বাংলাদেশ দল যেন সুখী পরিবারের বিজ্ঞাপন
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
আগের রাতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ে খুলে গেছে স্বপ্নের দরজা। যে দরজার ওপাশে কোয়ার্টার ফাইনাল। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে শেষ গ্রুপ ম্যাচ খেলতে হ্যামিল্টন যাত্রাটা তাই এমন আনন্দমুখর। অ্যাডিলেড থেকে অকল্যান্ডগামী বিমানে বাংলাদেশ দলের সঙ্গী সাংবাদিক বলছেন সেই অভিজ্ঞতার গল্প।
প্রথম প্রকাশ: ১১ মার্চ, ২০১৫। প্রথম আলো।
এয়ার নিউজিল্যান্ড ফ্লাইট নম্বর সেভেন নাইন টু অ্যাডিলেড থেকে অকল্যান্ড উড়ানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি।
এ পর্যন্ত রুটিন ঘোষণাই ছিল। কিন্তু এরপর বিমানের সাউন্ড সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়া কথাগুলো শুনে মনে হলো, ককপিটে ক্যাপ্টেন বুঝি বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচের স্কোরকার্ড সামনে নিয়ে বসেছেন!
কাল রাতে দারুণ জয়ের জন্য বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন।
সেঞ্চুরি করার জন্য মাহমুদউল্লাহকে অভিনন্দন।
৭৭ বলে ৮৯ রানের ইনিংসটির জন্য মুশফিকুর রহিমকে।
রুবেল হোসেনকে চার উইকেটের জন্য অভিনন্দন।
যাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর মুখে লাজুক হাসি, আর বাংলাদেশ দলের বাকি খেলোয়াড়েরা সোল্লাসে হইহই করে উঠছেন। মুখগুলোতে রাত জাগার ক্লান্তি। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে হোটেলে ফেরার পর বিছানায় যেতে যেতে প্রায় ভোররাত। সকাল নয়টায়ই আবার বিমানবন্দরমুখী বাস। সাড়ে তিন ঘণ্টায় অ্যাডিলেড থেকে অকল্যান্ড। অকল্যান্ড বিমানবন্দরের একেবারে গা ঘেঁষা নভোটেল হোটেলে রাতটা কাটিয়ে পরদিন মানে আজ সকালে বাসে ঘণ্টা দুই দূরত্বের হ্যামিল্টনে যাবে বাংলাদেশ দল।
এত ধকল সামলে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ গ্রুপ ম্যাচটা খেলার কী দরকার! ‘এ’ গ্রুপের চার কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় এটি তো শুধুই প্র্যাকটিস ম্যাচ। মাশরাফি বিন মুর্তজা হাসেন, ‘কী বলেন, এই ম্যাচটাও যদি জিতে যাই, ভাবেন কোয়ার্টার ফাইনালে কেমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে নামব!’ ডান পাশে এক সারি সামনের সিট থেকে সাকিব আল হাসান মনে করিয়ে দেন, ‘ওদের বিপক্ষে শেষ সাত ম্যাচে তো আমরা ৭-০, তাই না?’
অনুশীলন, ম্যাচ আর টিম মিটিংয়ের বাইরে সাকিব আর তাঁর স্ত্রী শিশির সব সময় জোড়া হয়েই ঘুরছেন। বিমানে তাঁদের পাশের আসনে সৌম্য সরকার। নতুন এই ছেলেটা দলে একটা ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দিয়েছে বলে একটু আগেই যাঁর প্রশংসা করেছেন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। যা শুনে মাশরাফি সৌম্যর পেটে খোঁচা দিয়ে টিপ্পনী কাটলেন, ‘কী এমন খেলেছে! ফিফটি-হানড্রেড মারুক, তারপর না! তোর মতো তিন নম্বরে খেললে অমন ত্রিশ-চল্লিশ আমিও করতে পারি।’
সৌম্য লাজুক হাসেন। কিছুক্ষণ পর মুখে সেই হাসিটা রেখেই জানান, তাঁর বাবা কিশোরীমোহন সরকারের একটা কবিতার বই বেরিয়েছে গত বইমেলায়। নাম—তোমরা যদি না জাগো তো...। তা কবিপুত্র সৌম্যও কি কবিতা-টবিতা লেখেন নাকি? সৌম্য ধারণাটাতেই যেন খুব লজ্জা পান, ‘না, না, আমি কবিতা পড়িও না।’
নাসির হোসেন খুব ছটফটে ছেলে। এই উঠছেন, এই বসছেন। খেলতে না পেরেও সবার মতোই খুশি। বাংলাদেশ দলের মিডিয়া ম্যানেজারের আইফোনে ধারণ করা আগের রাতের ড্রেসিংরুমের উল্লাস দেখতে দেখতে বলেন, ‘রাবীদ ভাই, আমাকে ভিডিওটা দিয়েন।’ ম্যাচ জিতলে ড্রেসিংরুমে সবাই মিলে ‘আমরা করব জয়’ গাওয়ার রীতিটা আগের মতো এখনো আছে। তবে আবহ সংগীত হিসেবে ধুপধাপ শব্দটা এই বিশ্বকাপে নতুন যোগ হয়েছে। পরিবেশনাটা একটু আধুনিকায়ন করতে এখন যে সেটি ব্যাট-স্টাম্প দিয়ে টেবিলে বাড়ি দিতে দিতে গাওয়া হয়!
সাত-আট সারি সামনে মুশফিককে উঠে দাঁড়াতে দেখে নাসির বলেন, ‘মুশফিক ভাইয়ের সেঞ্চুরিটা পাওয়া উচিত ছিল। কী দারুণই না ব্যাটিং করছেন!’ সাকিব টেকনিক্যাল ব্যাখ্যা দেন, ছক্কা মারার চেষ্টাটা পরের ওভারে করলেই তা হয়ে যেত। অন্য প্রান্তে বাউন্ডারি একটু ছোট ছিল।
আগের রাতের ম্যাচের কথা ঘুরেফিরে আসে। সংবাদ সম্মেলনে এউইন মরগানের হেনস্তার কথা শুনে সাকিব বলেন, ‘ওর জন্য খুব খারাপ লেগেছে। কেকেআরে একসঙ্গে খেলেছি, খুব ভালো ছেলে।’ সাকিবের দুর্দান্ত এক ক্যাচেই শেষ হয়েছে মরগানের ইনিংস। একটু আগেই মাশরাফি মুগ্ধতার সুরে বলেছেন, ‘সাকিব বলেই অমন কঠিন ক্যাচটা এত সহজভাবে নিতে পেরেছে।’ ম্যাচের পর সাকিবকে মরগান বলতেই পারতেন, ‘তোমার জন্যই আমার ক্যাপ্টেন্সিটা বোধ হয় গেল।’ বলেছেন নাকি? সাকিব হাসেন, ‘খেলায় কি আর বন্ধুত্ব আছে? মঈন আলী আমার এত ভালো বন্ধু! অথচ ও-ই তো আমাকে আউট করে দিল!’ এই বন্ধুত্ব অনেক পুরোনো। ইংল্যান্ডের বাইরে যখন মঈন আলীর নামই কেউ শোনেনি, তখন সাকিব তাঁর উস্টারশায়ার সতীর্থকে ঢাকার লিগে নিজের দলে খেলতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
জয় আর কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার আনন্দ ম্যাচটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। সেটি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বলে তৃপ্তিটা আরও বেশি। বিশ্ব ক্রিকেটে ‘তিন মোড়ল’-এর মাতব্বরি নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মনেও তুষের আগুন জ্বলে। মাঠেও সেটি প্রকাশ হয়েছে। ক্রিস জর্ডানের রানআউট নিয়ে যখন টিভি আম্পায়ার গবেষণায় ব্যস্ত, বাংলাদেশের এক ক্রিকেটার তাঁকে বলেছেন, ‘বিগ থ্রি-ও তোকে বাঁচাতে পারবে না রে...।’
টুকটাক বাগ্যুদ্ধ আরও অনেকই হয়েছে। জো রুটের সঙ্গেই বেশি। ম্যাচে এত সব নাটকীয় মোচড়, তবে মাশরাফির কাছে রুটের আউটটাই টার্নিং পয়েন্ট, ‘খতরনাক প্লেয়ার। ও থাকলে ম্যাচ বের করে নিয়ে যেত।’ রুটকে রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটাও তাই বাংলাদেশের ব্লুপ্রিন্টে ছিল। তাতে কাজও হয়েছে। না হয়ে উপায় কী? রুটকে যদি কেউ বলেন, ‘ওয়ার্নার তোকে চড় মেরে ঠিকই করেছিল’, বেচারার রাগ না করে উপায় আছে!
এসবের স্মৃতিচারণা হয় আর বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা হেসে ভেঙে পড়েন। স্লো ওভার রেটের কারণে জরিমানার কথা বলার সময়ও হাসেন মাশরাফি। ‘দুই ওভার পেছনে আছি জানতাম। অন্য কোনো ম্যাচ হলে একে-তাকে দিয়ে বোলিং করিয়ে কাভার করার চেষ্টা করতাম। কাল ওসব ভাবিইনি, জরিমানা হলে হবে। ম্যাচটা জিততে হবে।’ বাংলাদেশের সব খেলোয়াড়ের ম্যাচ ফির ২০ শতাংশ কাটা গেছে। অধিনায়ক বলে মাশরাফির দ্বিগুণ। সাকিব জানতে চান, ‘আরেকটি ম্যাচে এমন হলে কি ম্যাশ ব্যানড্ হয়ে যাবে?’ হবেনই তো, তাহলে অধিনায়কত্ব করবে কে? সাকিবই করবেন, ওয়ানডে দলের সহ-অধিনায়ক তো তিনিই। সাকিব উড়িয়ে দেন, ‘আরে না, আবার এমন হবে নাকি!’
মাশরাফি পাশ থেকে বলেন, ‘আশায় থাক’! আবার এক দফা হাসি। টলস্টয় যে বলেছিলেন, সব সুখী পরিবারই একরকমভাবে সুখী আর সব অসুখী পরিবার নিজেদের মতো করে অসুখী; সেই কথাটা মনে পড়ে। সাফল্যের আনন্দে সব সুখী দলই একরকম আর সব অসুখী দলই নিজেদের মতো করে অসুখী।
বাংলাদেশ দল এখন সুখী পরিবারের বিজ্ঞাপন!