ব্যাটিং গড় নিয়ে আশরাফুলকে মুরালির খোঁচা

উৎপল শুভ্র

২০ এপ্রিল ২০২১

ব্যাটিং গড় নিয়ে আশরাফুলকে মুরালির খোঁচা

মুত্তিয়া মুরালিধরন ও মোহাম্মদ আশরাফুল: লড়াইয়ের মধ্যে লড়াই

অভিষেকেই টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ার দিন থেকেই বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা মানেই ছিল মুত্তিয়া মুরালিধরন বনাম মোহাম্মদ আশরাফুল। খেলায় জিতত শ্রীলঙ্কাই, কিন্তু ব্যক্তিগত এই দ্বৈরথ বেশির ভাগ সময় অমীমাংসিত থেকে যেত। কারণ মুরালিকে আশরাফুল খুব ভালো খেলতেন। একতরফা ম্যাচেও দুজনের মধ্যে বাড়তি একটা লড়াই থাকতই। হয়তো এ কারণেই ২০০৭ সালে ক্যান্ডিতে তৃতীয় টেস্টে প্রেস কনফারেন্সে আশরাফুলের নামটা শুনেই দপ করে জ্বলে উঠেছিলেন মুরালি।

প্রথম প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০০৭। প্রথম আলো।

পি সারায় এই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসটাই একমাত্র ব্যতিক্রম। নইলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ সব সময়ই একটা নিয়ম মেনে চলেছে। বাংলাদেশের স্কোরকার্ডে ছড়াছড়ি থেকেছে ‘মুরালিধরন’ নামটির। আগের ইনিংসটিতে এক উইকেট পাওয়ার ব্যতিক্রম যে নিয়মকেই প্রমাণ করে—এটি প্রমাণ করেই ক্যান্ডিতে আবারও বাংলাদেশের জন্য বিভীষিকা হয়ে দেখা দিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। ২৮ রানে ৬ উইকেট—টেস্ট ক্রিকেটে ৫৯তম বারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট। বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৭ ইনিংসে নবমবার।

ইনিংসে ৫ উইকেট মুরালিধরনের জন্য অনেক দিনই ডালভাত হয়ে গেছে। এই রেকর্ডটিকে ক্রমশ এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন যে, ভবিষ্যতে আর কেউ এর নাগাল পাবে কি না সন্দেহ আছে। সবচেয়ে বেশিবার ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডে তাঁর পরের নামটি শেন ওয়ার্নের—৩৭ বার। ইনিংসে ৫ উইকেট নতুন নয়, তবে সর্বশেষ কীর্তিটি অন্য যে একটি রেকর্ডে তাঁর অধিকার এনে দিল, সেটি নতুন। ক্যান্ডির আসগিরিয়া স্টেডিয়ামে ১০২ উইকেট হয়ে গেল তাঁর। এই কীর্তিতে মুরালি এমনই উচ্ছ্বসিত যে, বিনয়ী হওয়ার কোনো চেষ্টাই করলেন না, ‘এসএসসি আর গলেও আমার এক শর বেশি টেস্ট উইকেট আছে। ক্যান্ডিতেও হলো। এটা দারুণ এক অর্জন। খুব বেশি লোকের এটি নেই।’

চাইলে শেষ কথাটাকে বিনয় ধরে নিতে পারেন, কারণ তিনটি টেস্ট ভেন্যুতে এক শ’র বেশি উইকেট আসলে আর কোনো বোলারেরই নেই।

বিনয়ের প্রসঙ্গ ওঠায় একটা ধাঁধার কথা বলেই ফেলি। জয়াসুরিয়া-জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারা... শ্রীলঙ্কার যে খেলোয়াড়ের সঙ্গেই কথা বলেছি, প্রশংসা শুনেছি মুরালিধরনের বিনয় নিয়ে। গত বছর বাংলাদেশ সফরের সময় জয়াবর্ধনের কথাটা তো এখনো কানে বাজে, ‘মুরালি বড় বোলার ছিল, অন্যরা তাঁকে এ কারণে মনে রাখতে পারে। কিন্তু আমি মুরালিকে সবার আগে মনে রাখব, এত সাফল্য পেয়েও সে একটুও বদলায়নি বলে।’ শ্রীলঙ্কান সাংবাদিকদের দেখছি পুরোপুরি অন্য ধারণা। তাঁদের অভিজ্ঞতা বলছে, মুরালির চরিত্র-চিত্রণে ‘বিনয়ী’র বদলে ‘নাক উঁচু-উদ্ধত’ শব্দ দুটি অনেক বেশি মানানসই। মুরালি সংবাদ সম্মেলনে আসবেন কি না—এ নিয়ে কাল শ্রীলঙ্কার মিডিয়া ম্যানেজারের উৎকণ্ঠা দেখে তাঁদের দাবিকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বলেও মনে হলো না।

ঠোঁটকাটা স্বভাব কি এই ভাবমূর্তির একটা কারণ? হতে পারে। কালই যেমন ক্যান্ডির এই মাঠের হর্তাকর্তাদের সামনেই মাঠ ছাড়া অন্য সব সুযোগ-সুবিধার তীব্র সমালোচনা করতে শুরু করলেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গেও মনভোলানো কথা না বলে সরাসরি বলে দিলেন, বাংলাদেশের বিপক্ষে কোনো দলের দুই টেস্টের সিরিজ খেলা উচিত নয়। কারণ? ‘টেস্ট খেলা ওয়ানডে খেলে শেখা যাবে না। বাংলাদেশকে টেস্ট খেলতে হবে। তবে ম্যাচের পর ম্যাচ বাজেভাবে হারতে থাকলে এটা উল্টো মন ভেঙে দিতে পারে। বাংলাদেশ তাই অন্য দেশের ‘এ’ দলগুলোর বিপক্ষে খেলার আয়োজন করতে পারে। আমরা যখন টেস্ট ক্রিকেট শুরু করেছি, তখন তো আমরা কোনো দলের বিপক্ষে এক টেস্টের বেশি পাইনি।’

দুদিন আগে প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে একটুও উন্নতি করেনি। কাল অবশ্য একটু কূটনৈতিক উত্তর, ‘বাংলাদেশ এখনো শেখার মধ্যে আছে। তবে অন্য যেকোনো দলের চাইতে শিখতে বেশি সময় নিচ্ছে।’ বাংলাদেশ দলে প্রতিভার অভাব দেখছেন না, এমনকি টেকনিকের দিক থেকেও খুব বেশি সমস্যা চোখে পড়ছে না তাঁর। একমাত্র যে সমস্যা দেখছেন, তা খেলোয়াড়দের মনে, ‘মানসিক দিকটাতে আরও অনেক অনেক উন্নতি করতে হবে ওদের।’

আশরাফুল তাঁকে ভালো খেলতেন মেনে নিলেও মুরালির প্রশ্নটা ছিল যৌক্তিক, `একজন টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং গড় এত কম কেন?` ছবি: এএফপি

বাংলাদেশের বিপক্ষে তাঁর ১৭ ইনিংসে ৭০ উইকেট, তারপরও স্বীকৃতি দিচ্ছেন, ‘ওরা স্পিনের বিপক্ষে খুব খারাপ নয়’। স্পিনের বিপক্ষে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে মুরালিধরনের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের সেরা ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল। ক্রিকেট বিশ্বেই আর কোনো ব্যাটসম্যান মুরালিকে এত ভালো খেলেন কি না—এ নিয়ে বাংলাদেশের অন্য ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আলোচনাও হয়। মুরালি কী বলেন? আশরাফুলের সঙ্গে লড়াইয়ে তাঁর পরাজয়ের ঘটনা আছে বলেই মুরালির উত্তরটা হলো খুব ঝাঁঝালো, ‘আশরাফুল ভালো ব্যাটসম্যান। আমাদের বিপক্ষে তিনটি সেঞ্চুরিও আছে ওর। কিন্তু আমাকে বলুন, টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান হয়েও ওর অ্যাভারেজ ২২ কেন? আমাদের দলের ভাসেরও তো একই রকম অ্যাভারেজ। একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের অ্যাভারেজ তো কমপক্ষে ৩৮-৪০ হওয়া উচিত।’

বৃষ্টির দয়ার ওপর নির্ভরশীল এই টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে বল করার সুযোগ পেলে শেন ওয়ার্নের পর দ্বিতীয় বোলার হিসেবে টেস্টে ৭০০ উইকেট পেয়ে যাওয়ার জোর সম্ভাবনা। সে জন্য আর মাত্র ৬টি উইকেট চাই, ওয়ার্নের ৭০৮ উইকেটের রেকর্ড টপকে যেতে আর ১৪টি। শ্রীলঙ্কার পরের সিরিজ অস্ট্রেলিয়াতেই, ওয়ার্নের দেশে গিয়েই কি তাহলে ওয়ার্নের উইকেটের রেকর্ড ভাঙছেন তিনি? মুরালির উত্তরটাকে মনে হলো নিজের ওপর চাপ কমানোর কৌশল, ‘ওয়ার্ন অবসর নিয়ে নিয়েছে। আজ হোক, কাল হোক রেকর্ডটি আমি ভাঙবই। তবে এই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে বল করার সুযোগ না পেলে অস্ট্রেলিয়াতেই তা ভাঙা কঠিন হবে। অস্ট্রেলিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই টেস্টে ১৪ উইকেট পাওয়া কঠিন। বিশেষ করে ওয়ার্ন নেই বলে ওরা নিশ্চয়ই পেস-সহায়ক উইকেটই বানাবে।’

ওয়ার্নের রেকর্ড যেদিন ভাঙবেন, সংবাদমাধ্যম নিশ্চয়ই ওয়ার্নের প্রতিক্রিয়াও জানতে চাইবে। ওয়ার্ন হয়তো আবার মনে করিয়ে দেবেন, ‘মুরালি অনেক সস্তা উইকেট পেয়েছে।’ বাংলাদেশের বিপক্ষে সাড়ে আট টেস্টে মুরালির ৭০, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৪ টেস্টে ৮৭ উইকেট ওয়ার্নের কথাটাকে শুধুই ঈর্ষাপ্রসূত বলেও মনে করাবে না। ওয়ার্নের ওই মন্তব্যের কথা তুলতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন মুরালিধরন, ‘ওয়ার্নও তো বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলেছে, একটি উইকেটও পায়নি। ওকে এটা জিজ্ঞেস করুন না!’

তথ্যটাতে সামান্য ভুল আছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে দুটিই টেস্ট খেলেছেন ওয়ার্ন। প্রথম ইনিংসটিতে কোনো উইকেট না পেলেও পরের তিন ইনিংসে পেয়েছেন ১১ উইকেট।

মুরালির চোখ-মুখ দেখে ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার সাহস পেলাম না!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×