ইনিংসের মাঝপথে ভালো বোলিং করেছেন ভারতীয় স্পিনাররাও। তবে আসল কারণ, দ্বিতীয় ওভারেই কুমার সাঙ্গাকারার রান আউট হয়ে যাওয়া।
ফাইনালের আগে জয়াসুরিয়া-সাঙ্গাকারা উদ্বোধনী জুটির গড় ছিল ৮৮.৭৫ রান, এই রানও উঠেছে ওভারপ্রতি ৭ করে।এদিন আর পি সিংয়ের প্রথম ওভার থেকে নেওয়া ১১-তেই বিচ্ছিন্ন তাঁরা। এই ধাক্কা সামলাতে জয়াবর্ধনেকে একটা ভালো ইনিংস খেলতে হতো। কিন্তু তিনি করতে পারলেন মাত্র ১১। দ্বাদশ ওভারে তিন বলের মধ্যে ইশান্ত যখন কাপুগেদারা ও চামারা সিলভাকেও তুলে নিলেন, ৬৬ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা রীতিমতো টালমাটাল।
সেখান থেকে ২৭৩-ও তো কম নয়। সেটি সম্ভব হলো এক ব্যাটিং জিনিয়াসের কীর্তিতে। সাঙ্গাকারার রান আউটে তাঁর দোষ ছিল না, তারপরও এমন একটা বিপর্যয়ে রাগ তো হবেই। সনাৎ জয়াসুরিয়া সেই ঝালটাই মেটালেন ভারতীয় বোলারদের ওপর, যার যন্ত্রণা সবচেয়ে বেশি সইতে হলো আর পি সিংকে। পাঠানের বলে মিড অনে ক্যাচ তুলেছিলেন, আর পি বলের গতিপথ বুঝতে না পেরে বলে হাতও লাগাতে পারেননি। পরের ওভারেই ফিরলেন দ্বিতীয় স্পেল করতে। প্রথম দুই বল উড়ে গেল লং অন আর লং অফের ওপর দিয়ে, পরের দুই বলে কাভার দিয়ে চার, পঞ্চম বলটি ‘ডট’ দেওয়ার পর শেষ বলটি মিড উইকেটের ওপর দিয়ে উড়িয়ে ফেললেন গ্যালারিতে। এর আগে ইশান্তকে ছক্কা মেরে ৪৩ বলে ফিফটি করেছেন। এই ওভারের আগে ৫২ বলে ৬১ করেছিলেন, ২৬ রানের এই ওভারে এক লাফেই জয়াসুরিয়া পৌঁছে গেলেন ৫৮ বলে ৮৭-তে!
ওয়ানডেতে ২৭তম সেঞ্চুরিটি এল ৭৯ বলে, যাতে ৯টি চার ও ৫টি ছয়। সেঞ্চুরির পর জয়াসুরিয়াকে এতটা উচ্ছ্বসিত হতে কমই দেখা গেছে, আউট হওয়ার পর এমন হতাশ হতেও। ম্যাচটা ফাইনাল, তার ওপর দলের এমন অভাবিত বিপর্যয়ে সেঞ্চুরি—জয়াসুরিয়ার মতো পোড় খাওয়া পেশাদারকেও আত্মসমর্পণ করতে হলো আবেগের কাছে। শেবাগ স্লগ-সুইপ করতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ হওয়ার পর আবেগ দেখা দিল বিপরীত রূপ ধরে। পুরো ইনিংস থাকবেন বলেই একটু দেখে শুনে খেলছিলেন, ৩৬তম ওভারে ১১৪ বলে ১২৫ রান করে ফেরার সময় জয়াসুরিয়ার হতাশা দেখে কারও মনে হতেই পারত—তিনি বোধ হয় ১০-১২ করে আউট হয়েছেন!
দিলশানের সঙ্গে ১৪১ বলে ১৩১ রানের জুটিটিই শ্রীলঙ্কান ইনিংসের প্রাণ। এই ১৩১-এ দিলশানের মাত্র ৪৫! ৭৪ বলে দিলশানের ৫৬, যাতে মাত্র ৩টি চার, সেই তিন চার পাঠানের পর পর তিন বলে। তাঁদের পর আর কোনো ব্যাটসম্যান নেই বলে জয়াসুরিয়া-দিলশানকেও শেষ দিকে একটু বুঝেশুনে খেলতে হয়েছে। যে কারণে শ্রীলঙ্কান ইনিংস প্রায় ২২ ওভার বাউন্ডারিশূন্য থাকার অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে।
২৭৩-কে মামুলি ভেবে ভারতীয়রা যখন হাই ফাইভ করতে করতে মাঠ ছাড়ছে, অজন্তা মেন্ডিস হয়তো মনে মনে হাসছিলেন!
আরও পড়ুন: