সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই পুনর্জন্ম

উৎপল শুভ্র

১৫ জুন ২০২১

সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই পুনর্জন্ম

প্রত্যাবর্তনেই ম্যাচসেরা রাজ্জাক। ছবি: এএফপি

তাঁর অভিষেক হওয়ার কথা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজেই। তবে ম্যাচের দিন সকালে স্পিনারের বদলে পেসার খেলানোর সিদ্ধান্তে প্রথম ম্যাচটা পিছিয়ে যায় ২০০৪ এশিয়া কাপ পর্যন্ত। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাঁকে অভিষেকের স্বাদ দিয়েছিল ঠিকই। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বোলিং অ্যাকশন অবৈধ ঘোষিত হলে ফিরেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই। আর প্রত্যাবর্তনটাও রাজসিক, উইকেট নিয়েছিলেন প্রথম বলেই। ৩৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচসেরাও।

প্রথম প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।

সেবার ছিল শুধু আসা-যাওয়া। বাংলাদেশ দলের হয়ে প্রথম সফর। পরদিন ওয়ানডে অভিষেক হবে বলে সব ঠিকঠাক। সকালে বৃষ্টিতে ম্যাচ সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত হলো, স্পিনারের বদলে একজন বাড়তি পেসার নিয়ে খেলবে বাংলাদেশ। একটা ম্যাচও না খেলেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ফিরে যেতে হলো তাঁকে।

পাঁচ বছর পর আবার যখন সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে, ৮১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে। মাঝের সময়টায় অনেকবারই মিলেছে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সেরা বোলারের স্বীকৃতি। তার পরও এ যেন নতুন করে শুরু। সেই শুরুটা এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারত! প্রথম বলেই উইকেট। এরপর আরও তিনটি। ম্যান অব দ্য ম্যাচও। যে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই পুনর্জন্ম হলো আবদুর রাজ্জাকের।

‘ভালোভাবে কামব্যাক করতে চেয়েছিলাম। তবে মনের মধ্যে কী হয়, না হয় একটা দুশ্চিন্তা ছিলই। বাংলাদেশ জিতেছে, আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ—সব মিলিয়ে মনে হয় না এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারত’—রাজ্জাকের কণ্ঠে যত না খুশি, তার চেয়ে বেশি স্বস্তি।

মাঝে প্রায় এক বছর যে তাঁর জীবনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। অনেক কথা শুনতে হয়েছে। 'অ্যাকশন বদলে ও আর আগের মতো বল করতে পারবে না, ও শেষ হয়ে গেছে'—এই পারফরম্যান্সেই সবাইকে জবাব দিয়ে দেওয়া হলো, এমন অবশ্য মোটেই বলছেন না, ‘কেউ আর শত্রুতা করে ওসব বলেনি, মনে হয়েছে বলেছে। তবে আমার ওই বিপর্যস্ত অবস্থায় ওসব কথা আমার খুব খারাপ লাগত।' ওই ঘোর বিপদে কতজন যে পাশেও এসে দাঁড়িয়েছে—সেই কৃতজ্ঞতাতে ভারী হয়ে যায় রাজ্জাকের কণ্ঠ, অনেক মানুষ সাহায্য করেছে। সালাউদ্দিন ভাই আমাকে নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। সব সময় সাহস দিয়েছেন। জেমিও (সিডন্স) বলেছে, তুমি ভালোভাবেই ফিরে আসবে। দলের সবাই পাশে ছিল।' বাংলাদেশ দলে নেওয়ার সময়ই তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে ফিসফাস ছিল। রাজ্জাকের দলে আসায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা ফারুক আহমেদের। বিমানে এক দলে খেলার সময়ই দেখেছেন, রাজ্জাককে মারা কত কঠিন। প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পেয়েই তিনি তাই দায়িত্ব মনে করেছেন রাজ্জাককে ওয়ানডে দলে নেওয়াটাকে। অ্যাকশন নিয়ে তাঁর মনেও অবশ্য একটু খুঁতখুঁতানি ছিল। রাজ্জাকের বোলিং সামর্থ্যে অসীম আস্থা ছিল বলেই ‘খেলিয়ে দিই, তারপর দেখা যাবে কী হয়’ ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। ঝুঁকিটা কাজে লেগেছে বলে এখন প্রমাণিত। যদিও শুরুতেই তা কেচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ২০০৪ সালে শ্রীলঙ্কা এশিয়া কাপে অভিষেক, বোলিং অ্যাকশন নিয়ে আম্পায়ার-ম্যাচ রেফারির প্রথম আপত্তিও সেখানেই।

অনেক দিন খেটেখুটে সব ঠিকঠাক করে আবার ফিরলেন। গত বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজে লাল কালির দাগ পড়ল তাঁর নামের পাশে। আবার ফেরার সংগ্রাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেটে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে কাজ করো, অস্ট্রেলিয়ায় যাও, পরীক্ষা দাও... কী যে সময় গেছে! মনে করে এখনো শিউরে ওঠেন রাজ্জাক, 'জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিল এটি। ক্রিকেট তো আমার কাছে শুধু খেলাই না, সবকিছু। ক্রিকেট-ক্রিকেট করে পড়াশোনা যতটুকু করেছি, ওই পড়াশোনাতে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। ক্রিকেট খেলতে না পারলে তো আমার জীবনই শেষ।'

ছবি: উৎপল শুভ্র

যেনতেনভাবে খেললেও চলবে না। ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ দশে স্থান পাওয়া বাংলাদেশের প্রথম বোলার তিনি। রাজ্জাকের কাছে সবার প্রত্যাশা যেমন বেড়ে গেছে, তাঁর নিজের কাছে নিজের প্রত্যাশাও। মাঝখানে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলেছেন, তবে সত্যিকার ফেরা মনে করেন এই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই। সেটি শুধু এখানে ভালো করলেন বলে নয়, 'টি টোয়েন্টিকে আমি গোনায় ধরি না। ওখানে ভালো বলেও ব্যাটসম্যান মেরে দেয়। আর আমার ওই মানসিক অবস্থায় আমি কীভাবে ভালো করব?'

ওয়ানডেতে এর আগে ১১১ উইকেট, তবে গত পরশু প্রথম বলেই উইকেটটির আনন্দ যেন আগের ১১১ উইকেটের সমান! ‘আমি বলটা শুধু উইকেটে রাখতে চেয়েছিলাম। নতুন বল, জানতাম টার্ন করবে না। তবে স্কিড করবে। প্যাডে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেছি, আউট! কী যে স্বস্তি তা বলে বোঝাতে পারব না।'

ওয়ানডেতে এর আগে ৪ উইকেট নিয়েছেন আরও একবার, একবার ৫ উইকেটও। তবে তা স্কটল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বগুড়ায় ৩৩ রানে ৫ উইকেটেই এর আগে ওয়ানডেতে একমাত্র ম্যান অব দ্য ম্যাচের স্বীকৃতি। প্রতিপক্ষ বিবেচনায় এমনিতেই সেটি পেছনে পড়ে যেত। এখানে যোগ হচ্ছে পেছনে ফেলে আসা দীর্ঘ তমসাময় দিনরাত্রি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়—এটাকেই তাই মানছেন ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য বলে।

নতুন করে যে শুরুর কথা বলছেন, সেটিকে নিচ্ছেন আক্ষরিক অর্থেই। বোলিং অ্যাকশনে সমস্যা তো শুধু হাত সোজা-বাঁকার ব্যাপার নয়, রানআপ ডেলিভারি শরীরের অবস্থান আরও কত জটিলতা জড়িয়ে এর সঙ্গে। শুধু বলের লাইন-লেংথ আর টার্ন নিয়ে ভাবলেই তাই চলছে না, রাজ্জাকের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত দেখে নিতে হচ্ছে নিজেকে—সব ঠিক আছে তো?

গত পরশুর ওই পারফরম্যান্সের সবচেয়ে বড় মহিমা এটাই—এ সবও আর ঝামেলা বলে মনে হচ্ছে না আবদুর রাজ্জাকের!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×