বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন জয়াবর্ধনে
উৎপল শুভ্র
২৯ এপ্রিল ২০২১
তিন টেস্ট সিরিজের ফলাফল ৩-০ হলেও ২০০৭ সালে বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা ট্যুরে ঝাঁজালো প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা আবহ ছিল। মূলত তা মাঠের বাইরের কথাবার্তায়। শ্রীলঙ্কানরা ফিল্ডিংয়ের সময় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কান ঝালাপালা করে ফেলছে জানার পর এ নিয়ে কথা বলেছিলাম অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনের সঙ্গে। তিনি যা বলেছিলেন, সেই প্রশ্নটা অনেক দিনই সত্যি ছিল বাংলাদেশ দলের জন্য।
প্রথম প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০০৭। প্রথম আলো।
এই সিরিজের শুরু থেকেই মাঠে শ্রীলঙ্কানদের ক্যাচর-ম্যাচরে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের কান ঝালাপালা। আর কোনো দলের বিপক্ষেই এমন বাক্যবাণে বিদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি তাঁদের। স্লেজিংয়ের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও না! দ্বিতীয় টেস্টে মোহাম্মদ আশরাফুলের সেঞ্চুরিতে বাড়তি একটা তৃপ্তিও যোগ হয়েছিল এ কারণে, ‘ওরা মাঠে বেশি কথা বলে। এ জন্য ওদের বিপক্ষে ভালো করার জন্য বাড়তি একটা জেদ থাকে মনে।’
বাড়তি জেদটা প্রথম টেস্টের পর থেকেই কাজ করছিল আশরাফুলের মনে। চতুর্থ দিন সকালে টপাটপ শেষ ৫ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সবচেয়ে বড় পরাজয়ের পর বাংলাদেশ-অধিনায়ক বলছিলেন, ‘ওরা আমাদের সম্পর্কে খুব নেতিবাচক মন্তব্য করে। ওদের মনেই থাকে না যে, একদিন ওরাও আমাদের মতো ছিল।’
হ্যাঁ, একদিন শ্রীলঙ্কাও বাংলাদেশের মতোই ছিল। মাহেলা জয়াবর্ধনে তা মানছেন। তবে একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তখন শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড়দেরও বাংলাদেশের মতোই কথা শুনতে হয়েছে। প্রসঙ্গটা তুলতেই শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক চাছাছোলা ভাষায় বলে দিলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেট শুরু করার সময় প্রতিপক্ষ দলগুলো আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলত। অর্জুনা রানাতুঙ্গা অধিনায়ক হওয়ার পর প্রথম আমরাও তা ফিরিয়ে দিতে শুরু করি। এত দিন সবাই যা করে আসছিল, আমরা তা করতে শুরু করার পরই সবাই চোখ কপালে তুলে বলতে শুরু করে, এটা কী হচ্ছে? আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কঠিন জায়গা। এখানে কেউ কিছু করলে তা ফেরত পাওয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকা উচিত।'
মাঠের বাইরে নরম-সরম মাহেলা জয়াবর্ধনের সঙ্গে কথাগুলো যে একদমই যায় না! কথাটা বলতেই হেসে বললেন, ‘মাঠ আর মাঠের বাইরের লোকটিকে কখনো মেলাতে যাবেন না।’ তা না হয় না-ই গেলাম, কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়ার যে কথাটা বললেন তিনি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা কীভাবে প্রযোজ্য হয়? বাংলাদেশের খেলোয়াড়রাও কি খুব স্লেজিং করছে নাকি! জয়াবর্ধনে কথাটা শেষ করতে দিলেন না, ‘আমরা স্লেজিং করছি, এটা আপনাকে কে বলল? আপনি বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের জিজ্ঞেস করুন না, আমাদের কেউ একটাও নোংরা কথা বলেছে কি না! আমি আমার খেলোয়াড়দের কখনোই গালাগালি করার অধিকার দিই না।’
শ্রীলঙ্কানরা তাহলে কী বলেন? এই প্রশ্নটার যে এমন বিস্ফোরক জবাব আসবে, তা কল্পনাতেও ছিল না, ‘বাংলাদেশ যখন ব্যাটিং লাইন আপ বদলিয়ে অনভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের ওপরে পাঠায়, তখন আমাদের অবাক লাগে। আমরা এ নিয়ে প্রশ্ন করি। যেকোনো দলের সেরা ব্যাটসম্যানরা, সিনিয়র ব্যাটসম্যানরা ওপরে ব্যাট করবে, দায়িত্ব নেবে—এটাই নিয়ম। বাংলাদেশ যখন উল্টোটা করে, তখন আমরা প্রশ্ন না করে পারি না। এটাকে বলতে পারেন, কে কতটা চাপ নিতে পারে, তার একটা পরীক্ষা। সব দলই ব্যাটসম্যানের মনে সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এটাই নিয়ম।’
এমনিতে বাংলাদেশ যত খারাপই খেলুক, প্রতিপক্ষ অধিনায়ক সব সময় ‘বাংলাদেশ উন্নতি করছে’, ‘আরেকটু সময় লাগবে’ এই জাতীয় মনভোলানো কথা বলেন। মাহেলা জয়াবর্ধনেও তা-ই বলে আসছিলেন। কিন্তু তাঁর দলের বিপক্ষে মাত্রাতিরিক্ত স্লেজিংয়ের অভিযোগে ক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক মনের কথাটা বলে ফেললেন, ‘মাঠে যখন দেখি, বাংলাদেশ দলের এক-দুজন খেলোয়াড় ছাড়া কেউ নিজেদের শতভাগ ঢেলে দিচ্ছে না, এটা দেখতে খারাপ লাগে। ওদেরকে দেখি, কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব, নিজেদের মধ্যে রসিকতা করছে, দুষ্টুমি করছে। টেস্ট ক্রিকেট এভাবে খেলা হয় না। এভাবে খেলা যায় না। কিন্তু আমরা টেস্ট ক্রিকেটটা টেস্ট ক্রিকেটের মতোই খেলতে চাই।’
'আমরা প্রতিনিয়ত নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করি। কে মুরালি, কে জয়াসুরিয়া, কে সাঙ্গাকারা; তাতে কিচ্ছু আসে-যায় না। কাউকে দেখে যদি তাঁর চেষ্টায় ঘাটতি আছে বলে মনে হয়, আমরা তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই।'
শুধু খেলোয়াড়ি দক্ষতাতেই নয়, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশ দলের মানসিকতায়ও যে যোজন যোজন ব্যবধান, সেটিও পরিষ্কার করে দিলেন জয়াবর্ধনে, ‘আমি যদি দেখি, আমার দলের এগারোজনই মাঠে নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছে না, আমি তো তা মানব না। আমরা প্রতিনিয়ত নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করি। কে মুরালি, কে জয়াসুরিয়া, কে সাঙ্গাকারা; তাতে কিচ্ছু আসে-যায় না। কাউকে দেখে যদি তাঁর চেষ্টায় ঘাটতি আছে বলে মনে হয়, আমরা তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই।’
বাংলাদেশ দলে এমন হয় কি না, তা নিয়ে জয়াবর্ধনের ঘোরতর সন্দেহ। মোহাম্মদ আশরাফুল কী বলেন? খেলোয়াড়দের মধ্যে চেষ্টার ঘাটতির কথা তিনি মানতেই রাজি নন। মাঠে মজা করা, কৌতুক করায়ও তিনি আপত্তির কিছু দেখছেন না, ‘এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমি বরং খুশি। মাঠে যত নির্ভার থাকা যায়, ভালো করার সম্ভাবনাও তত বেশি থাকে। হয়তো এ কারণেই গত দুই টেস্টের প্রথম ইনিংসে খারাপ করার পর আমরা দ্বিতীয় ইনিংসে ভালো করতে পেরেছি।’ প্রথম দুই টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস ছিল ৮৯ ও ৬২ রানের। দ্বিতীয় ইনিংসে এর চেয়ে ভালো না করা একটু কঠিনই ছিল। তাছাড়া ব্যাটিং অর্ডারে সিনিয়রদের আগে নেমে দায়িত্ব না নেওয়ার অভিযোগ তো খন্ডাতে পারছেন না আশরাফুল। বরং বলছেন, বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের আরও অনেক বেশি ‘টাফ’ হতে হবে।
প্রকারান্তরে কি জয়াবর্ধনের কথাটাই মেনে নিলেন না তিনি!
আরও পড়ুন: মাহেলা জয়াবর্ধনের সাক্ষাৎকার