এ জন্যই তিনি স্টিভ ওয়াহ!
উৎপল শুভ্র
২ জুন ২০২১
স্টিভ ওয়াহর গ্রেটনেস কোথায়? ১৬৮ টেস্ট, ১১ হাজার ছুঁইছুঁই রান, ৩২টি সেঞ্চুরি—এ সব তো আছেই। তবে এসবকে ছাপিয়েও লড়াই, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, নিজের ওপর আস্থা—ক্রিকেট ইতিহাসে এ ব্যাপারগুলোর প্রতিশব্দ হয়ে রইবেন বলেই অমরত্ব পাবে স্টিভ ওয়াহর নামটি। পাবে মানে কি, পেয়েই গেছে।
প্রথম প্রকাশ: ৫ জানুয়ারি ২০০৩। প্রথম আলো।
মেলবোর্ন, ১৯৮৫
এক সঙ্গে গ্রেগ চ্যাপেল-ডেনিস লিলি-রডনি মার্শ অবসর নেওয়ায় সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করতে তখনো হিমশিম খাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। পালাবদলের কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট। কোচ ববি সিম্পসন আর অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন ভবিষ্যতের ‘অট্টালিকা’ গড়ার মতো মজবুত ‘ইট’। ভারতের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে এ রকমই একজনকে নামিয়ে দিলেন তাঁরা। ছোটখাটো দেখতে ২০ বছরের এক তরুণ, ব্যাটিংটাই মূল শক্তি, তবে মিডিয়াম পেস বোলিংটাও উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
স্টিভ ওয়াহর জন্ম হলো।
সিডনি, ২০০৩
১৯৮৫ সালের সেই তরুণ খেলতে নামলেন ১৫৬তম টেস্ট। যাঁর হাত ধরে ক্যারিয়ার শুরু, সেই অ্যালান বোর্ডার ছাড়া এত টেস্ট খেলেনি আর কেউ। এটাই তাঁর শেষ টেস্ট কি না, সেই জল্পনা-কল্পনা চলছে অনেক দিন থেকেই। অধিনায়কত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে থাকতে পারেন কি না, নির্বাচকরা তা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। হোমগ্রাউন্ডে রেকর্ড ১৫৬তম টেস্ট, তাতেই ২৯ সেঞ্চুরি। ক্রিকেটের ‘অস্ট্রেলীয় ঈশ্বর’ স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পাশে বসার স্বীকৃতি। অ্যালান বোর্ডারের পাশে বসা হয়ে গেছে এর আগেই। রান যখন ৬৯, সুনীল গাভাস্কার ও অ্যালান বোর্ডারের পর মাত্র তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের রানকে নিয়ে গেছেন পাঁচ অঙ্কে।
স্টিভ ওয়াহর ক্যারিয়ার পূর্ণতা পেল।
'৮৫-্এর ডিসেম্বর থেকে ২০০৩-এর জানুয়ারি—মাঝের ১৭ বছর যাঁরা স্টিভেন রজার্স ওয়াহকে দেখেছেন, বিস্ময়-প্রশংসা-অবিশ্বাস-শ্রদ্ধা সব অনুভূতির সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে তাঁদের। পরিচয় করিয়ে দিয়েছে স্টিভ ওয়াহর ব্যাটিং।
চার মিনিটের ছোট যমজ ভাই মার্ক ওয়াহর মতো আভিজাত্য আর রেশমি পরশ নেই তাঁর ব্যাটিংয়ে, শচীন টেন্ডুলকারের নিখুঁত টেকনিকের প্রদর্শনীও নয় তা, বড় কোনো প্রাকৃতিক বিস্ময়ের মুখোমুখি হওয়ার মতো অনুভূতি ছড়িয়ে দেওয়া ব্রায়ান লারার ব্যাটিংয়ের সঙ্গেও তুলনা চলে না। কিন্তু ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে, আপনার জীবন নির্ভর করছে একটি ইনিংসের ওপর, তাহলে মার্ক ওয়াহ-শচীন টেন্ডুলকার-ব্রায়ান লারা কেউই নন, সে ইনিংসটি খেলার জন্য চোখ বুঁজে সবাই বেছে নেবেন স্টিভ ওয়াহকে। এক সময় জাভেদ মিয়াঁদাদ পেতেন এই স্বীকৃতি। স্টিভ ওয়াহ শুধু তাঁর উত্তরসূরি হয়েই থেমে থাকেননি, ছাড়িয়ে গেছেন তাঁকেও।
তাঁর সেরা ইনিংসগুলোর বেশির ভাগই খেলা হয়েছে, দল যখন দাঁড়িয়ে সর্বনাশের কিনারায়। তাঁর সেরা ইনিংসগুলোর বেশির ভাগই এসেছে, যখন চার পাশ থেকে ধেয়ে আসা চাপ তাঁকে চিড়েচ্যাপ্টা করে ফেলার শঙ্কা জাগিয়েছে। সিডনির ইনিংসটি তাই সর্বার্থেই স্টিভ ওয়াহর ইনিংস। যখন নামলেন, অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে ৫৬। দলকে এমন কম্পমান অবস্থায় অনেকদিন দেখেননি স্টিভ, এমন একটা ইনিংস খেলতে খেলতেও কি এ জন্যই একটু দেরি হলো? দেরিই বা কোথায়, তাঁর ২৮তম টেস্ট সেঞ্চুরি তো মাত্র ৪ টেস্ট আগেই। পাকিস্তানের বিপক্ষে শারজায় সে সেঞ্চুরিটি যেভাবে এসেছিল, তা ভালোমতোই বুঝিয়ে দিয়েছিল, ব্যাট হাতে এই লোকটা এখনো বোলারদের দুঃস্বপ্ন, দলের বোঝা নন। কিন্তু বয়সটা ৩৭ হয়ে গেছে বলেই সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরিগুলো ভুলে মানুষ শুধু স্টিভ ওয়াহর ব্যর্থতাটাই মনে রাখতে শুরু করেছিল।
দল বিপদে, প্রশ্নের মুখে নিজের ক্যারিয়ারও। ‘চাপ’ শব্দটি তার ভয়াবহতম রূপ নিয়েই দেখা দিয়েছিল সিডনিতে। স্টিভ ওয়াহকে হয়তো জাগিয়ে দিল সেটাই। তাঁর অভিধানে ‘চাপ’ শব্দটার যে অন্য অর্থ—ভালো করার প্রেরণা!
১৫৬ টেস্ট, ১০ হাজার রান, ২৯টি সেঞ্চুরি—এ সব তো আছেই। তবে এসবকে ছাপিয়েও লড়াই, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, নিজের ওপর আস্থা—ক্রিকেট ইতিহাসে এ ব্যাপারগুলোর প্রতিশব্দ হয়ে থাকবে স্টিভ ওয়াহর নামটি।