চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ‘ছয়ের’ প্রেরণা
উৎপল শুভ্র
৯ জুন ২০২১
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সেরা আট দলের টুর্নামেন্ট হয়ে যাওয়ার পর এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল, এরএকমাত্র উদ্দেশ্য, জিম্বাবুয়ে আর বাংলাদেশকে বাদ দেওয়া। র্যাঙ্কিংয়ে ৯ আর ১০ নম্বর জায়গা দুটির যে প্রায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে রেখেছিল এই দুই দল! দুটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দর্শক হয়ে থাকার পর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ফিরেছিল ২০১৭ সালে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ছয় নম্বরে উঠে যাওয়াটা ছিল ওয়ানডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসরে ভালো করতে বড় এক প্রেরণা। সেই অনুপ্রেরণা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ কী করেছিল, তা তো আপনি জানেনই।
প্রথম প্রকাশ: ২৯ মে ২০১৭। প্রথম আলো।
‘বাংলাদেশ ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে ছয় নম্বর, এটা কি কোনো দিন ভাবতে পেরেছিলেন?’
প্রশ্নটা শুনে সাকিব আল হাসান যারপরনাই অবাক হলেন। ‘ভাবতে না পারার কী আছে? আমার তো মনে পড়ে, ২০০৭ বিশ্বকাপের সময়ই আমি বলেছিলাম, আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমরা ৫/৬ নম্বর টিম হব। আমি, তামিম, মুশফিক সবাই এমন চিন্তা করতাম’ বলে মৃদু হেসে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে?’
সাকিব কোনো কিছুতেই খুব একটা অবাক হন না। অথবা হলেও সেটি প্রকাশ করেন না। র্যাঙ্কিংয়ে ছয় নম্বরে উঠে যাওয়াটা নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে অবশ্য মনে হলো, এ ক্ষেত্রে প্রথমটাই সত্যি। যদিও এটা সত্যি যে, বছর দুয়েক আগেও এটি ভাবা একটু কঠিনই ছিল।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সেরা আট দলের টুর্নামেন্ট হয়ে যাওয়ার পর এমন মনে হওয়াও স্বাভাবিক ছিল, এটা বুঝি আইসিসির মহাপরিকল্পনার কোনো অংশ। যে ‘মহাপরিকল্পনা’র একমাত্র উদ্দেশ্য, জিম্বাবুয়ে আর বাংলাদেশকে বাদ দেওয়া। র্যাঙ্কিংয়ে ৯ আর ১০ নম্বর জায়গা দুটির যে প্রায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে রেখেছিল এই দুই দল!
দুটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দর্শক হয়ে থাকার পর বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তনটাকে তাই রাজকীয়ই বলতে হবে। সেরা আট দলের মধ্যে থাকার শর্ত পূরণ হওয়াটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ছয় নম্বরে উঠে যাওয়া। না, বিশ্বকাপের পর ওয়ানডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসরে এর চেয়ে বড় প্রেরণা আর কিছু হতে পারত না।
লন্ডনে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দলগুলোর ঠিকানা গ্র্যাঞ্জ সিটি হোটেলের ব্রেকফাস্ট টেবিলে সাকিবের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে, পাশের টেবিলে বসে বাংলাদেশ দলের তিন তরুণ তুর্কি। সৌম্য, সাব্বির ও মোসাদ্দেক। যাঁদের কাছে ছয় নম্বর র্যাঙ্কিং কোনো বিস্ময়ই নয়। অভিষেকের পর থেকেই যে তাঁরা প্রায় নিয়মিত জিততে দেখেছেন দলকে। সাব্বির ইংল্যান্ডে এলেন প্রায় আট বছর পর। ২০০৯ সালে ক্যারিয়ারের প্রথম সফরটাই ছিল এখানে। সেটি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে। লন্ডনের বিখ্যাত দুই ভেন্যু লর্ডস বা ওভালে খেলা হয়নি সেবার। এবার বাংলাদেশের প্রথম দুটি ম্যাচই ওভালে। এটা নিয়ে অবশ্যই একটু রোমাঞ্চিত।
সাকিবও ওভালে খেলেননি কখনো। বাংলাদেশের এই দলের কেউই না। তবে রোমাঞ্চ-টোমাঞ্চ সাকিবকে একটু কমই স্পর্শ করে। কোনো কিছুতেই খুব একটা অবাক না হওয়ার অভ্যাসটা অবশ্য সকালেই একটু ধাক্কা খেয়েছে। ঘুম ভেঙেছে রুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে। দরজা খুলে দেখেন, অ্যান্টি ডোপিংয়ের লোকজন দাঁড়িয়ে। সাকিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনারা শিওর তো, আমিই?’ অবাক হওয়ার কারণ, কদিন আগেই আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের সময় একবার ডোপ টেস্ট দিয়েছেন।
আবারও তা দিতে হলো বলেই নাশতা করতে আসতে একটু দেরি হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে যেটি শেষ করতে হলো। দুপুরে প্র্যাকটিসে যাওয়ার আগে জিমে ঘাম ঝরাবেন। মাঝখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজও আছে। মেয়ের নখ কেটে দিতে হবে। মেয়ের মা এই কাজটা পারেন না।
সাকিবের স্ত্রী-কন্যা আয়ারল্যান্ড থেকেই তাঁর সঙ্গী। মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, ইমরুল কায়েসের মতো আরও কয়েকজনও এখানে সস্ত্রীক। ইমরুল নাশতা সেরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ইংলিশ গ্রীষ্ম নিয়ে মুগ্ধতার কথা জানিয়ে গেলেন, ‘এখানে সামারটা খুব সুন্দর, তাই না?’ আসলেই সুন্দর। আরামদায়ক উষ্ণতা। পরশু বিকেলে বৃষ্টি নামায় তাপমাত্রা ঝপ করে নেমে গিয়েছিল। নইলে দিনের বেলা দিব্যি টি-শার্ট গায়ে ঘুরে বেড়ানো যাচ্ছে। আয়ারল্যান্ডেও খুব একটা ঠান্ডা ছিল না। তবে এর আগে ব্রাইটনে বাংলাদেশের প্রস্তুতির সময়টার কথা ভেবে শিউরে উঠলেন ইমরুল, ‘কী যে ঠান্ডা ছিল! ৭-৮ ডিগ্রি টেম্পারেচার। ওই টেম্পারেচারে আমরা কখনো খেলেছি নাকি!’
ব্রেকফাস্ট রুমে ভিড়টা ততক্ষণে একটু হালকা হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ আর ভারতের ক্রিকেটারদের বাইরে তেমন কেউ নেই। আইপিএলে খেলার সুবাদে ভারতীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গে সাকিবের খুব জানাশোনা। শিখর ধাওয়ানের সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো।
লন্ডনের হোটেলের ব্রেকফাস্টে আরও সব আয়োজনের সঙ্গে পরোটা-ভাজি-ডালও দেখতে পেয়ে একটু চমকে গেলেন সাকিব। সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য বুঝতে পারলেন, এটি ভারতীয় দলের জন্য বাড়তি সমাদর!
এই ভারতের সঙ্গেই আজ ওভালে বাংলাদেশের শেষ প্রস্তুতি ম্যাচ। পাকিস্তানের বিপক্ষে আগের প্রস্তুতি ম্যাচটিতে অভাবিতভাবে হারতে হয়েছে। যদিও ওই ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠলেই ‘ওই ম্যাচে তো ১৩ জন করে খেলেছে’ বলে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, প্রস্তুতি ম্যাচের হার-জিতকে এত বড় করে দেখার কিছু নেই। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচেও প্রস্তুতিটাই মুখ্য হবে। যেটির বড় অংশ জুড়ে থাকা উচিত ফিল্ডিং। ফাহিম আশরাফের অবিশ্বাস্য এক ইনিংসের চেয়েও যেটিকে পাকিস্তানের বিপক্ষে পরাজয়ের বড় কারণ বলে মনে করেন তামিম ইকবাল। এজবাস্টনে সেদিন পাঁচ-পাঁচটি ক্যাচ পড়েছে। এর আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ ছয় নম্বরে উঠে এল, সেই ম্যাচেও ক্যাচ পড়েছে চারটি।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হোটেল থেকে ওভালমুখী বাসে ওঠার পথে মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে অবশ্য ক্যাচ ফেলার অসুখ নিয়ে নয়, কথা হলো র্যাঙ্কিংয়ে ছয়ে উঠে আসা নিয়ে। ‘আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গৌরবের মুহূর্ত এটি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, সেরা আট দলের একটি হয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলা। আমরা ছয় নম্বর হয়ে খেলছি। এই দলের অংশ হতে পেরে আমি গর্বিত’—মুখে সেই গর্বের ছবি এঁকে মুশফিক মনে করিয়ে দিলেন, ‘এখন চ্যালেঞ্জ হলো, এটি ধরে রাখা।’
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভালো করা আর ছয় নম্বর র্যাঙ্কিং ধরে রাখা—একটির সঙ্গে আরেকটি কিন্তু ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। দুটি চ্যালেঞ্জ আসলে মিলেমিশে একাকার!