অধিনায়কের নিজেরই তো বিশ্বাস হচ্ছে না!
কার্ডিফ রূপকথা, রূপকথার কার্ডিফ-৫
উৎপল শুভ্র
১৮ জুন ২০২১
ম্যাচ শেষ হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ছয় ঘণ্টা। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় তখনো তাঁকে বিস্ময়ের ঘোর থেকে বেরোতে দিচ্ছে না। হোটেল রুমে উৎপল শুভ্রর কাছে নির্দ্বিধায় স্বীকার করছেন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, ‘এখন আমি বলতেই পারি যে, খেলা শুরুর আগেই আমার বিশ্বাস ছিল আমরা একটা কিছু করে ফেলতে পারি। কিন্তু তা বললে মিথ্যা বলা হবে। দলের যে অবস্থা ছিল, তাতে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।`
ক্রিকেট বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়ার ছয় ঘণ্টা পর তাঁর হোটেল রুমে বসে হাবিবুল বাশার স্বীকার করলেন, যা হয়েছে সেটি তার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না! হল্যান্ড হাউস হোটেলের চৌদ্দ তলায় তাঁর রুম, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে আলো-ঝলমল কার্ডিফের রাত। সেদিকে তাকিয়ে আনমনা হাবিবুল বারবার নিজেই যেন নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই কি আমরা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়েছি!
দ্বিতীয় টেস্টের মাঝামাঝি থেকেই অধিনায়ক সপরিবারে ইংল্যান্ডে। রাত ১২টায় হঠাৎ হাজির হওয়া দুই সাংবাদিককে দেখে তাঁর স্ত্রী শাওন একটুও বিরক্ত নন। বরং ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আপ্যায়নে। অন্যদিন হলে কী হতো, কে জানে! কিন্তু এ এমন এক দিন (অথবা রাত), কোনো কিছুই যখন খারাপ লাগছে না। ‘ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারেই লাগে ভালো’র মতো অবস্থা।
অধিনায়কের তিন বছর বয়সী পুত্র অহন তখন খেলনা পিস্তল দিয়ে ‘শত্রু' নিধনে ব্যস্ত। নতুন দুই ‘টার্গেট’ পেয়ে তাঁদের দিকেও ছুটে এল এক পশলা অদৃশ্য গুলি। একটু আগে অস্ট্রেলিয়াকে বধ করে এলে কী হবে, হাবিবুল বাশারও তাঁর হাত থেকে রেহাই পেলেন না। ছেলের মুখে ‘ঢিসুম’ ‘ঢিসুম’ গুলির আওয়াজ শুনে তাঁকেও বেঘোরে মারা পড়ার অভিনয় করতে হলো। অভিনয়ে ছেলে মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়েছে বুঝতে পেরে অহনকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বললেন, ‘গত কিছুদিন এমন খারাপ সময় গেছে যে, ছেলেটা কাছে ছিল বলে তা-ও কিছুক্ষণের জন্য সব ভুলে যেতে পেরেছি।’
যেটি জীবনেও ভুলবেন না, সেই অস্ট্রেলিয়া-বধ অবশ্য তখনো তাঁকে বিস্ময়ের ঘোর থেকে বেরোতে দিচ্ছে না, ‘এখন আমি বলতেই পারি যে, খেলা শুরুর আগেই আমার বিশ্বাস ছিল আমরা একটা কিছু করে ফেলতে পারি। কিন্তু তা বললে মিথ্যা বলা হবে। দলের যে অবস্থা ছিল, তাতে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।’
গল্প-উপন্যাস পড়ার অভ্যাস আছে। সে কারণেই হয়তো আছে কল্পনাপ্রবণ একটা মনও। ‘মানুষ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে, আর আমি জেগে জেগেও দেখি। প্রায়ই কল্পনা করি, ডাবল সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশকে টেস্ট জেতাচ্ছি, শেষ বলে ছক্কা মেরে জেতাচ্ছি ওয়ানডে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া! না, অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর কথা আমি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি’— স্বপ্নও যার নাগাল পায় না, সেটিই পেয়ে গেলে কেমন লাগে, হাবিবুলকে দেখেই তা বোঝা যাচ্ছিল পরিষ্কার।
শুধু তো অস্ট্রেলিয়াকে হারানোই নয়, যেভাবে হারিয়েছে বাংলাদেশ, সেটি তো রীতিমতো ক্রিকেট রূপকথা। রূপকথায় এর চেয়ে অভাবিত আর কী থাকে! হাবিবুল তাই স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৪৯ রান চেজ করে জেতা! সত্যি বলছি, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। আজ আমরা যেভাবে ব্যাট করলাম, তাতে আমি নিজেই অবাক। আস্কিং রেট ছয়ের ওপরে চলে গেলে আমরা কখনোই পারি না। এমনকি জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ঢাকায় পর্যন্ত পারিনি। আর এখানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আস্কিং রেট সাত-আট হয়ে যাওয়ার পরও আমরা জিতেছি!’ হাবিবুল হাসেন। সেই হাসিতে তৃপ্তির সঙ্গে পরিষ্কার খুঁজে পাওয়া যায় বিস্ময়ের ঘোর।
অস্ট্রেলিয়াকে ২৪৯ রানে আটকে দিয়ে ব্যাট করতে নামার সময়ও বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে কারো মনে হয়নি, এই ম্যাচটা জেতা যেতে পারে। মনে হবেই বা কীভাবে, চেজ করা বাদ দিন, ভুলে যান অস্ট্রেলিয়ার কথাও। এর চেয়ে অনেক দুর্বল প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রথম ব্যাট করেই বা কবার ২৫০ করেছে বাংলাদেশ? আশরাফুলের সঙ্গে তাঁর ১৩০ রানের পার্টনারশিপটি যখন এত দিন অদৃশ্য হয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ডিংয়ের ফাঁক-ফোকরগুলো প্রকাশ্যে নিয়ে আসছে, এমনকি তখনো জয়ের কথা ভাবেননি হাবিবুল, ‘আশরাফুলকে আমি কখনোই জয়ের কথা বলিনি। ওকে শুধু বলেছি, ম্যাচে কী হবে, ভুলে যা। আমরা ভালো ব্যাট করছি, করে যাই। স্কোরবোর্ডের দিকে তোর তাকানোরই দরকার নেই। পঁয়ত্রিশ ওভারের পর প্রথম ওকে বলেছি, চল, এখন থেকে ওভারে পাঁচ-ছয় করে নিতে হবে।’
নিজে যখন রান আউট হয়ে গেলেন, তখনো প্রয়োজন ৩৭ বলে ৪৮ রান। ততক্ষণে অবশ্য জয়ের স্বপ্নটাকে দিগন্তে আভা ছড়াতে দেখছেন অধিনায়ক। আফতাবকে শুধু বলেছেন, একেবারে অলআউট অ্যাটাকে না যেতে, ‘এর আগে অনেকবারই আস্কিং রেট ছয়ের ওপর চলে গেলে সব বলেই চালিয়ে খেলে আউট হয়ে এসেছি আমরা। এ কারণেই আফতাবকে সাবধান করে দিয়েছিলাম।’
শেষ ওভারের প্রথম বলেই আফতাব যখন ছয়টা মারলেন, ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে তখন রীতিমতো নৈরাজ্য! কে কী করেছেন, কারোরই তা মনে নেই। হাবিবুলেরও নেই। জয়সূচক রানটি নিতে আফতাব যখন দৌড় শুরু করেছেন, হাবিবুল এক দৌড় দিয়েছেন মাঠের দিকে। বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে অনেকটা জায়গা লম্বালম্বি ছড়ে গিয়ে লাল হয়ে আছে, সেখানে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘কখন যে এখানে লেগেছে, টেরও পাইনি।’
উৎসব যা হওয়ার ড্রেসিংরুমেই হয়েছে। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারের সঙ্গে শ্যাম্পেনের যে বোতলটি পেয়েছেন আশরাফুল, সেটি খুলে ভিজেছেন সবাই। আর করেছেন গালাগালি! গালাগালি কেন? হাবিবুল সলজ্জ হেসে বললেন, ‘ওটা প্ল্যান করে করিনি। অনেকের ওপর আমাদের রাগ ছিল। এত কথা শুনতে হয়েছে! খারাপ সময়ে আমরা কাউকে পাশে পাই না।’
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের যে ১০টি জয়, তার ৭টিই হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ১৮ বছরে ৩টি জয় আর গত ১৫ মাসেই ৭টি! হাবিবুল বাশার আঙুলের কড় গুনে জয়ের হিসাব করেন, তারপর হঠাৎ অভিমানে একটু কাঁপতে থাকা গলায় বলেন, ‘তারপরও তো অনেকে বলে, আমি নাকি ভালো অধিনায়ক না।'