পাকিস্তানকে ধবলধোলাই
বাংলাওয়াশ! বাংলাওয়াশ!!
উৎপল শুভ্র
২৩ এপ্রিল ২০২১
পাকিস্তানের বিপক্ষে বারবার ধরা দিতে দিতেও হারিয়ে গেছে যে জয়, এক সপ্তাহের মধ্যে সেটিই তিন-তিনবার আলিঙ্গনপাশে বেঁধেছিল বাংলাদেশকে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর দেশের মাটিতে বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রার শুরুটাও ওযানডে সিরিজে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করেই।
চলুন ফিরে যাই `বাংলাওয়াশ` নাম নেওয়া সেই হোয়াইটওয়াশের ম্যাচে।
প্রথম প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০১৫। প্রথম আলো।
পাকিস্তান: ৪৯ ওভারে ২৫০। বাংলাদেশ: ৩৯.৩ ওভারে ২৫১/২। ফল: বাংলাদেশ ৮ উইকেটে জয়ী।
জুনাইদ খানকে ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে পাঠিয়েই রণহুংকার ছাড়লেন মুশফিকুর রহিম। দুই হাত শূন্যে তুলে ফেটে পড়লেন জয়োল্লাসে! সেই দুই হাতেই আলিঙ্গনে বাঁধলেন সৌম্য সরকারকে।
সীমানার ধারে বাংলাদেশ শিবিরে তখন ‘ঈদ’ শুরু হয়ে গেছে। যে যাঁকে সামনে পাচ্ছে, জড়িয়ে ধরছে তাঁকেই। আকাশে-বাতাসে উড়ে বেড়ানো অদৃশ্য আনন্দের রেণুতে ফ্লাডলাইটের আলো যেন আরও বেশি উজ্জ্বল। একটু পর মাঠের মাঝখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। মাথার ওপর দুলছে লাল-সবুজ পতাকা। দুলতে দুলতে যেন বলছে-বাংলাওয়াশ! বাংলাওয়াশ!!
ক্রিকেট অভিধানে এই শব্দটার অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের কল্যাণেই। যেটির জন্ম ২০০৯ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। তবে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় সারির দল ছিল বলেই কি না ‘বাংলাওয়াশ’ বললে সেটির কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে নিউজিল্যান্ড। তিন বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মাটিতে ৪-০ আর ৩-০ স্কোরলাইনের ওই দুটি ওয়ানডে সিরিজ।
কিন্তু এখন ‘বাংলাওয়াশ’ বললে কোনটিকে বুঝবেন? নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই দুটি সাফল্যও সোনায় মোড়ানো। তবে কিউইদের জন্য বাংলাদেশ অচিন এক দেশ, উইকেট-আবহাওয়া মিলিয়ে পুরোপুরিই ভিন্ন এক কন্ডিশনের সঙ্গে লড়াই। বাংলাদেশের কাছে নিউজিল্যান্ড অজেয় কোনো শক্তিও ছিল না। পাকিস্তানের ঘটনা পুরো উল্টো। উপমহাদেশেরই দল। মিরপুর যাদের কাছে রহস্যময় কোনো ধাঁধা নয়। তার চেয়েও বড় কথা, পাকিস্তানের ক্রিকেটের দুই প্রজন্ম এত দিন জেনে এসেছে, বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ মানেই জয়!
যে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় জয় পেতে ১৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, পাঁচ দিনের মধ্যেই সেই দলের বিপক্ষে আরও দুটি জয়! ব্যবধানগুলোও দেখুন না-৭৯ রান, ৭ উইকেট, ৮ উইকেট। কোনটির চেয়ে কোনটি বেশি দাপুটে জয়, সেই ধন্দে পড়ে যেতে হয়! ‘বাংলাওয়াশ’ বললে এখন কোনটিকে বোঝাবে, এই মধুর সমস্যাতেও।
বাংলাদেশের একাধিপত্য ঘোষণা করা জয়ের সঙ্গে তিন ম্যাচে আরেকটি বড় মিলও থাকল। তিন ম্যাচেই সেঞ্চুরি করলেন বাংলাদেশের বাঁহাতি ওপেনার। পার্থক্য বলতে প্রথম দুই ম্যাচে তামিম ইকবাল। কাল সৌম্য সরকার। তামিমের সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিক করার সম্ভাবনা পাপড়ি মেলতে না-মেলতেই ঝরে পড়েছে। ততক্ষণে অবশ্য ম্যাচের ভাগ্য লিখে দিয়েছে বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটি। ২৬তম ওভারে স্কোরবোর্ডে ১৪৫-খুব বাজে ব্যাটিং করলেই শুধু এখান থেকে হারা সম্ভব ছিল। প্রায় সাড়ে ৮ রানরেটে সৌম্য আর মুশফিকুরের হার না-মানা ৯৭ রানের জুটি সেই সম্ভাবনাকে মিরপুরের এক শ মাইলের মধ্যেও আসতে দেয়নি। মাঝখানে বিশ্বকাপ ‘হিরো’ মাহমুদউল্লাহর টানা তৃতীয় ম্যাচে ব্যর্থতা গায়েই লাগল না।
বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল সৌম্যকে। বিশ্বকাপে মাত্র একটিই হাফ সেঞ্চুরি। তবে প্রায় সবগুলো ইনিংসেই ছড়িয়ে দিয়েছেন তারুণ্যের অহংকার। এই সিরিজে আগের দুটি ম্যাচে ভালো সূচনার অংশীদার হলেও আউট হয়ে গেছেন সেট হয়ে। কাল ৪৮ রানে হাফিজের বলে উইকেটকিপার রিজওয়ান ক্যাচটা ধরে ফেললে আরেকটি আক্ষেপের গল্পই সঙ্গী হতো তাঁর। ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে থাকে বলেই হয়তো রিজওয়ান পারেননি। তা ১১০ বলে সৌম্যর অপরাজিত ১২৭ রানের ইনিংসটি সাহসের এক প্রদর্শনী বটে! যে ইনিংসটিকে মণিমুক্তোখচিত করে তুলেছে ১৩টি চার আর ৬টি ছয়। এর মধ্যে সেরা শট বেছে নিতে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে অনেকগুলোই।
সুযোগ দিয়েছিলেন আরেকটি। সেটি সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পর। উমর গুলের বলে এবার মিড উইকেটে ক্যাচ ফেললেন জুনাইদ খান। গুলের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে তাঁর পরের ওভারের প্রথম তিন বলে চার-চার-ছয়! ইনিংসের শুরুতে বাংলাদেশের দুই ওপেনারের ব্যাটিং দেখে বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল, আগের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি আসলে কে করেছেন! ২৩ বলে তামিমের ৮ রান, সৌম্যর তখন ৩৫ বলে ৩৩। কারণটা বোধ হয় মোহাম্মদ হাফিজ।
এই ম্যাচের আগের দিনই বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষায় পাস করার খবর পেয়েছেন মোহাম্মদ হাফিজ। তখনই অনুমিত ছিল, পরদিন নতুন বলটা তাঁর হাতেই তুলে দেওয়া হবে। তামিম ইকবালের সঙ্গে যে তাঁর পুরোনো ইতিহাস আছে। যেটিতে অবিসংবাদিত জয় হাফিজের। এই সিরিজের আগে দুই দলের ছয়টি ওয়ানডেতেই বোলিং ওপেন করেছেন হাফিজ। যার প্রথম পাঁচটিতেই সামনে ছিলেন তামিম। তিনবার তাঁকে আউট করেছেন। দুবার প্রথম ওভারেই শূন্য রানে। একবার প্রথম বলেও। ওই পাঁচ ওয়ানডেতে হাফিজের ৪৮ বল খেলে মাত্র ২১ রান করতে পেরেছেন তামিম। কাল তাঁকে উইকেট দেননি, তবে ২১ বলে ১১ রানের বেশি করতে পারেননি।
তামিমের মতো ব্যাটসম্যানের অবশ্য বল আর রানের ব্যবধান কমানো শুধুই সময়ের ব্যাপার। অমন ধীর শুরুর পরও ফিফটি করলেন সৌম্যর চেয়ে এক বল কম খেলেই। তামিমের দুই হাত ভরিয়ে দিয়েছে এই সিরিজ। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান ও সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছেন। দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটাও ভেঙে দিলেন কাল। রেকর্ডটা কার ছিল, জানেন? তামিম ইকবালেরই!
এই সিরিজ বাকি সব ছাপিয়ে সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত তামিমের ঘুরে দাঁড়ানোর রোমাঞ্চকর এক গল্প। তবে কালকের ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ানোর আসল গল্পটা লিখেছেন বাংলাদেশের বোলাররা। ৩৯তম ওভারে স্কোরবোর্ডে ২ উইকেটে ২০৩ এবং উইকেটে দুই সেট ব্যাটসম্যান। মাত্রই ফিফটি হলো হারিস সোহেলের। তিন বল আগে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরির আনন্দে ভেসেছেন অধিনায়ক আজহার আলী। বাংলাদেশকে তখন চোখ রাঙাচ্ছে তিন শ তাড়া করার চ্যালেঞ্জ। উইকেট চাই...উইকেট!
সেই উইকেট এনে দিয়ে পাকিস্তানের ইনিংসে ধ্বংসের বীজটা বুনে দেওয়ার কাজটা করলেন সাকিব আল হাসান। বল হাতে পেয়েছেন ১৯তম ওভারে। একটু দেরিতেই বলতে হবে, প্রথম ১১ ওভারেই যে পাঁচজন হাত ঘুরিয়ে ফেলেছেন। ৬.৩ ওভারে ১৯ রান দিয়ে উইকেটশূন্য সাকিব পরের আট বলে তুলে নিলেন ২ উইকেট। আজহার আলীকে বোল্ড করে ৯৮ রানের জুটি ভাঙলেন। পরের ওভারে রিজওয়ানকে ফিরতি ক্যাচে ফিরিয়ে পাকিস্তানকে বানিয়ে দিলেন ৫ উইকেটে ২১৩। মাঝখানে যে হারিস সোহেলকেও তুলে নিয়েছেন মাশরাফি। পরে ফাওয়াদ আলমকেও।
সেই যে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিল শুরু হলো, সেটি থামল ৪৯ ওভার শেষে। ততক্ষণে পাকিস্তান অলআউট! মাত্র ৪৭ রানে শেষ ৮ উইকেট। অর্ধেক করে নিলে চোখের পলকে ইনিংস শেষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আরও ভালো বোঝা যায়। শেষ ৪ উইকেট পড়েছে মাত্র ৭ রানে।
যেকোনো স্কোরকেই বড় বানিয়ে ফেলতে পারার যে সুনাম ছিল পাকিস্তানি বোলারদের, দ্বিতীয় ম্যাচেই সেটিকে কবর দেওয়ার কাজটা করে ফেলেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। তার পরও যদি কিছু সন্দেহ থেকে থাকে, সেটি মুছে দেওয়ার কাজটা সুসম্পন্ন হলো কাল। ৬৩ বল বাকি রেখেই ৮ উইকেটে জয়! পাকিস্তান তিন শ করে ফেললেও ‘বাংলাওয়াশ’ হতোই!
আরও পড়ুন: বাংলাওয়াশের পর অধিনায়ক মাশরাফির একান্ত সাক্ষাৎকার 'ভেতরে বিশ্বাস থাকাটা জরুরি'