বাংলাদেশ-হল্যান্ড ম্যাচ রিপোর্ট
চরম নাটকীয়তার পর বিশ্বকাপ স্বপ্নের কাছাকাছি বাংলাদেশ
আইসিসি ট্রফি ১৯৯৭
উৎপল শুভ্র
১২ এপ্রিল ২০২১
টেস্ট-পূর্ব বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের স্মরণীয়তম ম্যাচ সম্ভবত এটিই। হারলেই বিশ্বকাপ-স্বপ্ন শেষ, হল্যান্ডের বিপক্ষে এই সমীকরণের ম্যাচটি অনেকবার আশা-নিরাশার দোলায় দুলিয়ে শেষ পর্যন্ত হেসেছিল বাংলাদেশের দিকে চেয়ে। বৃষ্টির কারণে বাড়তি নাটকীয়তা যোগ হওয়া ম্যাচে আকরাম খান খেলেছিলেন তাঁর জীবনের সেরা ইনিংস।
প্রথম প্রকাশ: ৫ এপ্রিল ১৯৯৭। ভোরের কাগজ।
হল্যান্ড: ৪৯.৫ ওভারে ১৭১/১০; বাংলাদেশ: ৩১.৪ ওভারে ১৪১/৭; ফল: বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী।
লাহোরে গত বিশ্বকাপ ফাইনালে শ্রীলঙ্কার জয়সূচক রান আনতে যে শটটি খেলেছিলেন অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা, কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় জয়টিও এলো অধিনায়কের একই শট থেকে। থার্ডম্যানে স্টিয়ার করে বাউন্ডারির মাধ্যমে শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন রানাতুঙ্গা, আকরাম খান একই শট খেলে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় তিন রান এনে বাংলাদেশকে দাঁড় করিয়েছেন বিশ্বকাপ-স্বপ্নের একেবারে দোরগোড়ায়।
এই ম্যাচ বাংলাদেশ জিততে পারে, এটা এক সময় ভাবাই যায়নি। আবার এই ম্যাচ বাংলাদেশ হারতে পারে, এক সময় সেই আশঙ্কাকেও মনে হচ্ছিল অমূলক। ওয়ানডে ম্যাচে নাটকীয়তা খুব বিরল কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু কাল হল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের সেমিফাইনালিস্ট নির্ধারণী ম্যাচটিকে শুধু নাটকীয় বললে কম বলা হয়। চরম-নাটকীয়তার সব উপাদান ছিল এতে। একসময় যেমন নিশ্চিত মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের জয়, তেমনি উল্টোটাও মনে হচ্ছিল একসময়। এর মধ্যে আবির্ভাব ঘটল বৃষ্টির, ম্যাচটিকে পরিত্যক্ত করে দেওয়ার প্রায় সব আয়োজন সম্পন্ন করে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও যা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশকে। কারণ বাংলাদেশ তখন ১ পয়েন্ট পেয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে সেমিফাইনালে উঠতে পারলেই মহাখুশি। আবার খেলা শুরু করার কোনো ইচ্ছেই বাংলাদেশের ছিল না। তারপরও যখন তা শুরু করতে বাধ্য হলো, তখন জয়ের উজ্জ্বল আভার চেয়ে পরাজয়ের কালো ছায়ারই বেশি বিস্তার বাংলাদেশ শিবিরে।
সেই কালো ছায়াকে আলোর উদ্ভাসে উধাও করে দিয়েছে অধিনায়ক আকরাম খানের অসাধারণ এক ইনিংস। ৮৬ বলে খেলা তাঁর ইনিংসটিতে বাউন্ডারি মাত্র ৩টি। বাউন্ডারি কয়টি, তাতে কি আসে যায়! কোনো সংখ্যাতত্ত্ব দিয়েই ওই ইনিংসের মহিমার কণামাত্রও ব্যাখ্যা করা যাবে না। যাকে বলে 'ইনিংস অব আ লাইফটাইম’, সেটাই খেলেছেন আকরাম, এবং খেলেছেনও তিনি কী অবস্থায়!
চতুর্থ ওভারে আকরামকে যখন ব্যাট করতে নামতে হলো, বাংলাদেশ তখন ৩ উইকেটে ১৩। পরের ওভারেই তা পরিণত হয় ৪ উইকেটে ১৫-তে। ১৭২ রানের লক্ষ্য তখন অনেক দূরের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় শুরু হলো আকরামের লড়াই। সঙ্গী হিসেবে প্রথমে পেয়েছিলেন নান্নুকে, এরপর সাইফুলও দারুণ সাহচর্য দিয়েছেন অধিনায়ককে। তবে সাইফুলের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে আকরামের ৫১ রানের ম্যাচ উইনিং পার্টনারশিপটির আগে অনেক নাটক। বাংলাদেশের ইনিংসের ১২/১৩ ওভার খেলা হতেই আকাশ বৃষ্টির পূর্বাভাস দিতে শুরু করেছিল। বৃষ্টির কারণে ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে গেলে বাংলাদেশের কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু হল্যান্ড বিপদ বুঝতে পেরে স্পিনারদের দিয়ে বলা করাতে থাকে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, খেলায় ফলাফল আনার জন্য প্রয়োজনীয় ২০ ওভার শেষ করে ফেলা।
২০ ওভারে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে বাংলাদেশ তখন অনেক পেছনে। বিনা উইকেটে ৩৭ রান করলেই হতো বাংলাদেশের, কিন্তু ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলায় ২০ ওভারে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৭৭। অথচ ১৮ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ৫৩। এরই মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ক্রমশ তীব্র হতে থাকে। আকরাম আর নান্নুও নানা উছিলায় বৃষ্টিকে ভালোমতো নামার সময় করে দেন। মাঠের ভেতরে যেমন, বাইরেও তখন প্রবল উত্তেজনা। শেষ পর্যন্ত ১৮.৫ ওভার শেষে বৃষ্টির কারণে আম্পায়াররা বেল তুলে নিতে বাধ্য হলে বাংলাদেশ দল হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তখন শুরু হয় বৃষ্টি অনেকক্ষণ স্থায়ী হওয়ার জন্য প্রার্থনা।
সে প্রার্থনায় ফল হয়নি। পৌনে এক ঘণ্টা পর বৃষ্টি থেমে যায় এবং রাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউট মাঠের আউটফিল্ড নিশ্চিত করে দেয়, আবারও বৃষ্টি না হলে খেলা হবে। এবার যে লক্ষ্যটা আরও কঠিন হবে, সেটা তো জানাই! এরপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বেশ ক’বার আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত আর জোরেসোরে নামেনি। ম্যাচে ফলাফল নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশের ইনিংসের আর মাত্র ৭টি বল হলেই হয়, বাংলাদেশের ওপর তাই ঝুলছিল পরাজয়ের খাঁড়া। খেলা শুরু হলে ৭ বল হতে বেশি সময় লাগবে না এবং বাংলাদেশ হারবে। তাই তখন শুরু হয় উল্টো প্রার্থনা, বৃষ্টি যাতে আর না আসে।
৩৩ ওভারে বাংলাদেশের লক্ষ্য পুনঃনির্ধারিত হলো ১৪১ রান। ১৮.৫ ওভারে ৬৫ রান করায় বাকি ১৪.১ ওভারে করতে হতো ৮৫ রান। আরও সহজ করে বললে ৮৫ বলে ৮৫ রান! বৃষ্টির কারণে ভারি হয়ে যাওয়া আউটফিল্ড কাজটাকে আরও কঠিন বানিয়ে ফেলেছিল আকরামের সঙ্গে জুটি বেঁধে ৪ উইকেটে ১৪ থেকে বাংলাদেশকে ৭৭ রানে নিয়ে যাওয়া নান্নু আউট হয়ে গেলে তা কঠিনতর হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনিও নান্নুর অনুগামী হলে সেমিফাইনালের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব মনে হতে থাকে যোজন-যোজন। সেই দূরত্ব অতিক্রম করেছে আকরাম ও সাইফুলের সাহসী পার্টনারশিপ। আকরাম তো দুর্দান্ত খেলেছেনই, সাইফুলও ব্যাট করেছেন রীতিমতো স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানদের মতো। জয় যখন মাত্র ৫ রান দূরে, তখন আউট হয়ে যান সাইফুল। কিন্তু দুই ব্যাটসম্যান পরস্পরকে অতিক্রম করে ফেলায় স্ট্রাইক পান আকরাম। পরের দুই বলে দুই ও তিন রান নিয়ে উৎসবে মাতিয়ে তোলেন মাঠে ভিড় করা প্রবাসী বাংলাদেশিদের।
এই উৎসবটা লাঞ্চের সময় পুরো নিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছিল। ৪২তম ওভারে হল্যান্ডের স্কোর ছিল ৪ উইকেটে ১৩৫! হাতে উইকেট থাকায় এটাকে অনেক বড় হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ৪২তম ওভারে রফিক পর পর দুই বলে উইকেট নিলে হল্যান্ড বড় একটা ধাক্কা খায়। এরপর স্লগ ওভারে নিজে বোলিং করার সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া আকরামের দুই উইকেট এবং দুটি রান আউট হল্যান্ডকে শেষ করে দেয় ১৭১ রানেই। লাঞ্চের সময় বাংলাদেশি সমর্থকেরা ছিল উৎসবমুখর। অবস্থাটা পাল্টে যায় বাংলাদেশের ইনিংস শুরু হওয়ার ২২ মিনিটের মধ্যেই। গ্ল্যামরগনের পক্ষে কাউন্টি ক্রিকেটে খেলা রোনাল্ড লেফেব্রে রীতিমতো ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠেন। তবে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরাও দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। নিজের দ্বিতীয় (ম্যাচের তৃতীয়) ওভারে দুর্জয়কে এলবিডব্লিউ করে শুরু করেন লেফেব্রে, যদিও দুর্জয়ের দাবি, বল তাঁর প্যাডে লাগার আগে ব্যাটে লেগেছে। মাঝখানে একটি বল, এরপরই লেফেব্রের একটি লাফানো বলে সানোয়ার ঠিকমতো ব্যাট নামানোরই সুযোগ পেলেন না, ক্যাচ দিলেন উইকেটকিপারকে।
অন্য প্রান্ত থেকে বোলিং করা আসিম খানও বেশ উৎসাহ পেলেন। ২ উইকেটে ৭–এই অবস্থায় নেমে বুলবুল লফটেড অফ ড্রাইভ করে একটি বাউন্ডারি মেরে আশা জাগিয়েছিলেন। কিন্তু পরের বলেই বুলবুলও শেষ। আসিম খানের একটি লেগ-কাটার অনসাইডে খেলতে চাওয়া বুলবুলের ব্যাটের কানায় লেগে ক্যাচ চলে যায় গালিতে। ৩ উইকেটে ১৩ থেকে পরের ওভারেই বাংলাদেশ পরিণত হয় ৪ উইকেটে ১৫ রানে। আতহারকে বোল্ড করে লেফেব্রে আবারও বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন হল্যান্ডকে। শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে বাংলাদেশ। নিজেরা উদ্ভাসিত হয়েছে সেই স্বপ্নের আলোয়!