কার্ডিফে মাশরাফিরা, মন এজবাস্টনে
সেমিফাইনালে যাওয়ার আগে
উৎপল শুভ্র
৯ জুন ২০২১
আগের দিন নিউজিল্যান্ডকে ৫ উইকেটে হারিয়ে নিজেদের কাজটা সেরে রেখেছিল বাংলাদেশ। অপেক্ষা করছিল বার্মিংহাম যাওয়ার জন্য। দেশের বিমানে চড়তে, কিংবা সেমিফাইনালে খেলতে--বার্মিংহামে যেতেই হতো বাংলাদেশকে। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচের ফলটা কী হয়, তার ওপর তখনো নির্ভর করছিল বাংলাদেশের ভাগ্য।
প্রথম প্রকাশ: ১১ জুন ২০১৭। প্রথম আলো।
যদি ভেবে থাকেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কাল সারা দিন টিভির সামনে বসে ছিলেন, তাহলে ভুল ভেবেছেন। মনটা সবার ১১৭ মাইল দূরের বার্মিংহামেই ছিল, তবে হোটেলে দল বেঁধে খেলা দেখার কোনো আয়োজন ছিল না।
আশ্চর্য এক ম্যাচ হলো বার্মিংহামের এজবাস্টনে। খেলছিল ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া। তবে অদৃশ্য হয়ে বাংলাদেশও ছিল এই ম্যাচে। ইংল্যান্ড যেন এখানে বাংলাদেশের ‘ছায়া দল’। ইংল্যান্ড জিতলে বাংলাদেশ ‘জিতবে’। ইংল্যান্ড হারলে বাংলাদেশ ‘হারবে’। এজবাস্টনের কথা তাই ক্রিকেটারদের কথায় ঘুরেফিরেই এল। তবে খেলা দেখেছেন খুব কম জনই। একটু অবিশ্বাস্যই শোনাবে, কার্ডিফে বাংলাদেশ যে হোটেলে আছে, সেই পার্ক প্লাজায় স্কাই স্পোর্টসই নেই! টেলিভিশনে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও তাই দেখা যাচ্ছে না।
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে সাকিব আল হাসান বললেন, ‘আইসিসির এক লোককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হোটেলে রেখেছেন যে খেলা দেখা যায় না?’ আইসিসির ওই কর্মকর্তা দুঃখ প্রকাশ করার পর সাকিব বলেছেন, ‘হোটেলকে বলে ওই চ্যানেলটার ব্যবস্থা করার কথা তো বলতে পারত আইসিসি।’
হয় আইসিসি বলেনি বা বললেও কাজ হয়নি। সাকিব অবশ্য খেলা দেখার একটা পথ বের করে নিয়েছেন। মোবাইলে বিশেষ একটা অ্যাপ নামিয়ে নিয়েছেন, যাতে সব খেলাই দেখা যায়। সেটিতে উঁকি দিয়ে জানালেন, ইংল্যান্ড টসে জিতে ফিল্ডিং করছে।
রুমের টিভিতে খেলা না থাকলেও ক্রিকেটারদের খেলা দেখার সুযোগ ছিল। বাংলাদেশ দলের মিটিং রুমের টিভিতে স্কাই স্পোর্টস আনার একটা বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই মিটিং রুমে সকাল থেকেই ক্রিকেটারদের যাওয়া-আসা থাকল। তবে সেটি যত না খেলা দেখতে, তার চেয়ে বেশি মিটিংয়ের কারণেই। প্রতিটি টুর্নামেন্ট বা সিরিজ শেষেই খেলোয়াড়দের সঙ্গে বসেন কোচিং স্টাফরা। কখনো চার-পাঁচজনের গ্রুপ করে, কখনো বা শুধুই একজন। বাংলাদেশের টুর্নামেন্ট শেষও হয়ে যেতে পারে জেনে সেই কাজটা সেরে রাখলেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
কার্ডিফে টিম হোটেলের সামনে সকাল থেকেই বাংলাদেশের সাংবাদিকদের একটা জটলা। বিকেলের দিকে হালকা হয়ে আসার আগে দুপুরে যেটি সবচেয়ে বড় হলো। ক্রিকেটাররা কেউ বেরোলেই টেলিভিশনের ক্যামেরা অনুসরণ করছে তাঁকে। সাংবাদিকদের আলোচনাতেও এজবাস্টনের ম্যাচ। তাঁদের পরবর্তী সফরসূচিও যে নির্ভর করছে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে ওঠা না-ওঠার ওপর।
মাশরাফি বিন মুর্তজা সকালে এত দিন সফরসঙ্গী হয়ে থাকা স্ত্রী-ছেলেমেয়ে, ছোট ভাইকে বিদায় জানালেন। লন্ডনে গিয়ে তাঁরা দেশের বিমান ধরবেন। ছোট্ট ছেলেটা বাবাকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না। খুব কাঁদছিল। সেই দৃশ্য ভিডিও করলেন এক টেলিভিশন সাংবাদিক। ওটাই নাকি তাঁর ‘আজকের স্পেশাল’।
মাশরাফি আড্ডা দিতে ভালোবাসেন। নিচে সাংবাদিকদের সঙ্গে কয়েক দফায় অনেকটা সময় কাটালেন। দুপুরের দিকে বউ-বাচ্চা নিয়ে খেতে বেরোলেন মাহমুদউল্লাহ। একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছেন। সাকিবেরও এমনই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তাঁকে সাতসকালে তুলে দিয়েছে ‘বাবার দায়িত্ব’। মেয়ের ডায়াপার শেষ হয়ে গেছে। এটা তো ঢাকা নয় যে, কাউকে দোকানে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে বা ফোন করলেই কেউ দিয়ে যাবে। সাকিবকেই তাই ছুটতে হলো ডায়াপার কিনতে।
বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠুক না উঠুক, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই জয় পুরো বিশ্বের কাছে এক ঝটকায় অনেকটা ওপরে তুলে দিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা আগেই জমিয়ে দিয়েছিল টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য জয় সেটিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। সাকিব আল হাসান আর মাহমুদউল্লাহ এখন বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিরই দুই নায়ক। দুজনের ওই জুটি ঢুকে গেছে ক্রিকেট রূপকথায়। সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভন গত পরশুই টুইট করেছেন, ওয়ানডেতে এর চেয়ে ভালো জুটি দেখেছেন বলে তিনি মনে করতে পারছেন না। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের মনে ভনের মতো কোনো সংশয় নেই। গত পরশু মাঠ থেকে হোটেলে ফেরার পর লবিতে দেখা হতেই বলে দিলেন, ‘অবিশ্বাস্য! এমন পার্টনারশিপ আমি জীবনে দেখিনি।’
তামিম ইকবালও দেখেননি। তবে বাংলাদেশের জয়ে তিনি একটুও নাকি বিস্মিত হননি। মানে কী, ৩৩ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও কি সত্যিই আশা করেছিলেন, বাংলাদেশ এই ম্যাচ জিতবে? তামিম বললেন, ‘আপনি অন্যদের জিজ্ঞেস করে দেখেন, ওরা যখন সিলি-টিলি ফিল্ডিং সাজাচ্ছিল, তখনই আমি বলেছিলাম, “ওরা তো জানে না, এই ম্যাচ হেরে যাবে।”’ এই বিশ্বাস কোত্থেকে এল? তামিমের জবাব, ‘এখন আমরা কোনো কিছুই অসম্ভব মনে করি না।’ সাকিব আর মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং নিয়ে কথা বলার সময়ও এই নতুন বোধের পরিচয়, ‘দেড় শর বেশি ম্যাচ খেলে ফেলেছে, এমন দুজন ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে এটা তো অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।’
আইসিসি টুর্নামেন্ট নিয়ে সাকিবের একটা দুঃখ ছিল। বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। অথচ বিশ্ব মঞ্চে তাঁর বলার মতো কোনো পারফরম্যান্স ছিল না। সেই দুঃখ ঘোচালেন সম্ভবত ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসে। মাহমুদউল্লাহর ঘটনা উল্টো। ওয়ানডেতে তাঁর তিনটি সেঞ্চুরি, তিনটিই আইসিসি টুর্নামেন্টে (বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়নস ট্রফি মিলিয়ে)। পরশুর অপরাজিত সেঞ্চুরি আইসিসি টুর্নামেন্টে তাঁর ব্যাটিং গড় নিয়ে গেছে ৬৪.১২-এ।
২০১৫ বিশ্বকাপে দুটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। এবারও তা করার সুযোগ পাবেন কি না, লেখার সময় সেটি ঠিক হচ্ছিল এজবাস্টনে। তবে পরদিন বাংলাদেশের বার্মিংহাম যাওয়া কিন্তু চূড়ান্তই হয়ে ছিল। সেমিফাইনালে উঠলে ওখানেই খেলা। না উঠলেও বাংলাদেশ দল বার্মিংহামে যাবে। কারণ, দেশে ফেরার ফ্লাইটটা ওখান থেকেই ছাড়বে।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেটিতেই উঠে গেল নাকি সেমিফাইনালে, তা তো এতক্ষণে আপনি জেনেই গেছেন!