টেস্ট স্ট্যাটাসের স্বপ্ন পূরণ

উৎপল শুভ্র

২৬ জুন ২০২১

টেস্ট স্ট্যাটাসের স্বপ্ন পূরণ

২০০০ সালের ২৬ জুন। লর্ডসের সভা থেকে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা আদায় করে বেরিয়ে আসছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সে সময়কার সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হক। ছবি: শামসুল হক

লর্ডস থেকে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার খবরটা বাংলাদেশে এসে পৌঁছাতেই বদলে গিয়েছিল এ দেশের ক্রিকেটের রং। ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত শ্রেণিভূক্ত হয়ে বাকি বিশ্বের কাছে নতুন আলোয় দেখা দিয়েছিল বাংলাদেশ। এই লেখার ছত্রে ছত্রে ছিল সেই আনন্দ।

যে স্বপ্ন চোখে নিয়ে বাংলাদেশের ঘুম ভেঙেছিল গতকাল সকালে, সেই স্বপ্ন আর স্বপ্ন হয়ে নেই। ‘বংলাদেশ টেস্ট খেলবে’—কয়েক বছর আগেও বহু দূরের মনে হওয়া এই স্বপ্ন এখন সত্যি। গতকাল ‘ক্রিকেটের মক্কা’ বলে পরিচিত লর্ডসে উঠেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন সূর্য। টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে গেছে বাংলাদেশ।

সহযোগী ও পূর্ণ সদস্য মিলিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল আইসিসির ৩৫টি দেশই ভোট দিয়েছে বাংলাদেশের টেস্ট আবেদনের পক্ষে। ২৬ থেকে কমে ২৫ হয়ে গেছে আইসিসির সহযোগী সদস্যের সংখ্যা, পূর্ণ সদস্য দেশের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯ থেকে ১০। এই ১০ নম্বর দেশটি বাংলাদেশ! ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের এলিট ক্লাবে নতুন সদস্য আমাদের দেশ। বন্যা, খরা, আর রাজনৈতিক হানাহানির কারণেই যে দেশ শুধু স্থান পেত বিদেশি মিডিয়ায়, সেই বাংলাদেশকে পুরো বিশ্ব দেখছে এখন নতুন আলোতে।

অভিনন্দন বাংলাদেশ!

বাঁয়ে জগমোহন ডালমিয়া, ডানে ম্যালকম গ্রে। আইসিসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডালমিয়ার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে গ্রে`র প্রথম কাজই ছিল বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস ঘোষণা করা। ছবি: গেটি ইমেজেস

ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লর্ডস থেকে সুখবরটা জেনে গিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে লন্ডনে তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় বিকেল ৫টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা)। জগমোহন ডালমিয়ার কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়া আইসিসির নতুন প্রেসিডেন্ট ম্যালকম গ্রে ‘বাংলাদেশ আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ পেয়েছে’ বহু প্রতীক্ষিত এই ঘোষণা দিয়েই বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানান মঞ্চে। সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন বিসিবি সভাপতি, একই সঙ্গে দিলেন প্রতিশ্রুতিইও—সর্বসম্মতভাবে টেস্ট স্ট্যাটাস দিয়ে যে আস্থার কথা ঘোষণা করেছে আইসিসি সদস্যরা, মাঠে তার প্রতিদান দেবে বাংলাদেশ।

এই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারাটা সহজ কাজ নয়। তবে সেটি পরের ব্যাপার, বাংলাদেশের জন্য আপাতত আনন্দের অনুভূতিটাই বেশি তীব্র। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয় আর ১৯৯৯ বিশ্বকাপ অভাবনীয় সাফল্য দিয়ে এ দেশকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার অধিকার পেয়ে সেই ক্রিকেটই আবার এনে দিয়েছে আরেকটি উৎসবের উপলক্ষ।

মাঠের জয়ের মতো প্রত্যক্ষ নয় এই সাফল্য, হয়তো এ কারণেই আইসিসি ট্রফি বা বিশ্বকাপের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঢল নামেনি মানুষের। তবে গতকাল বিকেলে লর্ডস থেকে সুখবরটা আসার পর নিশ্চিতভাবেই বদলে গেছে বাংলাদেশের রঙ। পুরো বিশ্বের কাছে গৌরবের এক পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার আনন্দের সঙ্গে তো এই দেশের মানুষের পরিচয় ছিল না আগে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে গতকাল সন্ধ্যায় বিশাল যে ট্রাক মিছিলটি বেরুল, সেটি প্রতীকী হয়ে উঠেছে পুরো দেশের আনন্দের।

১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়ের পরই বাংলাদেশ দেখতে শুরু করেছিল এই টেস্ট স্ট্যাটাসের স্বপ্ন। ১৯৯৮ সালের ১৫ জানুয়ারিতে করা বাংলাদেশের আবেদন গত বছর জুনে অনুষ্ঠিত আইসিসি বার্ষিক সভায় নাকচ হয়ে গিয়েছিল ৫-৪ ভোটে। বিপক্ষে থাকা চারটি পূর্ণ সদস্য দেশ জুড়ে দিয়েছিল কিছু শর্ত। সে সবই পূরণ করেছে বাংলাদেশ, পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হক অক্লান্তভাবে চালিয়ে গেছেন কূটনীতি। কাল মিলেছে তারই ফল।

১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়টাই কাজ করেছিল টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার মূল প্রভাবক হিসেবে। ছবি: গেটি ইমেজেস

গতবার বিপক্ষে থাকা চার দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আগেই। যে ইংল্যান্ডকে নিয়ে এত সংশয় ছিল, সেই ইংল্যান্ড পর্যন্ত গতকাল বাংলাদেশকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছে টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত পরিবারে। পূর্ণ সদস্য সাতটি দেশের সমর্থন পেলেই চলত বাংলাদেশের, তবে সর্বসম্মত এই রায় নিশ্চিতভাবেই আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। মাঠে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সই দিয়েছিল মূল ভিত্তি, এর সঙ্গে সংগঠকদের সফল দূতিয়ালি মিলে বাংলাদেশ আজ টেস্ট খেলুড়ে এক দেশ। টেস্ট ক্রিকেটের ১২৩ বছরের ইতিহাসে মাত্র দশম দেশ হিসেবে এই স্বীকৃতি।

অভিনন্দন বাংলাদেশ!

এখন থেকে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরে খেলবে বাংলাদেশ, আর কোনো দিন বিশ্বকাপে খেলার জন্য আইসিসি ট্রফির টেনশনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে না—উৎসব করার জন্য এ সবই যথেষ্ট। এর চেয়েও বড় পাওয়া, এখন থেকে ‘বাংলাদেশ’ নামটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই নেতিবাচক কোনো ছবি ভেসে উঠবে না কারও চোখে। ক্রিকেটের কল্যাণে গর্ব করার মতো একটা পরিচয়ও পেয়ে গেলাম আমরা।

অভিনন্দন বাংলাদেশ!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×