ওয়ানডেতে ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরি

১৯ বছর টিকে ছিল জয়াসুরিয়ার যে রেকর্ড

উৎপল শুভ্র

৭ এপ্রিল ২০২১

১৯ বছর টিকে ছিল জয়াসুরিয়ার যে রেকর্ড

এটা ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরির ম্যাচের ছবি নয়। বিশ্ব রেকর্ডের ম্যাচ, অথচ সেই ম্যাচের ছবিই পাওয়া যায় না। অন্য ছবি দিলেও তা সাদা পোশাকের কেন? সিঙ্গাপুরের সেই ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে সাদা পোশাকেই খেলেছিলেন ক্রিকেটাররা। ছবি: গেটি ইমেজেস

৪৮ বলে ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড করার পাঁচ দিন পরই সনাৎ জয়াসুরিয়ার আরেকটি রেকর্ড। ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরির যে রেকর্ড টিকে ছিল প্রায় ১৯ বছর। সেদিন সিঙ্গাপুরের পাদাং ক্রিকেট মাঠে বসে দেখা জয়াসুরিয়ার সেই ব্যাটিং-তাণ্ডবের স্মৃতিচারণা করছেন উৎপল শুভ্র।

১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরি বিস্ময় নাকি বিস্ময় ১৯ বছর সেই রেকর্ড অটুট থাকা?

আমার তো মনে হয়, দ্বিতীয়টাই। ভারি ব্যাট, ছোট বাউন্ডারি, টি-টোয়েন্টির প্রভাবে চার-ছয় মারাটাকে যখন কখনো কখনো সিঙ্গেল নেওয়ার চেয়েও সহজ মনে হয়, সেই যুগেও রেকর্ডবুকের পাতা থেকে সনাৎ জয়াসুরিয়াকে সরাতে এত সময় লাগল!

১৯৯৬ সালের ৭ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের পাদাং মাঠে সিঙ্গার কাপের ফাইনালে জয়াসুরিয়ার ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরির সেই রেকর্ড। পাঁচ দিন আগেই ৪৮ বলে তিন অংক ছুঁয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির যে রেকর্ড গড়েছিলেন, ছয় মাসের মাথায়ই তা ভেঙে দিয়েছেন শহীদ আফ্রিদি। পরে যা ভেঙেছে আরও দুবার। কোরি অ্যান্ডারসনের হাত ঘুরে এখন যা এবি ডি ভিলিয়ার্সের।

৪৮ বলে সেঞ্চুরির এক ইনিংসে তিনটি রেকর্ড ভেঙেছিলেন জয়াসুরিয়া। ২০১৫ সালের ১৮ জুন জোহানেসবার্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এবি ডি ভিলিয়ার্সের ৪৪ বলে ১৪৯ রানের ইনিংসেও তিনটি রেকর্ড। দুটি ভেঙেছিলেন, ছুঁয়েছিলেন একটি। ভেঙেছিলেন দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরির রেকর্ড, ছুঁয়েছিলেন এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি, ১৬টি ছক্কা মারার রেকর্ড। এর আগে যা ছিল শুধুই রোহিত শর্মার। মাস দেড়েক পর ক্রিস গেইলও এই দুজনকে ছুঁয়ে ফেলেন। পরে একটি ছক্কা বেশি মেরে ইংল্যান্ডের এইউন মরগান ছাড়িয়ে যান  তিনজনকেই।    

লেখাটা জয়াসুরিয়ার ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরি নিয়ে। আমরা বরং ১৯ বছর টিকে থাকা সেই রেকর্ডের দিনটিতেই তাই ফিরে যাই। তা আবার ২৫ বছর আগে এই দিনেই। শুরুতেই আপনাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে, একটা একটা ঘটনা বলে নিই। জয়াসুরিয়া যে রেকর্ড করে ফেলেছেন, বল বাই বল হিসাব করে তা 'আবিষ্কার' করেছিলাম আমরা সাংবাদিকেরাই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে আমি আর ভারতের দ্য হিন্দু ও স্পোর্টস্টার পত্রিকার বিখ্যাত ক্রিকেট সাংবাদিক রামস্বামী মোহন।

ইন্টারনেটের এই যুগে কথাটা যে বিশ্বাস্য শোনাবে না, তা তো আগেই বলেছি। ঘটনা হলো, সিঙ্গাপুরে সেটাই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। প্রেসবক্সের তো প্রশ্নই নেই, সাংবাদিকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে মাঠের বাউন্ডারি লাইনের পাশেই তাঁবু খাটিয়ে। টেলিভিশন নেই। স্কোরার একজন আছেন বটে, কিন্তু অল্প বয়সী সেই তরুণী স্কোরারেরও ওই টুর্নামেন্টেই আন্তর্জাতিক ম্যাচে স্কোরিংয়ে অভিষেক। সাধারণ তথ্যই দিতে পারেন না, আর রেকর্ডের কথা জানাতে হলে তো আগের রেকর্ড জানতে হবে। চোখের পলকে জয়াসুরিয়ার হাফ সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পর মোহন আর আমার একই সঙ্গে কৌতূহল হলো। দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটাও কি করে ফেললেন জয়াসুরিয়া? প্রথমে দুজনের নোট মিলিয়ে দেখলাম। পরে এর সঙ্গে স্কোরবুক। বিশ্ব রেকর্ড তো হয়েই গেছে! ইন্টারনেটে বল বাই বল কমেন্টারির যুগ আসতে তখনো অনেক দেরি। সাংবাদিকেরা তাই নিজেরাই ব্যাটসম্যানের চার-ছয়ের নোট নিতাম। কী শটে, কার বলে সবকিছুই থাকত তাতে। পুরোনো সেই নোটবুকগুলো এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। দেখলে খুব নস্টালজিক লাগে।  

৪৮ বলে সেঞ্চুরির ইনিংসে ঝড়টা শুরু হয়েছিল ৫০ পেরোনাের পর, এদিন জয়াসুরিয়া করলেনই মােট ৭৬। সে জন্য খেলতে হলাে মাত্র ২৭ বল, যাতে ৮টি চার, ৫টি ছয়। সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙার পর হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটা কেউ তাঁর কানে তুলে দিয়ে থাকবে, নইলে এদিন শুরু থেকেই আরও খুনে মেজাজ কেন? 

এই লেখাটা লিখতে লিখতেও যেমন নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। বিশ্ব রেকর্ড যে হয়ে গেছে, তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু আরেকটু কনফার্ম হওয়া দরকার না? তা হওয়ার কী উপায়! মোহনের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। টেলিভিশন কমেন্টটরদের সঙ্গে তো স্কোরার আছে এবং তিনি নিশ্চয়ই এমন নবিশ নন। কমেন্ট্রি বক্সে টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই আসা-যাওয়া ছিল। কারণ সেই টুর্নামেন্টের কমেন্ট্রি টিম ছিল একেবারে তারায় তারায় খচিত। সুনীল গাভাস্কার, ইয়ান চ্যাপেল, টনি গ্রেগ...। খোলা মাঠে খেলা, সাংবাদিকেরা যেখানে খুশি যেতে পারেন। আমরা দুজন তাই হাঁটতে হাঁটতে কমেন্ট্রি বক্সের দিকে এগোলাম। কমেন্ট্রি বক্সের বাইরেই দেখা হলো টনি গ্রেগের সঙ্গে। কী আশ্চর্য, তিনিও দেখি নিশ্চিত নন! সেই নিশ্চিত হওয়ার কাজটা হলো অফিসিয়াল স্কোরারের সঙ্গে কথা বলার পর। পরে টিভিতে হাইলাইটস দেখতে গিয়ে একটু অবাকই হলাম। কমেন্ট্রিতে তো রেকর্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা বলা হয়েছে। টনি গ্রেগ কি তাহলে আমাদের প্রশ্নটাই বুঝতে পারেননি?

সিঙ্গাপুরের ওই টুর্নামেন্ট ছিল ত্রিদেশীয়, সেই সময়ের এশিয়ার তিন টেস্ট প্লেয়িং দেশের মধ্যে। সিঙ্গল লিগ পদ্ধতিতে সবাই সবার সঙ্গে খেলার পর সেরা দুই দলের ফাইনাল। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ৪৮ বলে সেঞ্চুরির পর ভারতের সঙ্গে পরের ম্যাচে জয়াসুরিয়া-ঝড় উঠতে না উঠতেই মাত্র ৭ রানে তা শেষ।  কিন্তু ফাইনালে পাকিস্তান আবারও পড়ল টর্নেডাের সামনে!

প্রথম ম্যাচে আসল ঝড়টা শুরু হয়েছিল ৫০ পেরোনাের পর, এদিন জয়াসুরিয়া করলেনই মােট ৭৬। সে জন্য খেলতে হলাে মাত্র ২৭ বল, যাতে ৮টি চার, ৫টি ছয়। সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙার পর হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটা কেউ তাঁর কানে তুলে দিয়ে থাকবে, নইলে এদিন শুরু থেকেই আরও খুনে মেজাজ কেন? ১৯৯০ সালে শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপে ১৮ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন অস্ট্রেলীয় অলরাউন্ডার সাইমন ও'ডোনেল। রেকর্ড ভাঙতে যা করতে হতাে, ঠিক তা-ই করলেন জয়াসুরিয়া, তার একটুও বেশি নয়। ঠিক এক বল কম খেলে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির নতুন রেকর্ড।

প্রথম ম্যাচের মতােই ওয়াকারের প্রথম ওভারে দুই বাউন্ডারি দিয়ে শুরু। সেই ওভার থেকে রান এলো মােট ১৪। ওই এক ওভার করিয়েই ওয়াকারকে সরিয়ে আতাউর রেহমানকে আনলেন পাকিস্তান অধিনায়ক আমির সােহেল, ফল হলাে আরও ভয়াবহ। ৩টি ছয় আর ১টি চারে তৃতীয় ওভার থেকে ২২ রান। প্রথম (ম্যাচের দ্বিতীয়) ওভারে মাত্র ১ রান দেওয়া আকিব জাভেদকে পরের ওভারের প্রথম দুই বলে ছয় ও চার মেরে আগের আনন্দ ভুলিয়ে দিলেন জয়াসুরিয়া। সাকলায়েনের করা পরের ওভারটির সময় অবশ্য আকিবের মনে হলাে, যথেষ্ট ভালাে করেছেন তিনি। সেই ওভারের প্রথম পাঁচটি বল খেলেছেন জয়াসুরিয়া, স্কোরবুকে সেগুলাে লেখা আছে এভাবে: ৬ ৪ ৪ ৪ ১। প্রথম বলে মারা ছক্কাটিতেই রেকর্ড ভাঙা ওই হাফ সেঞ্চুরি। ১৭ বলে ৫৩। যাতে ৪টি চার ও ৫টি ছয়।

এর মধ্যে ঘটে গেছে আরেকটি ঘটনা, যেটিও বিবেচিত হতে পারে রেকর্ড হিসেবে। ১১তম বলে আউট হওয়ার আগে কোনো রান করতে পারেননি জয়াসুরিয়ার ওপেনিং পার্টনার কালুভিতারানা। তাতে কী, শূন্য রানে ওপেনারের আউট হওয়া তাে আর রেকর্ড বলে বিবেচিত হওয়ার মতাে বিরল কোনো ঘটনা নয়। অবশ্যই নয়, তবে বিরল হলাে, ষষ্ঠ ওভারে আকিবের বলে বােল্ড হয়ে কালুভিতারানা যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, স্কোরবাের্ডে তখন ৭০, জয়াসুরিয়ার নামের পাশে ৬৬ আর কালুভিতারানা কিনা ০!৪ ওভারেই ৫০! এই ৫০ রানই এসেছিল জয়াসুরিয়ার ব্যাট থেকে। ছবি: ইউটিউব

৭০ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপে এক পার্টনারের কোনােই অবদান নেই, এর দ্বিতীয় কোনাে নজির যেহেতু ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে তাৎক্ষণিকভাবে খুঁজে পাওয়া গেল না, তাই এটিও রেকর্ড হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত বলে লিখেছিলাম সেদিন। এরপরও এমন কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না।

এটিকে যদি রেকর্ড হিসেবে ধরা হয়, তাহলে আরেকটি ব্যতিক্রমী ঘটনাও দাবি করতে পারে এই মর্যাদা। পাকিস্তানের মাত্র ২১৫ রানের স্কোরকে তাড়া করতে নেমে জয়াসুরিয়া-তাণ্ডবে যে শ্রীলঙ্কা ২৪ বলেই ৫০ রানে পৌঁছে গিয়েছিল, নবম ওভারের ততীয় বলে জয়াসুরিয়া আউট হওয়ার সময় যে দলের স্কোর ৯৬, ৯.১ ওভারে মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে যারা ছুঁয়ে ফেলেছিল তিন অঙ্ক, সেই শ্রীলঙ্কাই শেষ পর্যন্ত ১৭২ রানে অলআউট হয়ে ৪৩ রানে হেরে যায় সিঙ্গার কাপের সেই ফাইনাল। এমন একটা শুরুর পর এই মামুলি টার্গেটে পৌঁছুতে না পারার ঘটনাও কি ঘটেছে আর কোনাে ওয়ানডেতে? মনে করতে পারছি না।

৭৬ রানে ওয়াকারের শিকার না হয়ে আউট হয়ে ফেরার সময় এই ম্যাচে হারতে হবে, তা কল্পনাও করেননি জয়াসুরিয়া। বরং অন্য একটা আক্ষেপ তখন তাঁকে সামান্য হলেও পোড়াচ্ছিল। এমন নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি, কারণ ওই আক্ষেপের কথাটা জয়াসুরিয়ার নিজের মুখেই শোনা। পাঁচ দিন আগে গড়া দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটা যে ভেঙে দেওয়ার সুযোগ এসেছিল। সে জন্য করতে হতাে ১৯ বলে ২৪ রান। পারতেন কিনা, তা নিয়ে বাজি ধরার লােক ছিল না একজনও।

পরে ব্যক্তিগত এই আক্ষেপের সঙ্গে দলীয় আক্ষেপও মিলেমিশে এক হয়ে যায়। জয়াসুরিয়া আরও কিছুক্ষণ থাকলে তো শ্রীলঙ্কাও ওই ম্যাচ হারে না!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×