গায়ানার সেই ইনিংসের পর আশরাফুল
‘এখন আর আমি উইকেট দিয়ে আসি না’
উৎপল শুভ্র
৭ এপ্রিল ২০২১
২০০৭ বিশ্বকাপের সুপার এইটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অবিস্মরণীয় জয়ের ঘণ্টা তিনেক পর নৈশভোজ করতে বাংলাদেশ দল জর্জটাউনের একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেস্টে। খাওয়া-টাওয়া শেষ হতেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। দোতলা রেস্টুরেস্টের বারান্দায় বসে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক মোহাম্মদ আশরাফুলের এই সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলাম। যা হয়তো আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে আশরাফুলের ৮৩ বলে ৮৭ রানের অসাধারণ ওই ইনিংসের দিনটিতে।
প্রথম প্রকাশ: ৯ এপ্রিল ২০০৭। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: এমন স্মরণীয় একটা জয়, যে জয়ের নায়ক বলা যায় আপনাকে। কেমন লাগছে তা অনুমান করতেই পারি। তারপরও আপনার মুখ থেকে শুনি।
মোহাম্মদ আশরাফুল: অবশ্যই খুব ভালো লাগছে। ওরা র্যাাঙ্কিংয়ে এক নম্বর টিম, ওদের বিপক্ষে এমন একটা জয়! আমার নিজেরও এমন একটা পারফরম্যান্স করা খুব জরুরি ছিল। আমি ভালোই খেলছিলাম, কিন্তু আমার ব্যাটিং অর্ডার ছিল ৬। বিশ্বকাপের প্রথম দুটি ম্যাচে দলের প্রয়োজনে আমাকে ৭ নম্বরে নেমে যেতে হয়েছিল। তেমন কিছু তাই করতে পারিনি। তবে নিজের ব্যাটিং নিয়ে আমি খুশিই ছিলাম। মনে হচ্ছিল, ঠিকভাবেই খেলছি। বারমুডা ম্যাচে ৫ নম্বরে সুযোগ পেয়েছিলাম, ম্যাচ জিতলাম, ম্যান অব দ্য ম্যাচও হলাম। তবে আজকের ইনিংসটা অন্য ধরনের। আমার কাছ থেকে সবাই এ ধরনের ইনিংস আশা করে। আমি নিজেও করি। কারণ আমি জানি, আমি এ ধরনের ইনিংস খেলতে পারি।
শুভ্র: সুপার এইটের প্রথম দুটি ম্যাচ তো আমরা খুবই খারাপ খেলেছি। এরপরই দক্ষিণ আফ্রিকা, যাদের বিপক্ষে আমরা কখনোই ভালো করতে পারিনি। এই ম্যাচ নিয়ে আপনার চিন্তাটা কী ছিল?
আশরাফুল: প্রথম রাউন্ডের তিনটি ম্যাচেই আমি নটআউট ছিলাম। সুপার এইটের দুটি ম্যাচে ৩ আর ৬ রান করে আউট হয়ে গেছি। নিজে ভালো করিনি, টিমও ভালো করছিল না। টিম মিটিংয়ে যখন জানলাম, সুমন ভাই তিনে খেলবেন, আর আমি পাঁচে, তখনই ঠিক করেছিলাম যখনই নামি শেষ বল পর্যন্ত যেন খেলতে পারি। সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে কাজটা সহজ ছিল না। কারণ ওরা কোনো ব্যাটসম্যানকে মুহূর্তের জন্যও রিলাক্সড থাকতে দেয় না। কারণ ওরা কোনো স্পিনার নিয়ে খেলে না, সব পেস বোলার। এর একটা প্লাস পয়েন্টও আছে। একবার সেট হয়ে গেলে পেস বোলিং খেলতেই বেশি মজা। প্রথমেই তাই চেষ্টা করেছি সেট হতে। আমি নামার পরই সাকিব আউট হয়ে গেল। আফতাব এল। আমি আর ও প্ল্যান করেছিলাম, দশটা ওভার যেন উইকেট না পড়ে। উইকেট পড়লেই কিন্তু অলআউট হয়ে যাব। এই প্ল্যানটা সফল হয়েছে।
শুভ্র: ব্যাটসম্যানরা অনেক সময় প্রথম বলটা খেলেই বুঝতে পারে, এটা আমারই দিন। এমন কিছু কি মনে হয়েছিল?
আশরাফুল: আমি নেমেই একটা ফুল টস বল পেয়ে গেছি, যাতে চার হয়েছে। শূন্য থেকে বের হওয়াটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। এর পর আমি মনে হয় ৬টা বলে কোনো রান করিনি। কিন্তু তখন আমি বুঝে গেছি, থাকলে আমি রান করবই। ৬৪ বলে মনে হয় ফিফটি করেছি, পরে কিন্তু তা কাভার করে ফেলেছি। আমার চিন্তাটাই ছিল, তাড়াহুড়ো করব না। টাইম নেব।
শুভ্র: কার্ডিফের সঙ্গে জর্জটাউনের তুলনা হবেই। এই দুটি ইনিংসকে যদি তুলনা করতে বলি।
আশরাফুল: একেকটা ইনিংসে একেক রকম মজা। দুটি ইনিংসে দুই ধরনের মজা পেয়েছি। কার্ডিফে যেমন ইংল্যান্ডের মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছি, এর আগে ওখানে আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিল। কার্ডিফে জেতার পর কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে ওসব আজেবাজে কথা আর কেউ বলেনি। এখানেও যেমন সবাই বলছিল, আমরা সুপার এইটে উঠে টুর্নামেন্টের মজাটা নষ্ট করে ফেলেছি। দুটি দু ধরনের মজা। ওটা হানড্রেড, আর এটা এইটটি সেভেন।
শুভ্র: এটা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইনিংসের বিচার। আমি জানতে চাইছি ব্যাটসম্যানশিপের দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুটি ইনিংসের কোনটিকে আপনি বেশি ভালো মনে করেন?
আশরাফুল: কার্ডিফে আমি দুটি লাইফ পেয়েছিলাম। ৫৪ রানের সময় পুল করে একটি চার মেরে ৫৮ করেছিলাম। সেটি ছিল ক্যাচ, কিন্তু ধরতে পারেনি। এর পর ৮২ রানেও একটি লাইফ পাই। তবে আজ মনে হয়, আমি একটাও বাজে শট খেলিনি।
শুভ্র: জর্জটাউনের এই ৮৭ কি তাহলে কার্ডিফের সেঞ্চুরিকেও ছাড়িয়ে গেল!
আশরাফুল: দুটিকে সমান-সমানই বলা যায়।
শুভ্র: প্যাডল স্কুপ মেরে তো দক্ষিণ আফ্রিকান বোলারদের পাগল করে দিয়েছেন। যেভাবে খেলেছেন, তাতে তো মনে হলো এটি নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন।
আশরাফুল: নেটে যখন স্লগ ওভারে ব্যাটিংয়ের প্র্যাকটিস হয়, তখন এটা নিয়মিতই চেষ্টা করি।
শুভ্র: বড় ঝুঁকির শট। হয়ে গেলে খুব ভালো। কিন্তু আউট হয়ে গেলে সবাই বলবে, দেখো বেশি মাতব্বরি করতে গিয়ে আউট হলো।
আশরাফুল: এটাই তো ক্রিকেট। ঝুঁকি আছে বলেই তো সবাই এখন এই শটটা নিয়ে কথা বলছে।
শুভ্র: এর মধ্যে কি দেখানোর একটা ব্যাপার আছে? দেখো, আমি কত কিছু পারি—এই জাতীয় কিছু...
আশরাফুল: (হাসি) দেখানোর কী আছে! আমি তো জানি, আমি এই শট খেলতে পারি।
শুভ্র: ব্যাটসম্যান হিসেবে আগের আশরাফুলের সঙ্গে এখনকার আশরাফুলের পার্থক্য কী?
আশরাফুল: পার্থক্য বলতে আগে যেমন উইকেট দিয়ে আসতাম, দেড়-দু মাস ধরে তা দিই না। এই টুর্নামেন্টে যেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে উইকেটটা আমি দিয়ে এসেছি। তবে এখন চেষ্টা করি, উইকেটটা এমনিতেই দিয়ে না আসতে। শট খেলার বিলাসিতাটা এখন একটু কম করি। আগের চেয়ে শট অনেক কম খেলি।
শুভ্র: মানে ঝুঁকি আছে এমন শটগুলো আর খেলেন না, এই তো! এর মূলে কি বয়স?
আশরাফুল: বয়স। এক্সপেরিয়েন্স।
শুভ্র: আজ যে ইনিংসটি খেললেন, তেমন ইনিংস খেলার ক্ষমতা আপনার আছে এটি সবাই জানে। কিন্তু আপনার ছয় বছরের ক্যারিয়ারের গল্প হলো, অনেক দিন পর পর এমন একটা ইনিংস খেলে কিছুদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়া। কারণটা কী?
আশরাফুল: সত্যি কথাটাই বলে দিই, কারণ হলো ভালো খেললে আমি বেশি খুশি হয়ে যাই। এ জন্যই অনেক দিন পর পর এমন ইনিংস আসে। এখানেই যেমন তিনটি ম্যাচে নটআউট থাকার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বেশি কিছু করার চেষ্টা করেছি। যদি তা না করে নরমাল খেলতাম, তাহলে সেদিনও মনে হয় ভালো কিছু করতে পারতাম।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিই ধরেন না, ৬ নম্বরে নেমেছি, তখনো ১৭ ওভার ছিল। আমি একটা প্ল্যান করেই নেমেছিলাম। প্রতি ওভারে দুই-দুই করে নিয়ে ৩৪, শেষ দিকে মেরে-টেরে ফিফটি করে ফেলা সম্ভব। আমার সঙ্গে ছিল সাকিব, পরে মুশফিক। আমি নামার পরই সাকিব আউট হয়ে গেল। একটু পর মুশফিকও আউট হয়ে যাওয়ায় আমি খুব আপসেট হয়ে গেলাম যে, আমি কাকে নিয়ে খেলব!
শুভ্র: যেভাবে বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে নিজের খেলা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাটা আপনার অনেক বেড়েছে। ভালো খেলার কি এটাও একটা কারণ?
আশরাফুল: আসলে আমি এখন শট অনেক কমিয়ে ফেলেছি। আগে অনেক বেশি শট খেলতাম। আগে আমি যা চাইতাম, তা-ই করতে পারতাম। কিন্তু এখন আমার শরীরটা ওদিকে যায় না। প্র্যাকটিসের অভাব হয়তোবা। তবে ঘটনা হলো, অনেক শটই এখন আর খেলি না।
শুভ্র: এটা ভালো, না খারাপ?
আশরাফুল: অবশ্যই ভালো। আগে বেশি শট খেলতাম। ইনিংসের শুরুতে বেশি শট খেললে রান করা কঠিন। আগেও এটি জানতাম। কিন্তু ব্রেন কাজ করত না। এখন হয়তো অল্প অল্প কাজ করছে।
শুভ্র: আপনার যা প্রতিভা, তাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছয় বছর হয়ে যাওয়ার পর আপনাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের আবর্তিত হওয়ার কথা। তা যে পুরোপুরি হয়নি, এই দায়টা কার?
আশরাফুল: অবশ্যই আমার দায়। আর কাকে দোষ দেব, আমি নিজেই ভালো খেলিনি। আমার আরও বেশি রান করা উচিত ছিল। আমি ভালো খেললে বাংলাদেশ টিমটাও হয়তো অন্য রকম হতে পারত।
শুভ্র: ৭ নম্বরে ব্যাট করতে হওয়াটা নিশ্চয়ই কষ্টের ছিল।
আশরাফুল: কষ্ট... আসলে... ওই ভাবে...
শুভ্র: এটাকে আপনি কীভাবে নিয়েছিলেন?
আশরাফুল: ভালোভাবেই নিয়েছি। তখন আসলে এ ছাড়া টিমে জায়গা ছিল না। যারা আমার ওপরে খেলেছে বা খেলে, তারা প্রত্যেকেই ভালো করছিল। যেমন সাকিব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই খুব ভালো ক্রিকেট খেলছে। আমার আগে নেমে সুমন ভাইও ভালো খেলছিল। আমি এটিকে নরমালিই নিয়েছি।
শুভ্র: কিন্তু আজ যেমন আপনার ইনিংসটাই ম্যাচের চেহারা বদলে দিল, ৬ বা ৭ নম্বরে নেমে তো এমন করা কঠিন।
আশরাফুল: না, ৭ নম্বরে নেমে তো সম্ভবই না। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিই ধরেন না, ৬ নম্বরে নেমেছি, তখনো ১৭ ওভার ছিল। আমি একটা প্ল্যান করেই নেমেছিলাম। প্রতি ওভারে দুই-দুই করে নিয়ে ৩৪, শেষ দিকে মেরে-টেরে ফিফটি করে ফেলা সম্ভব। আমার সঙ্গে ছিল সাকিব, পরে মুশফিক। আমি নামার পরই সাকিব আউট হয়ে গেল। একটু পর মুশফিকও আউট হয়ে যাওয়ায় আমি খুব আপসেট হয়ে গেলাম যে, আমি কাকে নিয়ে খেলব! পাগলাকে (মাশরাফি) নিয়ে খেলব, নন স্ট্রাইকিংয়ে থেকে ওকে একটা ওভার খেলতে দেখে খুব ভরসা পেলাম না। এটাই আমার জন্য বাড়তি চাপ হয়ে গেল। ৬ নম্বর বা ৭ নম্বরে ব্যাট করাটা দারুণ চাপ।
শুভ্র: আজ ৫ নম্বরে সুযোগ পেয়ে সেটিকে তাই কাজে লাগানোর ব্যাপার ছিল। এর চেয়ে ভালোভাবে তো আর তা লাগাতে পারতেন না।
আশরাফুল: এই বিশ্বকাপে আমি পাঁচে ব্যাটিং করলাম বারমুডার সঙ্গে, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আর আজ। তিনটার মধ্যে দুটিতে আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছি। বিশ্বকাপে আসার আগে আপনাদের কাগজেই আমি বাংলাদেশের পক্ষে কে তারকা হতে পারে এই প্রশ্নের জবাবে আমার নিজের কথাই বলে এসেছিলাম। এভাবে সাধারণত কেউ বলে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, এই বিশ্বকাপে আমি ভালো কিছু করতে পারব।