আরও উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্ন
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৪
উৎপল শুভ্র
২৭ মার্চ ২০২১
টেস্ট অভিষেকের চার বছর দুই মাস পর ধরা দিয়েছিল সেই আরাধ্য স্বপ্ন। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়! ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে সেই জয় চিরদিনই অন্যরকম একটা জায়গা নিয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সেই টেস্টের প্রতিটি দিনই তাই আবার ফিরে দেখার মতো।
প্রথম প্রকাশ: ৮ জানুয়ারি ২০০৫। প্রথম আলো।
দ্বিতীয় দিন শেষে বাংলাদেশের টেস্টের এমন চেহারা নতুন কিছু নয়! এক দল রানের পাহাড় গড়বে, তারপর অন্য দল ব্যাট করতে নেমেই হারিয়ে ফেলবে ৪-৫ উইকেট— এমনই তো হয়ে এসেছে বেশির ভাগ টেস্টে। পার্থক্য একটাই, এখানে প্রথম দলটি বাংলাদেশ! এতদিন বাংলাদেশ যে যন্ত্রণা সয়ে এসেছে, চট্টগ্রাম টেস্টে সেটিই ফিরিয়ে দিচ্ছে জিম্বাবুয়েকে।
বাংলাদেশের টেস্টে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত দুটো শব্দ ‘ফলোঅন’ আর ‘ইনিংস পরাজয়’কালও উড়ে বেড়াল এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে। তবে এই প্রথম বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের বড় ভালো লাগল শব্দ দুটি। টেস্টের এখনো তিন দিন বাকি, এখনই ইনিংস ব্যবধানে জয় নিয়ে ভাবাটা একটু বাড়াবাড়িই। তবে জিম্বাবুয়েকে ফলোঅন করানোর স্বপ্ন তা নয়। বাংলাদেশের ৪৮৮ রানের জবাব দিতে নেমে দিনশেষে জিম্বাবুয়ে ৪ উইকেটে ৮৪। ফলোঅন এড়াতে তাদের চাই আরো ২০৫ রান। আশরাফুলের আগে টেস্ট অভিষেকে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ডটা যার ছিল, সেই হ্যামিল্টন মাসাকাদজা আছেন উইকেটে। এরপর আছেন টাটেন্ডা টাইবু ও এল্টন চিগুম্বুরা। তাতে কী, বাংলাদেশেরও তো আছে মোহাম্মদ রফিক।
৮ ওভারে ১৫ রান দিয়ে ২ উইকেট তুলে নিয়েছেন কাল, আজও ওই বাঁহাতি স্পিনারই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড। কাল পড়ন্ত বিকেলে ভুসিমুজি সিবান্দা আর ‘নাইটওয়াচম্যান’গ্রায়েম ক্রেমারের জন্য মৃত্যুদূত হয়ে এল তার যে আর্মার, সেটিই এখন বাংলাদেশের স্বপ্নের বাহক। স্পিনাররাই তুরুপের তাস—এটা জানা ছিল আগেই। তাই বলে পেসাররা কিছুই করবেন না? করলেন। জিম্বাবুয়ের দুই ওপেনার ৭ ওভার নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দেওয়ার পর প্রথম আঘাতটা হানলেন তাপস বৈশ্যই। স্টুয়ার্ট মাৎসিকেনেরি আর বার্নি রজার্সের উদ্বোধনী জুটিটা জমে গিয়েছিল। জুটি কোথায়, মাৎসিকেনেরি একাই তো! ৩১ রানের ২৮-ই তার, প্রথম স্লিপে হাবিবুলের দারুণ এক ক্যাচের শিকার হয়ে যখন ফিরে যাচ্ছেন, রজার্সের নামের পাশে তখনো শূন্য! এরপর মোহাম্মদ রফিকের ওই দুই আর্মার আর তার মাঝখানে সৌভাগ্যের একটু ছোঁয়ায় রজার্সের উইকেট। মাসাকাদজার স্ট্রেট ড্রাইভ বোলার এনামুলের হাত ছুঁয়ে যখন নন-স্ট্রাইকার প্রান্তের উইকেট ভেঙে দিল, রজার্সের ব্যাট তখনো ক্রিজের বাইরে।
২৮ ওভার বোলিং করার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ, তাতেই ৪ উইকেট। এর বেশি হয়তো হাবিবুল বাশারও আশা করেননি। এর আগে বাংলাদেশের ব্যাটিংও যেমন তার আশা ছাড়িয়ে গেছে। চা-বিরতি পর্যন্ত ব্যাট করতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস শেষ হলো সেটিরও মিনিট পনের পর। সেন্ট লুসিয়ার ৪১৬-কে ছাড়িয়ে টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটিও হয়ে গেল ৪৮৮। প্রায় ৫০০ রান, অথচ কোনো সেঞ্চুরি নেই! আরেকটি রেকর্ডও প্রায় হয়েই যাচ্ছিল। টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরিবিহীন সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডটি ৯ উইকেটে ৫২৪, ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কানপুর টেস্টে ভারতের ওই ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি ছিল ৬টি। রেকর্ডপত্র ঘেঁটে বাংলাদেশের ৪৮৮-এর চেয়ে সেঞ্চুরিবিহীন বড় ইনিংস পাওয়া যাচ্ছে আর একটিই। ১৯৮১-৮২তে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্ন টেস্টে পাকিস্তানের ৮ উইকেটে ৫০০ রানের ঘোষিত ইনিংসেও হাফ সেঞ্চুরি ছিল ৬টি।
বাংলাদেশের ইনিংসেও তা-ই হতো, যদি খালেদ মাসুদ আর মাশরাফি বিন মুর্তজা ১ আর ২ রানের জন্য তা মিস না করতেন। অন্য সময় হলে আফসোস হতো, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটকে প্রথমবারের মতো খুব আনন্দের ব্যাপার মনে হওয়ায় এসব ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা মনে থাকছে না বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের। এই টেস্টে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি বড় হয়ে উঠবে না, হয়তো এটি নিয়তি-নির্ধারিত বলেই হাবিবুল বাশারের পর রাজিন সালেহও গাড়ির চাবিটা হাতে পেয়েও পেলেন না।
টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরির জন্য গাড়ি; গাড়ি আছে ম্যাচে প্রথম ৮ উইকেট পাওয়া বোলারের জন্যও। বোলারদের জন্য স্বপ্নটা এখনো জীবিত, ব্যাটসম্যানদের জন্য শেষ। পরশু গাড়ির চেয়ে ৬ রান দূরে থাকতে ফিরে আসতে হলো হাবিবুলকে, কাল রাজিনকে থেমে যেতে হলো ১১ রান দূরত্বে। প্রথম দিন শেষে ৬০ রানে অপরাজিত ব্যাটসম্যানকে সিলেট থেকে তার মা ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ওই ৪০টা রান করিস।‘ মা নিশ্চয়ই গাড়ির কথা ভেবে বলেননি, ছেলের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটাই বড় ছিল তাঁর কাছে। ২৩০ মিনিটের ইনিংসে বলতে গেলে একবারও যিনি ভুল পা ফেলেননি, সেই রাজিন মিড অফকে লং অফে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে দেখে আস্তে ড্রাইভ করে এক রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটিই ক্যাচ হয়ে ফিরে গেল বোলার মাৎসিকেনেরির হাতে। তার উল্লাসের তীব্রতা দেখে ভুল করে কেউ ভাবতেই পারতেন, রাজিনের হারানো গাড়িটা বোধ হয় মাৎসিকেনেরিই পেয়ে গেলেন!
প্রথম সেশনে বাংলাদেশের হারানো দ্বিতীয় উইকেট এটি। দিনের তৃতীয় ওভারেই আফতাবকে হারিয়ে ফেলাটা বড় কোনো আক্ষেপের কারণ হয়নি এর পরের ৩টি পার্টনারশিপই পঞ্চাশোর্ধ হওয়ায়। রাজিন ও রফিকের সঙ্গে ৫৮ ও ৬৯ রানের দুটি জুটির অংশীদার খালেদ মাসুদ। এরপর রফিক আর মাশরাফির দর্শকমাতানো যুগলবন্দি। ৯৮ বলে রফিকের ৬৯, যাতে ৬টি চার, ৪টি ছয়। ৮টি চার আর ১টি ছয়ে সাজানো মাশরাফির ৪৮ মাত্র ৪৪ বলে। মাত্র ১০.২ ওভারে এই দুজনের ৬২ রানের জুটিটি দিনের শুরুর ঠিক উল্টো পিঠ। প্রথম ঘণ্টায় ১৪ ওভারে বাংলাদেশ তুলেছিল মাত্র ২৪ রান। পরের ঘণ্টায় ১৪ ওভারে ৪২। সকালে মাত্র ১০ ওভারের পুরনো চকচকে বল, সেটির ঔজ্জ্বল্য কেড়ে নিতে অমনই খেলতে হতো। এই প্রথম ‘সত্যিকার টেস্ট’ খেলছে বাংলাদেশ এবং তা খেলছে আদর্শ টেস্ট ম্যাচের নিয়ম মেনেই। প্রথম সেশনের ওই শম্বুকগতির পর দ্বিতীয় সেশনে ২৮ ওভারে ১৩৪ রান!
টেস্ট ম্যাচ কীভাবে খেলতে হয়, বাংলাদেশ তো তা শিখেই ফেলেছে!
আরও পড়ুন...
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-১
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-২
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৩
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৫
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৬
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৭
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৮