সেঞ্চুরির চেয়ে বেশি আলোচিত উদ্যাপন
উৎপল শুভ্র
২২ জুন ২০২১
ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার আগেই বিশ্বকাপের কথা ভেবে সাব্বির রহমানকে দলে ফিরিয়ে এনেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি করে সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন সাব্বির। কিন্তু সেঞ্চুরি ছাপিয়েও বড় হয়ে উঠেছিল তা উদযাপন করতে সাব্বির যা করেছিলেন। মাশরাফির যা একদমই পছন্দ হয়নি।
প্রথম প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। প্রথম আলো।
সাব্বিরের সেঞ্চুরিটা বেশি আলোচিত হয়ে থাকছে নাকি তাঁর উদ্যাপন? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দ্বিতীয়টাই। বিতর্কের জন্ম দিয়ে দলে ফেরার পর তৃতীয় ম্যাচেই সেঞ্চুরি। যেটি আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর প্রথমও। বাঁধভাঙা একটা উদ্যাপন তাই প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু সেটিকে যে অন্য মাত্রা দিয়ে দিলেন সাব্বির!
ম্যাচের গা থেকে জয়–পরাজয়ের প্রশ্ন খসে গেছে অনেক আগেই। এই ম্যাচকে ঘিরে যা একটু আগ্রহ অবশিষ্ট ছিল, সেটি তাঁর সেঞ্চুরিকে ঘিরেই। ওয়ানডেতে এর আগে ৫০টি ইনিংসে সত্তরের ঘরেই যেতে পারেননি কখনো। বিতর্ক আর চাপকে ছায়াসঙ্গী করে এই সফরে আসা সাব্বির কি সেঞ্চুরিই করে ফেলবেন আজ?
প্রশ্নটা শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মনেই গুঞ্জরিত হয়নি, ইউনিভার্সিটি ওভালের দর্শকদেরও মাঠে বসিয়ে রেখেছিল এটির উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা। এরা ক্রিকেটের সত্যিকার সমঝদার। প্রতিপক্ষের অর্জনেও হাততালি দিতে জানে। আর নিজেদের দলের জয় যখন নিশ্চিত, সেই তালি আরও জোরে বাজে। সাব্বিরের উদ্যাপন অবশ্য তাঁদের একটু ধাঁধাতেই ফেলেছে। পেছনের ইতিহাস তো আর তাঁদের জানা নেই।
কী উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে সেঞ্চুরির তীরে পৌঁছেছেন কটা চোখের এই তরুণ, তাঁরা কি আর এত খবর রাখেন!
প্রথাগত উদ্যাপনের পর এক হাতে ব্যাটের মাঝখানটা ধরলেন। আরেক হাতে ফুটিয়ে তুললেন বকবক করার ভঙ্গি। চাইলে এর দুটি অর্থ করা যায়। ‘আমি যা বলার ব্যাট দিয়েই বলব’ অথবা ‘অনেক কিছু তো বলেছ, দেখো, ব্যাট দিয়েই জবাবটা দিয়ে দিলাম।’ একটু ভাবলেই প্রথমটা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। যা বলার ব্যাট দিয়েই বলবেন বোঝাতে চাইলে তো বাড়তি কিছু করারই কথা নয়। দ্বিতীয়টাই আসলে বলতে চেয়েছেন সাব্বির। মাশরাফি বিন মুর্তজার যা একদমই পছন্দ হয়নি।
ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার আগেই সাব্বিরের বাংলাদেশ দলে ফেরার পেছনে অধিনায়কের চাওয়ার বড় ভূমিকা। বিশ্বকাপে সাত নম্বরে সাব্বিরের কোনো বিকল্প দেখেন না। বিশ্বকাপে যদি নিয়ে যেতেই হয়, এই সিরিজটা খেলা খুব জরুরি। এই চিন্তা থেকেই শাস্তি শেষ হওয়ার আগেই সাব্বির দলে। দ্বিতীয় ম্যাচে সাব্বিরের ৪৩ রানের ইনিংসটা নিয়েই গত পরশুই বলছিলেন, ‘৮০–৯০ রান করলে সাব্বির নিজেকে প্রমাণ করতে পারত। তারপরও ও যেভাবে ব্যাটিং করেছে, সেটি বুঝিয়ে দিয়েছে ও ১৫০–১৫৫ কিলোমিটার গতির বলও স্বচ্ছন্দে খেলতে পারে। এত গতির বল কে খেলতে পারে, কে পারে না, ২টা বল খেলতে দেখলেই তা বোঝা যায়।’
৮০–৯০ রানের একটা ইনিংস চেয়েছিলেন। সেখানে সাব্বির সেঞ্চুরিই করে ফেলেছেন! সাব্বিরের ওপর ধরা ‘বাজি’ জেতায় মাশরাফির চেয়ে বেশি খুশি আর কে হবেন! কিন্তু ওই উদ্যাপনটা মাশরাফির খুশির মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধিয়ে দিয়েছে। এটি যে তাঁর পছন্দ হয়নি, সংবাদ সম্মেলনে সেটি স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন। সঙ্গে সাব্বিরের জন্য একটা বার্তাও, ‘ওকে জিজ্ঞেস করায় ও বলল, “আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমার ব্যাট অনেক দিন পর কথা বলেছে।” জীবনের প্রথম সেঞ্চুরি, তার ওপর যা কিছুর মধ্য দিয়ে এসেছে, ও একটু বেশিই রোমাঞ্চিত ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতে ওকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। আশা করি, ও এই সেঞ্চুরিতেই থেমে থাকবে না। সামনে আমাদের অনেক খেলা। বাংলাদেশকে ওর আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে।’
প্রায় একই রকম উদ্যাপন আরেকটু বিস্তারিতও দেখেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। কী আশ্চর্য, যাঁর কল্যাণে, সেই তামিমও এটিকে সমর্থন করছেন না, ‘আমি বলব, সাব্বির ঠিক করেনি। খারাপ করলে মানুষ কথা বলবেই। ভালো করার পর তো সবাই দেখলই, তখন আর বাড়তি কিছু করার দরকার নেই।’ তাহলে তিনি নিজেই কেন এমন করেছিলেন? ২০১৫ বিশ্বকাপে সমালোচনায় জর্জরিত হয়ে দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই মিরপুরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করলেন। এরপর মাঠে ব্যাট রেখে সাব্বিরের মতোই সমালোচকদের উদ্দেশে ‘এবার বকবকানি একটু বন্ধ করুন’ ভঙ্গি।
সাব্বির করেছেন এক হাতে, তামিম করেছিলেন দুই হাতে। সেটি যে ঠিক হয়নি, তা বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি। সেবারও বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটা মাশরাফিই করেছিলেন। সেই শিক্ষাটা আর ভোলেননি তামিম, ‘আমি ড্রেসিংরুমে ঢুকতেই মাশরাফি ভাই আমাকে বলেছিলেন, “এটা তুই ঠিক করিস নাই।” মনে করে দেখুন, পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচেও সেঞ্চুরি করার পর আমি একটুও অন্য রকম কিছু করিনি।’
সাব্বিরও তাঁর ভুলটা বুঝতে পারবেন বলেই বিশ্বাস তামিমের। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁকে সেটি বুঝতে সাহায্যও করবেন, ‘এটা ওর প্রথম হান্ড্রেড। ও আরও অনেক হান্ড্রেড করবে। আমি ওকে অবশ্যই বলব, এমন কিছু করে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করার কোনো মানে হয় না।’ তামিমের দাবি, এমন কিছু আসলে আগে থেকে পরিকল্পনা করা থাকে না। মুহূর্তের উত্তেজনায় হয়ে যায়। সাব্বিরের সঙ্গে অবশ্য এখানে মিলছে না। কাল রাতে তিনি অবলীলায় জানিয়ে দিলেন, মুহূর্তের নিয়ন্ত্রণহীন উত্তেজনা নয়, এমন কিছু করার ইচ্ছা গত তিন বছর তিনি মনে জমিয়ে রেখেছিলেন! ‘সেঞ্চুরি করায় বেশি ভালো লাগছে। তবে তিন বছর ধরেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, ভালো একটা ইনিংস খেললেই এমন কিছু করব। কারণ আমাকে নিয়ে বেশি কথা হয়।’
আসলেই হয় এবং সে জন্য সাব্বির নিজেই দায়ী। তাঁর প্রতিভা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, প্রশ্নটা আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। যে কারণে একটা ‘রেকর্ড’ও করে ফেলেছেন। দুই দফা ছয় মাস করে নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের ক্রিকেটে কেন, বিশ্ব ক্রিকেটেও আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই নিষেধাজ্ঞায়ও কত বৈচিত্র্য! প্রথমবার এক সমর্থককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করায় ছয় মাসের জন্য ঘরোয়া ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হলেন। দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। এবার অপরাধ—ফেসবুকে এক সমর্থককে যা–তা ভাষায় গালাগালি করা।
সেঞ্চুরি করেও মানুষের মুখ বন্ধ করা যায়। তবে সেটি তো আর প্রতিদিন করার জিনিস নয়। সাব্বির নিজেকে একটু বদলানোর কথাও ভেবে দেখতে পারেন!