‘কার্ডিফ কাব্য’ বদলে দিল বাংলাদেশের সব কিছু
কার্ডিফ রূপকথা, রূপকথার কার্ডিফ-৭
উৎপল শুভ্র
১৮ জুন ২০২১
যেরকম খেলছিলেন, তাতে আশরাফুলেরই বিশ্বাস ছিল না, ওরকম ইনিংস তিনি খেলতে পারেন। অধিনায়ক নিজেও বিশ্বাস করেননি, তাঁর দল এমন পৃথিবী তোলপাড় করে দেওয়া কিছু করতে পারে। সেই অবিশ্বাস্য জয়ের অন্য মাহাত্ম্যও ছিল। সেই ইংল্যান্ড সফরের শুরু যেমন `অপরাধী` সেজে ঘুরতে হতো বাংলাদেশ দলকে, যেন ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ গিয়েছে দয়া-দাক্ষিণ্যে, তা বদলে গিয়েছিল এই একটি জয়েই।
ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আপসেট বলা হচ্ছিল। কাল দেখলাম, ইংল্যান্ডের কিছু পত্রিকা প্রশ্ন তুলেছে, শুধু ক্রিকেট কেন, সব খেলা মিলিয়েই কেন এটিকে সবচেয়ে বড় আপসেট বলা হবে না?
বাংলাদেশের আপত্তি করার কিছু নেই। যত বড় আপসেট বলা হবে, ‘কার্ডিফ কাব্যের’ মহিমা তো ততই বাড়বে। টেস্ট সিরিজ শুরু হওয়ার পর পত্রিকা পড়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন হাবিবুল বাশার। কাল আবার পড়লেন। যে পত্রিকাগুলোতে বাংলাদেশের জন্য এত দিন শ্লেষ-কটাক্ষ-সমালোচনা ছাড়া কিছুই থাকত না, সেগুলোতেই কাল বিশেষণে টান পড়ে যাওয়ার মতো প্রশংসা। এই প্রথম সফরটাকে খুব দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে না বাংলাদেশ-অধিনায়কের।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাঠের জয়টা অবশ্যই এগিয়ে থাকবে, তবে ইংলিশ মিডিয়াকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রশংসা করতে বাধ্য করাটাও কম বড় জয় নয়। সংবাদ সম্মেলনের নামে যাঁকে রীতিমতো আসামির কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে হতো, গত পরশু অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর সেই হাবিবুল বাশারের জন্য স্থানীয় মিডিয়ার অধীর অপেক্ষা। ড্রেসিংরুমের উদযাপনের একটি মুহূর্তও মিস করতে চাননি বলে সংবাদ সম্মেলনে আসতে বেশ দেরি হলো। সবাই বসে থাকলেন তাঁর জন্য। কয়েকজন উঠে গিয়ে হাতও মেলালেন। সফরের শুরু থেকে বাংলাদেশের যে অমন তুমুল সমালোচনা হয়েছে, তাতে অধিনায়কের খারাপ লেগেছে কি না, এত দিনে তা জিজ্ঞেস করারও সময় হলো এক ইংরেজ সাংবাদিকের। রাগ-ক্ষোভ-অপমান মনেই চেপে রেখে ভদ্রতার প্রতিমূর্তি হয়ে থাকলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, ‘খারাপ তো লাগেই। তবে আমরা জানি সমালোচনা থামাতে হলে আমাদের ভালো খেলতে হবে।’
হাবিবুল বলতেই পারতেন, ‘যেমন খেললাম আজ!’ কীভাবে বলবেন, তখনো যে তিনি বিস্ময়ের ঘোরে। ম্যাচ শেষ হওয়ার ছয় ঘণ্টা পর তাঁর হোটেল-রুমে গিয়েও হকচকিত হাবিবুলেরই দেখা মিলল। বারবার বললেন, ‘সত্যি বলছি, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না! আমরা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়েছি!’ পুরো দলের একই অবস্থা। খালেদ মাসুদ জানাচ্ছেন, শেষ ওভারটি শুরু হওয়ার সময়ও তিনি জয়ের কথা ভাবতে পারছিলেন না, ‘দলটার নাম অস্ট্রেলিয়া বলেই আমি ভয় পাচ্ছিলাম। একটা উইকেট নিতে পারলেই ওরা ফিরে আসতে পারে। বাংলাদেশ কেন, আরও অনেক বড় বড় দলের বিপক্ষেও তো এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে জিতেছে।’
‘আমি আগেই বলেছিলাম’— তা বলতে পারেন শুধু বাংলাদেশ দলের একজনই। খালেদ মাহমুদ। ওয়ানডে সিরিজের আগে ইংল্যান্ডে এসেই বলেছিলেন, ‘আমরা একটা আপসেট ঘটিয়েও ফেলতে পারি।’ গত পরশু রাতে হোটেলের সামনে দেখা হতেই মনে করিয়ে দিলেন কথাটা। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপনারা তো বাংলাদেশ দলকে দাম দেন না। দেখলেন তো!’
পুরো বিশ্বই দেখেছে। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত জয়টি পাওয়ার পর খেলোয়াড়দের যে রকম উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে দেখব বলে ভেবেছিলাম, তার কিছুই দেখা গেল না। ড্রেসিংরুমে তুমুল হইচই-আনন্দ হয়েছে। সেটি তো জিম্বাবুয়েকে হারালেও হয়। হোটেলে ফেরার পর স্থানীয় এক বাংলাদেশি-রেস্টুরেন্টে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে হয়েছে। সেখান থেকে ফেরার পর খেলোয়াড়দের বেশির ভাগই যে যাঁর রুমে। খালেদ মাহমুদের নেতৃত্বে শুধু একটু ঘুরে আসতে গেছেন খালেদ মাসুদ, আশরাফুল, মানজারুল আর শাহরিয়ার নাফীস। ডেভ হোয়াটমোর যে বলছেন, ‘আমাদের মাটিতে পা রাখতে হবে’, কারণ কি এটাই? হাবিবুল জানাচ্ছেন, আসল কারণ ক্লান্তি। ইংল্যান্ডে এসে এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে এমন দৌড়াতে হচ্ছে যে, হোটেলে ফিরেই নাকি ঘুমের রাজ্যে চলে যান খেলোয়াড়রা। তাই বলে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পরও কোনো উৎসব হবে না!
সেটি না হওয়ার কারণও ওই ভ্রমণ। পরদিন বেলা ১১টায়ই যে আবার বাসে উঠতে হবে। এবারের গন্তব্য নটিংহাম। আগামীকাল নটিংহামের ট্রেন্টব্রিজেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচ। বাংলাদেশকে যে প্রমাণ করতে হবে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়টা ‘ফ্লুক’ ছিল না।