ক্রিকেটীয় রূপকথা লিখে শেষ মুরালিধরনের
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
ঘোষণা দিয়ে শেষ টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন। নামের পাশে তখন ৭৯২ উইকেট। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসেবে ৮০০ উইকেটের শৃঙ্গে পা রাখতে প্রয়োজন ৮ উইকেটের। ম্যাচের শেষ উইকেটটি নিয়ে তা করে ফেলাটাকে যদি রূপকথার মতো সমাপ্তি না বলেন, তাহলে আর কোনটিকে তা বলবেন!
প্রথম প্রকাশ: ২৩ জুলাই, ২০১০। প্রথম আলো।
মিস্টার মুত্তিয়া মুরালিধরন, অনুগ্রহ করে কি জানাবেন, কে লিখেছেন আপনার শেষ টেস্টের পাণ্ডুলিপি?
গল টেস্টের শেষে মুরালিধরনময় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সঞ্চালক টনি গ্রেগ এত সব প্রশ্ন করলেন, আর এটাই কি না জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলেন!
অথচ প্রথম প্রশ্নই তো হওয়া উচিত ছিল এটা। কী উত্তর দিতেন মুরালিধরন—‘কেন, আমিই লিখেছি?’ উত্তরটা ভুল হতো। মুরালিধরনের শেষ টেস্টের পাণ্ডুলিপি তো মনে হচ্ছে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের লেখা! রূপকথার লেখক বললে ওই ড্যানিশ ভদ্রলোকের কথাই সবার আগে মনে পড়ে। গলে যা হলো, তা তো ক্রিকেটীয় রূপকথাই!
ঘোষণা দিয়ে শেষ টেস্ট খেলতে নেমেছেন। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসেবে ৮০০ উইকেটের শৃঙ্গে পা রাখতে প্রয়োজন ৮ উইকেটের। পারবেন মুরালি? ৬৬ বার যাঁর ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি, ২২ বার ম্যাচে ১০ উইকেট—তাঁর জন্য কোনো ব্যাপার হওয়ার কথা নয়।
না পারলে তিনি আর মুরালিধরন কেন? গ্যালারিতে পুরো পরিবার, রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত সব কাজ ফেলে বিদায় জানাতে এসেছেন মহানায়ককে, প্রত্যেক শ্রীলঙ্কানেরই অশরীরী উপস্থিতি গলে, তাকিয়ে আছে ক্রিকেট-বিশ্ব—অন্য কারও জন্য এসব অসহনীয় চাপ হয়ে যেত, মুরালির জন্য হলো অনুপ্রেরণা। শ্বেতশুভ্র পোশাকে শেষবারের মতো তাই জ্বলে উঠলেন স্পিন-জাদুকর। ম্যাচের শেষ উইকেটটি পড়তে বাকি, ৮০০ পুরোতে মুরালিরও চাই একটিই উইকেট...১৫ ওভারেরও বেশি স্থায়ী এই মহানাটকীয়তার মধুরেণ সমাপয়েৎ দেখল গল টেস্ট। টেস্ট ক্রিকেটে শেষ বলে উইকেট নিয়ে ৮০০ উইকেটের ‘ম্যাজিক ফিগার’, সেই উইকেটেই শ্রীলঙ্কার জয়—এটি যদি ক্রিকেটীয় রূপকথা না হয়, তা হলে আর কোথায় ওই শব্দবন্ধের প্রয়োগ হতে পারে, দয়া করে জানাবেন।
ক্রিকেটীয় রূপকথা তো বটেই, আবার কখনো মনে হচ্ছে বিদায়বেলায় মুরালিধরনের দুহাত ভরিয়ে দিয়ে ক্রিকেট বোধ হয় প্রায়শ্চিত্তও করে নিল। ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ক্রিকেট উইকেট যেমন দিয়েছে, তেমনই যন্ত্রণাও তো কম দেয়নি। সেই শুরু থেকেই ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছে বিতর্ক। ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোনো খেলোয়াড়কে নিয়ে এমন কাটাছেঁড়া হয়নি, আর কাউকে কেন্দ্র করে ক্রিকেট-বিশ্ব এমন বিভক্ত হয়ে যায়নি, আর কারও সততা নিয়ে এমন প্রতিনিয়ত প্রশ্ন ওঠেনি। বডিলাইন সিরিজ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় হতে পারে, কিন্তু সেটি ছিল নির্দিষ্ট একটা ক্রিকেট কৌশলের নৈতিকতা-অনৈতিকতা নিয়ে বিতর্ক। নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড়কে এই অন্তহীন বিতর্কের উদাহরণ শুধু ক্রিকেটে কেন, আর কোনো খেলাতেই নেই। মুরালির বোলিং অ্যাকশনের বৈধতা নিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত প্রশ্ন তুলে গেছেন অনেকে। মুরালি হাসিমুখে সব সয়ে গেছেন। ল্যাবরেটরিতে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন বারবার। প্রতিবারই সেই পরীক্ষা রায় দিয়েছে—মুরালির বোলিং অ্যাকশনে কোনো সমস্যা নেই। খালি চোখে অন্যরকম কিছু মনে হওয়ার কারণ জন্মগতভাবে বাঁকা বাহু আর অবিশ্বাস্যরকম নমনীয় কবজির সৃষ্ট বিভ্রম।
ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত যদি বলেন, সবচেয়ে প্রভাবশালীও কি নয়? মুরালির কারণেই বদলাতে হয়েছে ক্রিকেটের আইন। অ্যাকশন নিয়ে বিতর্কের কারণেই আবিষ্কৃত হয়েছে, শুদ্ধতম বোলিং অ্যাকশন বলে কিছু নেই। বোলিংয়ের সময় সব বোলারেরই হাত কিছুটা হলেও ভাঙে।
তাতেও নিন্দুকদের মুখ বন্ধ হয়নি। বেশির ভাগ ক্রিকেটারই এই চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে পালিয়ে বাঁচত। কিন্তু মুরালি তো পালানইনি, বরং দিনের পর দিন সাজিয়ে বসেছেন অবিশ্বাস্য ঘূর্ণিজাদুর প্রদর্শনী। টেস্ট ক্রিকেটে বোলিংয়ের প্রায় সব রেকর্ডই নিজের করে নিয়েছেন। শেন ওয়ার্ন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কিছুদিন, ওয়ার্নের বিদায়ের পর লড়াইটা ছিল নিজের সঙ্গে নিজের। তা করতে করতে এমনই এক উচ্চতায় তুলে নিয়েছেন নিজেকে, সেখানে কোনো দিন আর কারও পা পড়বে কি না, তা নিয়েই এখন সন্দেহ। তবে এত কিছুর পরও মুরালির সবচেয়ে বড় রেকর্ডটা পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে না। সেই ‘রেকর্ড’টি তাঁর অবিশ্বাস্য মানসিক দৃঢ়তার।
ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত যদি বলেন, সবচেয়ে প্রভাবশালীও কি নয়? মুরালির কারণেই বদলাতে হয়েছে ক্রিকেটের আইন। তাঁর অ্যাকশন নিয়ে বিতর্কের কারণেই আবিষ্কৃত হয়েছে, শুদ্ধতম বোলিং অ্যাকশন বলে কিছু নেই। বোলিংয়ের সময় সব বোলারেরই হাত কিছুটা হলেও ভাঙে। ক্যান্ডির এক বিস্কুট ফ্যাক্টরির মালিকের ছেলে শুধু স্পিন বোলিংকে নতুন মাত্রাই দেননি, শতাব্দীপ্রাচীন ক্রিকেটীয় ধ্যানধারণা ধরেও বিষম টান দিয়েছেন।
মুত্তিয়া মুরালিধরনের ক্রিকেটীয় অমরত্ব নিয়ে তাই কোনো সংশয় নেই। সেটি শুধু রেকর্ডের কারণেই নয়, ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁর প্রভাবের কারণেও। যেকোনো উইকেটে বল টার্ন করানোর ক্ষমতা, ওভারের পর ওভার ক্লান্তিহীন বোলিং, কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া ওই দুটি চোখ—এসব তো দর্শকদের মনে চিরজাগরূক হয়ে থাকবেই। সঙ্গে থাকবে মুরালিধরনের মুখে চির-অমলিন ওই হাসিটাও। এই রূপকথার মতো সমাপ্তিতে যেটি আরও বেশি ঔজ্জ্বল্য ছড়াল।
আরও পড়ুন......
• মুরালিধরন ‘জিনিয়াসের’ ব্যাখ্যা খুঁজতে কুন্ডেসালে মুরালিধরনের বাড়িতে
• সবার ওপরে মুরালিধরন
• সেই মুরালি এই মুরালি
• ‘আমার শুধু বোলিং করে যেতে ইচ্ছে করে’