দুই ড্রপ খাওয়া বলে আউট ডি ভিলিয়ার্স!

উৎপল শুভ্র

১০ জুন ২০২১

দুই ড্রপ খাওয়া বলে আউট ডি ভিলিয়ার্স!

দুবার ড্রপ খাওয়া বলে এবি ডি ভিলিয়ার্সকে আউট করার পর বোলার মোহাম্মদ আশরাফুলের আনন্দটা একটু বেশিই। ছবি: গেটি ইমেজেস

গলির ক্রিকেটে অহরহই হয়, তাই বলে টেস্ট ক্রিকেটে? বোলারের বল দুই ড্রপ খেয়ে ব্যাটসম্যানের কাছে যাবে, আর ব্যাটসম্যান তা মারতে গিয়ে বোলারকে রিটার্ন ক্যাচ দিয়ে বসবেন! এমন কি আসলেই হতে পারে? শুধু হতে পারে নয়, হয়েছেও। এবং তা স্বচক্ষেই দেখা। ২০০৮ সালের মিরপুর টেস্টে `বিখ্যাত` সেই বলটা করেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। ব্যাটসম্যান তার চেয়েও বিখ্যাত–এবি ডি ভিলিয়ার্স। যিনি ভেবেছিলেন, ওটা নো বল হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার পুরো দলই তা-ই।

প্রথম প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। প্রথম আলো।

টেলিফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এল মোহাম্মদ আশরাফুলের প্রাণখোলা হাসি। ১৯২ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার পরও প্রথম ইনিংসে ২২ রানের লিড নেওয়া গেছে। দ্বিতীয় দিন শেষে ঢাকা টেস্ট সেজেগুজে বসে আছে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের স্মরণীয়তম হয়ে ওঠার সব প্রতিশ্রুতি নিয়ে। বাংলাদেশ-অধিনায়ক তো হাসবেনই।

তবে মোহাম্মদ আশরাফুলের ওই হাসি ম্যাচের পরিস্থিতি মনে করে নয়। একটা প্রশ্নের উত্তরে। প্রশ্নটা ছিল—‘ওই বলটাই আপনি নিয়মিত করেন না কেন?’ ‘ওই বলটা’ মানে কোন বলটা তা এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, জেনে গেছে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। ‘ওই বল’-এর কারণেই ক্রিকেটের আইন নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি হলো। শাহাদাতের দুর্দান্ত বোলিং, দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ের তাসের ঘর হয়ে যাওয়া, বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখানো জুনায়েদের অপরাজিত ৬৪—সব ছাপিয়ে কাল মিরপুর স্টেডিয়ামে সবচেয়ে আলোচিত হয়ে থাকল ‘ওই বল’টাই।

ম্যাচে মোহাম্মদ আশরাফুলের প্রথম বল। হাফ ভলিতে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিলেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। আশরাফুল নিজেই দৌড়ে গিয়ে নিলেন ক্যাচটি। এ আর এমন কি! হাফ ভলিতে কোনো ব্যাটসম্যান কি আর এই প্রথম আউট হলেন নাকি!  হাফ ভলিতে প্রথম নয়, কিন্তু ব্যাটসম্যানের ব্যাটে হাফ ভলি হওয়ার আগে বল আরও একবার বাউন্স করার ঘটনা বোধহয় টেস্ট ক্রিকেটে এটাই প্রথম।

ক্রিকেটের বোলিং বর্তমান রূপে আসতে পাড়ি দিয়েছে অনেক বিবর্তন। একসময় বোলাররা বল গড়িয়ে দিতেন, সেখান থেকে ‘লব’ বোলিং, সাইড আর্ম হয়ে আজকের ওভার আর্ম। বল দুবার বাউন্স করে ব্যাটসম্যানদের কাছে পৌঁছানোর ঘটনা টেস্ট ক্রিকেটে এটাই প্রথম ঘোষণা করে দেওয়াটায় তাই ঝুঁকি আছে। তবে ডব্লু জি গ্রেসের আমলকে বিবেচনার বাইরে রাখলে হয়তো বলাই যায়। টেস্ট ক্রিকেটের আধুনিক যুগে এমন ঘটনার আর কোনো উদাহরণ তো খুঁজে পেলাম না।

ইতিহাস ঘাঁটতে যাওয়ার মানেই হলো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এমন কিছু নেই। শুধু আমার কেন, ডি ভিলিয়ার্সের নেই, মোহাম্মদ আশরাফুলের নেই, নেই জেমি সিডন্সেরও। ছোটবেলায় পাড়ার ক্রিকেট তো আর বিবেচনাযোগ্য নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন কিছু তাঁরা তো দেখেনইনি, শোনেননি পর্যন্ত।

রিটার্ন ক্যাচ নেওয়ার পর উল্লসিত মোহাম্মদ আশরাফুল। হতভম্ব ডি ভিলিয়ার্সের মুখটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে না। মিরপুর, ২০০৮। ছবি: গেটি ইমেজেস

সবার কথা শুনেটুনে মনে হচ্ছে, আশরাফুলের ‘ওই বল’ না আরেক লেগ স্পিনারের ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’র প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যায়! ১৯৯৩ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে ইংল্যান্ডের মাটিতে শেন ওয়ার্নের প্রথম বলটি লেগ স্টাম্পের ফুট দেড়েক বাইরে পিচ পড়ার পর টার্ন করে ভেঙে দিয়েছিল মাইক গ্যাটিংয়ের অফ স্টাম্প। ‘সেরা বল’ বিবেচনায় যদি ওয়ার্নের ওই বলটিকে ‘শতাব্দী-সেরা’ বলা হয়, ‘আলোচিত বল’ বিবেচনায় আশরাফুলের ‘ওই বল’টিকেও তা বলা যাবে না কেন? অবশ্য বললে ‘না’ করছে কে! ওয়ার্নের বলকে ‘শতাব্দী-সেরা’ বানিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব ইংলিশ মিডিয়ার। আশরাফুলের বলটির ক্ষেত্রে সে দায়িত্বটা না হয় আমরা মানে বাংলাদেশের মিডিয়াই নিয়ে নিই!

কী বলছে সেই আইন? বলছে—আম্পায়ার ‘নো বল’ ডাকবেন, যদি বোলার বল করার পর তা ব্যাটসম্যানের ব্যাট, শরীর বা অন্য কোনো কিছুতে লাগার আগে তাঁর কাছে পৌঁছাতে দুবারের বেশি বাউন্স করে বা শুরু থেকেই গড়িয়ে যায়।

এটা রসিকতা। এবি ডি ভিলিয়ার্সের কাছেও পুরো ব্যাপারটা রসিকতা বলেই মনে হচ্ছিল। রসিকতা, তবে নির্মম রসিকতা। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও ছিলেন, পরে কথা বলেছেন আম্পায়ারের সঙ্গেও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার মানেই ক্রিকেট-আইন সম্পর্কে পণ্ডিত, এমন ভাবলে ভুল করবেন। বিখ্যাত সব ক্রিকেটারের ক্রিকেট আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার বিস্ময়কর সব উদাহরণ আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ওপেনার ডেসমন্ড হেইন্স তো একবার হাত দিয়ে স্টাম্পমুখী বল ফিরিয়ে দিয়ে ‘হ্যান্ডলড্ দ্য বল’ আউট ঘোষিত হওয়ার পর আম্পায়ারের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিলেন! 

ডি ভিলিয়ার্সের মতো ড্রেসিংরুমের সামনে গ্রায়েম স্মিথ ও মাইক আর্থারের প্রতিক্রিয়াও সেই পুরোনো সত্যিটা আবারও প্রমাণ করল। তবে কালকের ঘটনায় তাঁদের একটু ছাড় দিতে হচ্ছে। যে ঘটনা টেস্ট ইতিহাসেই আর ঘটেছে কি না আলোচনা করছি, তা নিয়ে ডি ভিলিয়ার্স-স্মিথরা অজ্ঞ থাকতেই পারেন। ক্রিকেটের ২৪ নম্বর আইনটি যে এর আগে পড়ে দেখারই প্রয়োজন পড়েনি কখনো। কী বলছে সেই আইন? বলছে—আম্পায়ার ‘নো বল’ ডাকবেন, যদি বোলার বল করার পর তা ব্যাটসম্যানের ব্যাট, শরীর বা অন্য কোনো কিছুতে লাগার আগে তাঁর কাছে পৌঁছাতে দুবারের বেশি বাউন্স করে বা শুরু থেকেই গড়িয়ে যায়।

সংবাদ সম্মেলনে আসার আগে ডি ভিলিয়ার্সও নিশ্চয়ই আইনটা জেনেছেন। এ কারণেই দুবার বাউন্স করা বলে আউট হওয়াটাকে ‘অন্যায়’ বললেও বলার সময় তাঁর মুখে কোনো বিরাগের চিহ্ন নেই; বরং হাসি, ‘আমি আশা করছিলাম, যদি কেউ নো বল ডাকে!’ ডাকলে তো স্টিভ বাকনরকেই ডাকতে হতো। গত কিছুদিন বিতর্কের প্রতিশব্দ হয়ে থাকা জ্যামাইকান আম্পায়ারের কপাল ভালো, হয়তো ক্যারিয়ারেই কোনো দিন প্রয়োজন না হওয়া ওই ২৪ নম্বর আইনটা তিনি ভুলে যাননি!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×