মুরালির দেশে রাজ্জাকের ২০০

উৎপল শুভ্র

২৪ মে ২০২১

মুরালির দেশে রাজ্জাকের ২০০

২০০৭ সালের শ্রীলঙ্কা সফরের নেটে আবদুর রাজ্জাক। ছয় বছর পর সেই শ্রীলঙ্কাতেই বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে ২০০ উইকেট পাওয়ার কীর্তি। ছবি: এএফপি

যখন এ লেখা লিখেছি, তখন রাজ্জাক তাঁর ১০ ওভারের ৬/৭ ওভারই করেন পাওয়ার প্লেতে। পেসাররা মার খাচ্ছেন, অধিনায়কের সহায় রাজ্জাক। কোনো ব্যাটসম্যান ঝড় তুলছেন, রাজ্জাককে ডাকো। রাজ্জাক তখন ‘নির্ভরতা’র প্রতিশব্দ। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ২০০ উইকেটের মালাটা তাঁর চেয়ে ভালো আর কার গলায় মানাত!

প্রথম প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

টেস্টে ব্যাটসম্যানদের জন্য যা সেঞ্চুরি, বোলারদের জন্য তা ইনিংসে ৫ উইকেট। কিন্তু ওয়ানডেতে কি দ্বিতীয়টিকে একটু এগিয়ে রাখা উচিত?

টেস্টের বিচার এক রকম, ওয়ানডের অন্য রকম। টেস্টে যতক্ষণ ইচ্ছা ব্যাটিং-বোলিং করা যায়। ওয়ানডেতে তা ওভার-নির্দিষ্ট। তা ৫০ ওভারের মধ্যে সেঞ্চুরি করা বেশি কঠিন নাকি ১০ ওভারের মধ্যে ৫ উইকেট নেওয়া? তর্ক হতেই পারে। সাহায্যে আসতে পারে একটা তথ্য। টেস্টে ইনিংসে ৪ উইকেটের হিসাব থাকে না। ওয়ানডেতে কিন্তু থাকে। তার মানে কি ওয়ানডেতে ৪ উইকেটই টেস্টে ৫ উইকেটের সমান?

তা-ই যদি হয়, তাহলে ৫ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব টেস্টের চেয়ে ওয়ানডেতে বড় হয়ে যায়। তার মানে তো সেঞ্চুরির চেয়েও। এই বিচারে কাল (২৮ মার্চ ২০১৩) পাল্লেকেলেতে তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে শ্রীলঙ্কার ইনিংস শেষে তিলকরত্নে দিলশানের চেয়ে আবদুর রাজ্জাকই এগিয়ে!

সেঞ্চুরি বা ৫ উইকেট উদযাপন করার মতোই ব্যাপার। দুজনই তা করলেন। তবে রাজ্জাকের উদযাপনটা ৫ উইকেট পাওয়ার আনন্দ ছাপিয়ে আরও বৃহত্তর মাত্রা পেল। এই ৫ উইকেটেই যে ছুঁয়ে ফেললেন ওয়ানডেতে ২০০ উইকেটের মাইলফলক।নুয়ান কুলাসেকারাকে ফিরিয়ে  রাজ্জাকের উইকেট পাওয়ার আনন্দের অংশীদার নাসির, পাশে হাস্যোজ্জ্বল মুশফিক। ছবি: এএফপি

ওয়ানডে ইতিহাসে রাজ্জাকের এই অর্জন বুদ্বুদ তুলেই মিলিয়ে যাবে। খুব বড় কিছু তো নয়, তাঁর আগে আরও ৩৩ জন বোলার সদস্যপদ পেয়েছেন এই ‘টু হান্ড্রেড ক্লাব’-এর। তবে শুধুই বাংলাদেশ ক্রিকেটের আয়নায় আবদুর রাজ্জাকের এই অর্জন প্রতিবিম্বিত ‘কীর্তি’ বলে। বাংলাদেশের কোনো বোলারের ২০০ উইকেট তো এই প্রথম।

শুধু বাঁহাতি স্পিনারের প্রজাতিটা আলাদা করে নিলে রাজ্জাক ছাড়া আর মাত্র দুজন আছেন এই ক্লাবে*। সবার ওপরে যাঁর নাম, তিনি কাল ম্যাচের মাঝখানে সংবাদ সম্মেলন করলেন। শ্রীলঙ্কার টি-টোয়েন্টি দলে রামিথ রামবুকওয়ালে নামের এক তরুণকে নেওয়া হয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে বলার মতো তেমন পারফরম্যান্স নেই। তথ্যমন্ত্রীর ছেলে পরিচয়টাই তাঁর দলভুক্তিতে বড় ভূমিকা রেখেছে সাধারণ ধারণা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে তীব্র সমালোচনাও হয়েছে। সেটির জবাব দিতেই সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন প্রধান নির্বাচক সনাৎ জয়াসুরিয়া। ‘জবাব’ যা দিলেন, তাতে অবশ্য স্থানীয় সাংবাদিকদের কেউই আগের ধারণা থেকে সরে আসার কোনো কারণ দেখছেন না।

বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের আড়ালে তাঁর বোলার পরিচয়টা প্রায়ই হারিয়ে যায়। অথচ বাঁহাতি স্পিনে জয়াসুরিয়ার ৩২৩ উইকেট। কালকের আগ পর্যন্ত জয়াসুরিয়া ছাড়া আর যে একজন বাঁহাতি স্পিনারের ২০০ উইকেট ছিল, তাঁর নাম ড্যানিয়েল ভেট্টোরি (২৮২)। রাজ্জাকের গল্পটা এই দুজনের চেয়ে অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। অনেক বেশি সংগ্রামমুখরও। মুত্তিয়া মুরালিধরনকে যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সেটির সঙ্গে তুলনা চলে না। কিন্তু মুরালির দেশে রাজ্জাকের ২০০ উইকেটের কীর্তি মনে করিয়ে দিচ্ছে দুজনের মিলটা। বোলিং অ্যাকশন নিয়ে রাজ্জাককেও তো কম ভুগতে হয়নি। এক দিক থেকে তো একটু বেশিই। মুরালি তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কখনো ‘নিষিদ্ধ’ হননি, যে বিড়ম্বনা বিনিদ্র অনেক রাত্রি উপহার দিয়েছে রাজ্জাককে।

রাজ্জাককে আবিষ্কারের কৃতিত্বটা সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদের। নিজে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার সময় দেখেছেন, রাজ্জাককে মারা কত কঠিন। ২০০৪ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের ওয়ানডে দলে তাই নিয়ে নিলেন তাঁকে। পরদিন গ্রেনাডায় সিরিজের শেষ ম্যাচে অভিষেক হচ্ছে জেনে রাতে ঘুমুতে গেলেন রাজ্জাক। সকালে বৃষ্টিতে ম্যাচ কমে গেল ২৫ ওভারে। পেস-সহায়ক কন্ডিশনে একজন বাড়তি পেসার খেলানোর সিদ্ধান্তে রাজ্জাকের আর খেলাই হলো না। শুধু যাওয়া আর আসাই হয়ে থাকল তাঁর সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের স্মৃতি।

আরও একটা উইকেট চাই রাজ্জাকের। ছবি: এএফপি
ওয়ানডে অভিষেকের জন্য বেশি দিন অবশ্য অপেক্ষা করতে হয়নি। সেটি এই মুরালির দেশেই। এশিয়া কাপে হংকংয়ের বিপক্ষে অভিষেকেই ৩ উইকেট। পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের ম্যাচে ১০ ওভারে ৩৬ রানে ২ উইকেট, কিন্তু সেই ম্যাচের পর প্রশ্ন উঠল বোলিং অ্যাকশন নিয়ে। সেটি শুধরে-টুধরে ফিরলেন। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের এক নম্বর বোলারের স্বীকৃতি এবং চাপ দুটিই বয়ে চলারও সেই শুরু। বড় ধাক্কাটা ২০০৮ সালে। যখন দ্বিতীয়বার ‘রিপোর্টেড’ হয়ে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হাত বাঁকানো আইনসিদ্ধ, তাঁর বেঁকে যায় ২৮ ডিগ্রি। ক্যারিয়ার নিয়েই তখন বড় প্রশ্ন।

কিন্তু আবদুর রাজ্জাক বড় শক্ত ধাতুতে গড়া। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেটে কাটিয়ে আবারও শুধরেছেন নিজেকে। ফিরতে পারবেন কি না, সংশয় ছিল অনেকের মনেই। রাজ্জাকের নিজের বুকও কি দুরুদুরু করেনি! শেষ পর্যন্ত দুঃসহ সেই সময়কে জয় করে ঠিকই ফিরেছেন এবং বলতে গেলে ফেরার দিন থেকেই আবার বাংলাদেশের এক নম্বর স্পিনার।

রেকর্ডই তাঁর পক্ষে কথা বলে। কিন্তু পুরোটা কি বলে? মারদাঙ্গা ক্রিকেটের এই যুগে ৪.৪৮ ইকোনমি রেটকে যথেষ্টই ভালো বলতে হবে। কিন্তু এতে তো আর লেখা নেই যে, রাজ্জাক তাঁর ১০ ওভারের ৬/৭ ওভারই করেন পাওয়ার প্লেতে। পেসাররা মার খাচ্ছেন, অধিনায়কের সহায় রাজ্জাক। কোনো ব্যাটসম্যান ঝড় তুলছেন, রাজ্জাককে ডাকো। দিনে দিনে রাজ্জাকের নামের প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে ‘নির্ভরতা’।

২০০ উইকেটের মালাটা তাঁর চেয়ে ভালো আর কার গলায় মানাত!

সংযোজন: এই লেখার সময় ওয়ানডের টু হান্ড্রেড উইকেট ক্লাবে আবদুর রাজ্জাক ছাড়া বাঁহাতি স্পিনার ছিলেন আর দুজন। পরে যোগ হয়েছেন বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানও। ভেট্টোরি ওয়ানডে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ৩০৫ উইকেট নিয়ে।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×