`এখন আর কোনো কিছুই অসম্ভব মনে করি না`

মোহাম্মদ আশরাফুলের একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

২০ জুন ২০২১

`এখন আর কোনো কিছুই অসম্ভব মনে করি না`

আগের দু`ম্যাচের পর অবস্থাটা এমন হয়েছিল যে, অনেকটা বাংলাদেশ দলের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অবিস্মরণীয় জয় এসেছে তাঁর সেঞ্চুরির কল্যাণে। পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বোলারদের তুলোধুনো করে ৫২ বলে ৯৪ রানের ইনিংসটি খেলার পর সবার মুখে মুখে তখন ওই একটিই নাম। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আবার খেলতে নামার আগে ওল্ড ট্রাফোর্ডে উৎপল শুভ্রকে এই বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন আশরাফুল।

প্রথম প্রকাশ: ২৫ জুন ২০০৫। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ-জেতানো সেঞ্চুরি, এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৪— আজ যখন ব্যাট করতে নামবেন, পুরো ক্রিকেট বিশ্বেরই দৃষ্টি থাকবে আপনার ওপর। এ অনুভূতিটা কেমন?

মোহাম্মদ আশরাফুল: আমি এ নিয়ে একটুও ভাবছি না। এমন কিছু করার লক্ষ্য নিয়েই আমি এখানে এসেছিলাম। এশিয়ায় সবাই অল্পবিস্তর আমার নাম জানে, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে ভালো করতে পারলে সারা বিশ্ব আমার নাম জানবে— এটাই বলেছিলাম নিজেকে। আসার আগে আমার স্যারও (কোচ ওয়াহিদুল গনি) বলেছেন, যেখানে খেলতে যাচ্ছ, সেখানে বিশ্বের সেরা দুটি দলের সঙ্গে খেলবে। সেখানে ভালো করতে পারলে তোমার অন্য রকম একটা পরিচিতি হবে।

শুভ্র: ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫২ বলে ৯৪-এর পর স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে?

আশরাফুল: না, স্যারকে ভয়ে ফোন করিনি। কারণ আমি জানি, উনি আমাকে বকাবকি করবেন। বলবেন, এভাবে কেউ শট খেলে?

শুভ্র: অধিনায়ক হাবিবুল বাশার আপনার ইনিংসের খুব প্রশংসা করার পর বলেছেন, আপনি যেন আর এ রকম খেলার চেষ্টা না করেন, কারণ এমন ইনিংস প্রতিদিনই খেলা যায় না।

আশরাফুল: ঠিকই বলেছেন। তবে এমন ইনিংস আবারও খেলতেই পারি। ওদিন যে এ রকম হবে, এটাও তো আমি আগে থেকে জানতাম না। ৩৫ রান করে ফেলার পর একবার মনেও হয়েছিল, এখন কি একটু থামব, নাকি এ রকমই চালিয়ে খেলব? চিন্তা করছিলাম, এখন আউট হয়ে গেলে সবাই বলবে, ৫০টাও করতে পারল না, উল্টাপাল্টা খেলে আউট হয়ে গেল। একবার থামতে চেষ্টাও করেছি, কিন্তু যা মারছিলাম, তা-ই যে লাগছিল!

প্রথম বলেই পেয়েছিলেন `লাইফ`। ছবিঃ গেটি ইমেজেস

শুভ্র: অস্ট্রেলিয়া তো আপনাকে চিনে ফেলেছে। আজ ব্যাট করতে নামার সময় একটু বাড়তি অভ্যর্থনা পাওয়া প্রায় নিশ্চিতই। এটা কি একটু চিন্তায় ফেলছে?

আশরাফুল: আমি এটা ভাবছিই না। শুধু ভাবছি, ১৫-২০টা রান হয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা নেই। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ওই ম্যাচটায় আমার ভালো খেলার একটা কারণ, কে বল করছিল আমি তা খেয়াল করিনি। আমি শুধু বল বুঝে খেলেছি। ইংল্যান্ডের সঙ্গে পরের ম্যাচে এটা আরো বেশি কাজে এসেছে। টেস্ট সিরিজে হার্মিসন বল করতে এলেই ভেবেছি, হার্মিসন এসেছে, ও এত লম্বা, আমি ডিফেন্সিভ খেলি। এ ম্যাচে আমি নিজেই নিজেকে বলেছি, হার্মিসন আসুক আর যে-ই আসুক, আমি শুধু বল দেখব।

শুভ্র: মাঝখানে দু'দিন প্র্যাকটিসে কী করেছেন? ফর্মে থাকলে তো বেশি কিছু করার দরকার হয় না, তার পরও নির্দিষ্ট কিছু নিয়ে কি কাজ করেছেন?

আশরাফুল: আউট হব না ঠিক করে নেটে ব্যাটিং করেছি। এর আগে ফর্মে থাকলে আমি বাড়তি কিছু করতে চাইতাম। হয়তো লেটকাট করতাম। এবার তা করব না, বল বুঝে খেলব। তবে মারার বল পেলে অবশ্যই মারব। এর আগে অনেকবার মারব, নাকি ঠেকাব— এমন চিন্তা করে ফুলটস বলেও আমি কট অ্যান্ড বোল্ড হয়ে গেছি।

শুভ্র: অস্ট্রেলিয়ার কোনো বোলারকে নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা আছে?

আশরাফুল: না, আমি নির্দিষ্ট কারো কথা ভাবছিই না। আমি শুধু নিজের খেলা নিয়ে ভাবছি।

শুভ্র: প্রত্যাশার চাপের সঙ্গে তো আপনার ভালোই পরিচয় আছে। পরপর দু'ম্যাচে এমন ব্যাটিংয়ের পর সেটি তো আবারও ফিরে এল।

আশরাফুল: এবার আমি চাপটা সেভাবে অনুভবই করছি না। অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির পরই আমি বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছিলাম। গিয়েই দেখেছি আমাকে নিয়ে হইচই। পেপারে নানা রকম লেখা। এখানে তো আর এসব নেই। কারো সঙ্গে সেভাবে মিশিও না। কথা যা বলি, তা এক আপনাদের (সাংবাদিকদের) সঙ্গেই।

একদম তুলোধুনো করে ছেড়েছিলেন ইংলিশদের। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: প্রশ্নটা হয়তো ছেলেমানুষী হয়ে যাচ্ছে, তার পরও করি, আবারও অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব?

আশরাফুল: এখন আর আমরা কোনো কিছুই অসম্ভব মনে করি না। প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর কথা আমরা কল্পনাও করিনি। ২৪৯ চেজ করে জিতব, মাথায় এ ধরনের চিন্তাই ছিল না। সিরিজ শুরুর আগে মনে হয়েছিল, আমরা শুধু খেলার জন্য খেলছি। ৬টা ম্যাচ আছে, খেলতে হবে, এটুকুই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেওয়ার পর ইংল্যান্ডকে হারানোও এখন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। ভালো খেলতে পারলে যেকোনো দলের সঙ্গেই জিততে পারি— এ বিশ্বাসটা আমাদের এসেছে।

শুভ্র: অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ে অধিনায়কের সঙ্গে আপনার ১৩০ রানের পার্টনারশিপটির অনেক বড় ভূমিকা। মাঠের বাইরেও তাঁর সঙ্গেই তো আপনি ব্যাটিং নিয়ে বেশি আলাপ করেন। তা অধিনায়ক হিসেবে হাবিবুল বাশারকে কেমন লাগে?

আশরাফুল: সুমন (হাবিবুল) ভাইকে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচিউরড মনে হয়। আগে উনি নিজের ব্যাটিং নিয়েই বেশি ভাবতেন, এখন টিম নিয়ে অনেক বেশি ভাবেন। আগে ওনাকে এত চিন্তা-ভাবনা করতে দেখিনি। মাঠের বাইরেও উনি আমাকে খুব সাহায্য করেন। টেস্ট সিরিজে খারাপ করার পর আমার মনে হয়েছিল, আমাকে বোধ হয় প্রথম দু-তিনটি ওয়ানডেতে খেলানো হবে না। দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে বাজে শট খেলে আউট হওয়ার দু'দিন পর উনি আমাকে ডেকে বললেন, আমার খুব মেজাজ গরম হয়েছে বলে তোর সঙ্গে কথা বলিনি, তবে আমি জানি তুইও খুব আপসেট। এরপর উনি দলে আমার গুরুত্বটা বোঝালেন। যেভাবে বুঝিয়েছেন, সেটি আমার খুব ভালো লেগেছে।

ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আপনার ওই ইনিংস দেখে পল কলিংউডের মনে হয়েছে, এটা টেন্ডুলকারের ব্যাটিং। টেন্ডুলকারের ভক্ত হিসেবে এটা তো আপনার জন্য বড় এক কমপ্লিমেন্ট, তাই না?

আশরাফুল: এখনো আমি টেন্ডুলকারের ভক্ত। তবে ইদানীং লারার খেলা দেখতে বেশি মজা লাগে। যত বয়স হচ্ছে, লারা দেখি উল্টো আরও বেশি মেরে খেলছে। টেন্ডুলকারকে আলাদা মনে হয়, কারণ ১০০ কোটি মানুষের চাপ মাথায় নিয়ে যেভাবে খেলে, সেটাই আমার বেশি অবাক লাগে। আমাদের তো ১৪ কোটি মানুষ, তাতেই প্রেসারে মাথার চুল পেকে যাচ্ছে!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×