ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরি, সবচেয়ে বেশি ছক্কা, এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান

তিন বিশ্ব রেকর্ড ভাঙা জয়াসুরিয়ার এক ইনিংস

উৎপল শুভ্র

২ এপ্রিল ২০২১

তিন বিশ্ব রেকর্ড ভাঙা জয়াসুরিয়ার এক ইনিংস

জয়াসুরিয়াকে সেদিন দেখা গিয়েছিল সংহারী প্রতিমায়। ছবি: আইসিসি

এ এক আশ্চর্য ম্যাচ। চার বিশ্ব রেকর্ডের এক ম্যাচ। যে রেকর্ডের তিনটিই আবার সনাৎ জয়াসুরিয়ার। তা দেখতে সেদিন সিঙ্গাপুরের পাদাং মাঠে হাজার দেড়েক দর্শক আর হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক। যাঁদের মধ্যে ছিলেন উৎপল শুভ্রও। জয়াসুরিয়াকে নিয়ে তাঁর সেদিনের লেখা।

প্রথম প্রকাশ: ৩ এপ্রিল ১৯৯৬। ভোরের কাগজ।

রেকর্ডের পর রেকর্ড ভেঙে পড়ছে, তা টেরই পাননি সনাৎ জয়াসুরিয়া। আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে জানতে পারলেন, এক ইনিংসেই রেকর্ড বুকের অনেক কিছু বদলে দিয়েছেন তিনি। এক দিনে এক ইনিংসে করে ফেলেছেন তিন-তিনটি বিশ্ব রেকর্ড। রেকর্ড তো এটিও। 

গত ৯ মার্চ ফয়সলাবাদে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরির যে রেকর্ডটি হেলায় হারিয়েছিলেন, তার জন্য বেশিদিন অনুতাপ করতে হলো না বিধ্বংসী এই্ ওপেনারকে। মাত্র ২৩ দিন পরই রেকর্ডবুক থেকে মুছে দিলেন ৬২ বলের রেকর্ডটি। বিকেলে মাঠে এসে ভারতীয় অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন জানলেন, ১৯৮৮-৮৯ সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বরোদায় গড়া তাঁর রেকর্ডটি আর নেই। 

জয়াসুরিয়ার সেঞ্চুরি এসেছে মাত্র ৪৮ বলে। যাতে রচিত হয়েছে জয়াসুরিয়ার গড়া তিন বিশ্ব রেকর্ডের একটি। অন্য দুটি রেকর্ডও উইকেটে অভূতপূর্ব প্রমত্ততার সাক্ষী। ৬৫ বলে ১৩৪ রানের ইনিংসে ১১টি ছক্কা মেরেছেন। এত দিন ওয়ানডেতে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার রেকর্ড ছিল ৮টি। ১৯৮৯ সালের ১৮ মার্চ ভারতের বিপক্ষে অ্যান্টিগার সেন্ট জনসে তা মেরেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ওপেনার গর্ডন গ্রিনিজ।

এগারো ছক্কার একটি মারার পরে। ছবি: ইউটিউব

সিঙ্গাপুরের পাদাং ক্রিকেট মাঠটি খুব বড় নয়। এতে যে ছক্কার ঝড় তুলতে জয়াসুরিয়ার সুবিধাই হয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ জন্য তাঁর কীর্তিতে কোনো ছায়াই পড়ছে না। একই মাঠে তো খেলেছেন বাকি ব্যাটসম্যানরাও, কই, তাঁদের কেউ তো এমন ধ্বংসলীলার নায়ক হয়ে উঠতে পারেননি।

সবচেয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরি, সবচেয়ে বেশি ছক্কার সঙ্গে এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান তোলার রেকর্ডটিও এখন জয়াসুরিয়ার। পাকিস্তানি অধিনায়ক আমির সোহেলের করা শ্রীলঙ্কার ইনিংসের ১৪ নম্বর ওভার থেকে রান উঠেছে ৩০, এর ২৯-ই জয়াসুরিয়ার ব্যাট থেকে। ওভারের প্রথম বলটি ছিল ওয়াইড। ‘নো’ ঘোষিত দ্বিতীয় বলটিতে বাউন্ডারি মেরেছেন জয়াসুরিয়া। পরের বলটিতে রান নিতে পারেননি বলেই হয়তো রাগ হয়ে থাকবে তাঁর। পরের চারটি বলই তাই হাওয়ায় উড়ে সীমানার বাইরে। পর পর চার বল ছক্কাও কি বিশ্ব রেকর্ড? রেকর্ড নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে করতে প্রাণান্ত অবস্থা, এটা খোঁজার সময় আছে নাকি!  

পরপর চার ছক্কায় আমির সোহেলের করুণ মুখ দেখেই সম্ভবত ওভারের শেষ বলে ১ রান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন জয়াসুরিয়া। এক ওভারে ৩০ রান ওয়ানডেতে নতুন রেকর্ড। এর আগে ওয়ানডেতে এক ওভারে ২৭ রানের বেশি আসেনি কখনো। সেটিও আবার এসেছে দুবার। মজার ব্যাপার হলো, দুবারই তা তুলেছেন এ দিন জয়াসুরিয়ার তাণ্ডবের ভুক্তভোগী পাকিস্তানিরা। 

১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে কলম্বোতে মুত্তিয়া মুরালিধরনের এক ওভারে ২৭ (৪, ১, ৬, ৬, ৪, ৬) রান তুলেছিলেন সেলিম মালিক ও আসিফ মুজতবা। গত বছর অক্টোবরে শারজায় চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এই রেকর্ডের সমকক্ষতা অর্জন করেন পাকিস্তানেরই দুই ব্যাটসম্যান মঈন খান ও রমিজ রাজা। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার ইয়ান বিশপের ওভারে এই দুজনের ব্যাট থেকে ২৭ রান এসেছিল এই ক্রম অনুযায়ী: ৪, ১, ৪, ৬, ৬, ৬।

বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়ার পর এটাই সনাৎ জয়াসুরিয়ার প্রথম টুর্নামেন্ট। এই ম্যাচে তাই বাড়তি একটা আকর্ষণ হয়ে তো ছিলেনই তিনি। মাঠে আসা হাজার দেড়েক দর্শক, যাদের বেশির ভাগই শ্রীলঙ্কান, দর্শনীয় কিছুর প্রত্যাশা নিয়েই কাজ থেকে ছুটি নিয়ে ছুটে এসেছিলেন মাঠে। তবে সেই প্রত্যাশা যে এভাবে মেটাতে পারবেন, সেটা জয়াসুরিয়া নিজেও ভাবেননি। এক দিনে তিনটি বিশ্ব রেকর্ডের মালিক হয়ে যাওয়ার পর ‘এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন’-এ কথা শোনার মানসিক প্রস্তুতি তাই ছিলই।

'৯৬ বিশ্বকাপ থেকেই প্রতিপক্ষ জয়াসুরিয়ার এমন রুদ্ররূপে অভ্যস্ত। ছবি: গেটি ইমেজেস

ঝোড়ো ইনিংস তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই খেলছেন। এতই নিয়মিত যে, প্রথম ১৫ ওভারের ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার নিয়ম নিয়েও প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করছেন প্রতিপক্ষ অধিনায়কদের। তবে এ দিন ওয়ানডেতে তাঁর দ্বিতীয় সেঞ্চুরির ইনিংসটি ছাড়িয়ে গেছে ওয়ানডের বন্য আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের সব ইতিহাস। 

৩২ বলে এসেছে তাঁর প্রথম ফিফটি। তাতে বাউন্ডারি ৭টি, ওভার বাউন্ডারি ১টি। ফিফটি হয়ে যাওয়ার পর ছক্কার দিকে একটু বাড়তি মনোযোগ দেন। মাত্র ১৬ বলে আসা দ্বিতীয় ফিফটিতে মাত্র ২টি বাউন্ডারির পাশে তাই ওভার বাউন্ডারি ৬টি। সেঞ্চুরির পর ৩৪ রান করতে ১৪ বল খেলতে হয়েছে, এতে আরও ২টি বাউন্ডারি ও ৪টি ওভার বাউন্ডারি। সব মিলিয়ে ৬৫ বলে ১৩৪ রানের ইনিংসে বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারি সমান, ১১টি করে।

সেঞ্চুরিতে পৌঁছতে ৩৩টি স্কোরিং শট লেগেছে তাঁর, ১৩৪ করতে ৪১টি। এদিনের বিবেচনায় এটিকে বিস্ময়করই বলতে হবে যে, ২১টি বল ছিল ‘ডট’ অর্থাৎ যা থেকে জয়াসুরিয়া রান করতে পারেননি। ১১টি করে চার ও ছয় ছাড়া তাঁর ইনিংসে সিঙ্গেল ১১টি, দুই রান নিয়েছেন ছয়বার।

অন্য দুজনের মতো গ্ল্যামার তাঁর নেই। তবে সত্যিটা হলো, ভারতের বিপক্ষে খেলার আগে প্রতিপক্ষ যেমন শচীন টেন্ডুলকারকে নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যেমন ভাবে ব্রায়ান লারাকে নিয়ে, এখন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ মানেই সনাৎ জয়াসুরিয়ার জন্য টিম মিটিংয়ে অনেকটা সময় বরাদ্দ রাখা।

তবে এখন পর্যন্ত সেই আলোচনা ফলপ্রসু হয়েছে বলে দাবি করতে পারছে না কোনো দল।

আরও পড়ুন:
এই ইনিংসের পাঁচ দিন পর জয়াসুরিয়ার আরেক কীর্তি
১৯ বছর টিকে ছিল জয়াসুরিয়ার যে রেকর্ড

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×