টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৩
প্রথম দিনটি মনের মতোই কাটল বাংলাদেশের
উৎপল শুভ্র
২৭ মার্চ ২০২১
টেস্ট অভিষেকের চার বছর দুই মাস পর ধরা দিয়েছিল সেই আরাধ্য স্বপ্ন। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়! ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে সেই জয় চিরদিনই অন্যরকম একটা জায়গা নিয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সেই টেস্টের প্রতিটি দিনই তাই আবার ফিরে দেখার মতো।
প্রথম প্রকাশ: ৭ জানুয়ারি ২০০৫। প্রথম আলো।
টসে জিতবেন, প্রথমে ব্যাটিং করবেন এবং দিনশেষে রানের নিচে চাপা পড়ার চোখরাঙানি থাকবে জিম্বাবুয়ের দিকে—এই টেস্টের যে পাণ্ডুলিপিটা মনে মনে লিখে রেখেছিলেন হাবিবুল বাশার, প্রথম দিনটি সেই পাণ্ডুলিপিমতোই হলো। প্রথম দুটো ঠিকমতোই হয়েছে, রানের ব্যাপারটিও ঠিক আছে। শুধু উইকেটের ঘরে ৪-ই যা একটু আফসোস জাগাচ্ছে হাবিবুলের মনে। ওখানে ‘৩’ থাকলে হাবিবুল তৃপ্তির হাসি হেসে বলতে পারতেন, ‘হ্যাঁ, যা চেয়েছিলাম, প্রথম দিনটি ঠিক তা-ই দিয়েছে।’
উইকেটের ঘরে ৩-এর জায়গায় ৪, অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের জন্য সামান্য একটু আফসোস ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু ব্যাটসম্যান হাবিবুল বাশারের জন্য তা অনন্ত আক্ষেপের আরেক নাম। উইকেটের ঘরে ‘৪’ হয়েছে তাঁর কারণেই। হঠাৎ মনসংযোগ হারিয়ে ফেলে বাজে একটি শট খেলে ফেলাতেই প্রথম দিনের তিন ওভার বাকি থাকতে আউট হয়ে গেছেন বাংলাদেশ-অধিনায়ক। রান তখন ৯৪!
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই মাঠেই তাঁর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। কাল চতুর্থ টেস্ট সেঞ্চুরির জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাতে দর্শকদের সব প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন, তখনই হাতের মুঠো থেকে তা ছুড়ে ফেললেন হাবিবুল। বাংলাদেশের অনেক কিছুতেই তিনি প্রথম, তবে কাল যে ‘প্রথম’টি যোগ হলো নামের সঙ্গে, এটিতে বড় বেশি যন্ত্রণা। পাকিস্তানের বিপক্ষে পেশোয়ার টেস্টে ৯৭ রানে আউট হয়েছিলেন, ‘নার্ভাস নাইনটিজে’ দুবার আউট হওয়া বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হাবিবুল বাশার।
পার্শ্বচরিত্র হিসেবে জাভেদ ওমর-নাফিস ইকবালের রেকর্ড ওপেনিং পার্টনারশিপ আছে, আছে রাজিন সালেহর অপরাজিত ৬০-ও, তবে হাবিবুলের ৯৪-ই কালকের দিনের হাইলাইট। চট্টগ্রাম আবারও দেখল সেই হাবিবুলকে, কোচ ডেভ হোয়াটমোর যাঁকে বলেন ‘ইউনিক’। কাভার ড্রাইভ, স্কয়ার ড্রাইভ, স্কয়ার কাট, লেগ গ্ল্যান্স—কোন শটটি খেলেননি! আর প্রিয় শট পুল তো খেলবেনই। যে বলটিতে আউট হলেন, ঠিক তার আগের বলেই লং লেগ আর স্কয়ার লেগে দাঁড়ানো দুই ফিল্ডারকে শল্যবিদের দক্ষতায় ব্যবচ্ছেদ করল তাঁর অসাধারণ এক পুল। মাত্র ৫৬ বলে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলার পর জিম্বাবুয়ের নেগেটিভ বোলিং আর দিনের শেষে অপরাজিত থাকার ইচ্ছা মিলিয়ে হাবিবুলের ব্যাটে স্ট্রোকের ছটাটা একটু অনুজ্জ্বল হয়ে ছিল। জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় নতুন বল নেওয়ার পর ফিরে এলেন চেনা হাবিবুল। শেষ পর্যন্ত কাল হলো সেই নতুন বলই। ক্রিস্টোফার পোফুর অফ স্টাম্পের বাইরের বলটিতে ব্যাট চালিয়ে দিলেন, ডান দিকে ডাইভ দিয়ে দারুণ এক ক্যাচ নিয়ে নিলেন উইকেটকিপার টাটেন্ডা টাইবু।
টাইবুর জন্য কিছুটা হলেও প্রায়শ্চিত্তের কাজ করল ওই ক্যাচ। নইলে বাংলাদেশের জন্য দিনটি এমন তৃপ্তিময় হয়ে থাকায় তো ভূমিকা আছে তাঁরও। মাত্র ৯ রানে (বাংলাদেশের তখন ১৫) হোন্ডোর বলে নাফিস ইকবালের ক্যাচটি ফেলে না দিলে দিনশেষে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের বাতাসে এমন আলোর নাচন না-ও থাকতে পারত।
প্রথম দিন শেষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের স্বপ্ন যে এতটা উজ্জ্বল, তাতে বড় অবদান দুই ওপেনারের। ‘ভালো শুরু মানে অর্ধেক কাজ হয়ে গেল’—ওপেনিংয়ের গুরুত্ব বোঝাতে যত কথা বলা হয়, তার মধ্যে এটিই বোধ হয় সেরা। বাংলাদেশের জন্য সেই ওপেনিংই হয়ে ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম। আসল সময়ে জ্বলে উঠল সেটিই।
বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লাঞ্চ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন থাকলেন দুই ওপেনার। ওপেনিংয়ে বাংলাদেশের রেকর্ড থেকে জাভেদ ওমর ও নাফিস ইকবাল তখন মাত্র ১ রান দূরে। তিন বছর আগে এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই মাঠেই জাভেদ ওমর ও আল-শাহরিয়ারের ৭৩ রান রেকর্ড হয়ে ছিল এত দিন। লাঞ্চের পর প্রথম ওভারেই অতীত হয়ে গেল তা।
ওপেনিং জুটিতে ৯১ রান ওঠার পর আট বলের মধ্যে দুই ওপেনারের বিদায়ে বড় একটা ধাক্কাই লেগেছিল। আশরাফুলের সঙ্গে ৬০ ও রাজিনের সঙ্গে ১১৯ রানের দুটি জুটি গড়ে সেই ধাক্কা সামলেছেন হাবিবুল। গত সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সফরে টেস্ট অভিষেকের পর ভারতের বিপক্ষে এই চট্টগ্রাম টেস্টেই প্রথম বাদ পড়েছিলেন রাজিন সালেহ। এটি তাই তাঁর কামব্যাক টেস্ট এবং কী দারুণভাবেই না কামব্যাক করলেন তিনি! ভারতের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে ৮২ রানই ফিরিয়ে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস; কালও রাজিনের ব্যাটে যা ফুটে বেরোল। গত কিছুদিন তাঁকে জড়িয়ে ধরা রক্ষণাত্মক মানসিকতার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে দারুণ সব স্ট্রোক খেললেন, পেসার চিগুম্বুরার বলে লং অফের ওপর দিয়ে দিনের একমাত্র ছক্কাটিও তাঁরই।
গত পরশু জিম্বাবুইয়ান অধিনায়ক টাটেন্ডা টাইবু রহস্যময় হাসি হেসে বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য কিছু সারপ্রাইজ জমা রেখেছেন তিনি। সেই সারপ্রাইজ কী, তা অজানাই থাকল। হয়তো গ্রায়েম ক্রেমারই সেই সারপ্রাইজের নাম। তিন দিনের ম্যাচে না খেলিয়ে টেস্ট ম্যাচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে এই লেগ স্পিনারকে। তবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য ক্রেমার যে কোনো ‘সারপ্রাইজ’ হয়ে আসেননি, ১১ ওভারে ৫৬ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকাই তার প্রমাণ। এল্টন চিগুম্বুরা দু-একটা বল তুলেছেন, এর একটিতেই আউট হয়েছেন জাভেদ ওমর। বাকি বোলারদের কেউই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের খুব একটা পরীক্ষায় ফেলতে পারেননি। চা-বিরতির ঠিক আগে ফ্লিক করতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে মাসাকাদজার দারুণ এক ক্যাচে পরিণত হয়েছেন আশরাফুল, এনকালার বলে ভুল করে পেছনের পায়ে খেলতে গিয়ে শর্ট লেগে ক্যাচ দিয়েছেন নাফিস। উইকেট দুটি এনকালার নামের পাশেই লেখা থাকবে, তবে তাতে তাঁর যতটা কৃতিত্ব, তার চেয়ে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতাই বোধ হয় বেশি।
আজও জিম্বাবুইয়ান বোলারদের চেয়ে নিজেদের সঙ্গেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আসল লড়াই। সেই লড়াইয়ে জিতলে দ্বিতীয় দিন শেষে প্রথম টেস্ট জয়ের সুবাসটা আরো একটু তীব্র হয়েই এসে লাগবে নাকে।
আরও পড়ুন...
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-১
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-২
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৪
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৫
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৬
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৭
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৮