ইমরানকে লিডার বললে ‘এল’টা বড় হাতে লিখুন

উৎপল শুভ্র

২১ মার্চ ২০২১

ইমরানকে লিডার বললে ‘এল’টা বড় হাতে লিখুন

ইমরান খান

যিনি কথাটা বলছেন, তাঁর নাম আকিব জাভেদ। মেলবোর্নের ল্যাংহাম হোটেলের ব্রেকফাস্ট টেবিলে যখন ইন্টারভিউ করছি, তখন তাঁর পরিচয় ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়া সংযুক্ত আরব আমিরাত দলের কোচ। তবে আসল পরিচয় তো ১৯৯২ বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান দলের পেসার। সেই বিশ্বকাপ আর ইমরান খানকে নিয়েই ইন্টারভিউ। যা প্রশ্নোত্তর আকারে লিখতে গিয়ে মনে হয়েছিল, ইমরান খানকে নিয়ে আপ্লুত আকিব জাভেদ গড়গড় করে যা বলে গেছেন, সেটি তাঁর জবানিতে লেখাই ভালো।

প্রথম প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০১৫। প্রথম আলো।

আমার সঙ্গে কথা হলেই সবাই ১৯৯২ বিশ্বকাপের কথা তোলে। যেটির কথা মনে হওয়া মাত্র আমার চোখের সামনে একটা মুখই ভেসে ওঠে—ইমরান খান। ওই লোকটার কারণেই আমরা বিশ্বকাপ জিতেছিলাম। ইমরানের কথা উঠলেই সবাই বলে দারুণ এক নেতা, দুর্দান্ত অনুপ্রেরণাদায়ী ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আরও সহজভাবে ব্যাখ্যা করি। ইমরান খানের তিনটি জিনিস ছিল—১. তিনি ছিলেন সৎ, ২. সাহসী, ৩. কঠোর পরিশ্রমী। এই তিনেই ইমরান খান। বড় নেতা হতে গেলে এই তিনটি জিনিস আপনার থাকতেই হবে। আপনার সততা থাকলে লোকে আপনাকে সম্মান করবেই, আপনার কথা শুনবে। সাহসী হওয়া মানে আপনি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আর পরিশ্রম, এখনো দেখেন না, ইমরান কী অক্লান্ত পরিশ্রমটাই না করে যাচ্ছেন! 

আকিব জাভেদ: এত বছর পরও ইমরান খানে একই রকম আপ্লুত

১৯৯২ বিশ্বকাপের কথা বলি। সত্যি বলছি, ইমরান ছাড়া আমরা আর কোনো খেলোয়াড়ই বিশ্বকাপ জেতার আশা করিনি। আমার এখনো চোখে ভাসে, পার্থে অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান ম্যাচের আগে ইমরান ড্রেসিংরুমে ঢুকছেন। আমরা সবাই তখন বিধ্বস্ত। অথচ ইমরান ভোজবাজির মতো আধা ঘণ্টার মধ্যেই সবাইকে বদলে দিলেন। সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করল, আজ আমরাই জিতব।

শুরুতেই যখন বললেন, আমি এখনো বিশ্বাস করি, আমরা এই বিশ্বকাপ জিততে পারি, আমরা সবাই স্তম্ভিত, লোকটা পাগল নাকি! বক্তৃতাটা এখনো আমার কানে বাজে—অস্ট্রেলিয়ানদের চাপে ফেলার একটাই উপায়, আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়া। যদি রক্ষণাত্মক মানসিকতা নিয়ে নামি, ওরা আমাদের গুঁড়িয়ে দেবে। মাঠে নেমে সবাই ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। দুই স্লিপ, এক গালি থাকবে; বাউন্সার, আউট সুইঙ্গার যার যা আছে সব দেখিয়ে দাও...আমার শুধু উইকেট চাই, রান-টানের কথা ভাবার দরকার নেই। বিশ্বকাপ জিতব, তোমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না তো! একটু ভেবে দেখো, এই ম্যাচটা জিতলে এর পর শ্রীলঙ্কা, ওটা তো আমরা জিতবই। এরপর খেলা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ওদের আমরা সব সময় বলে-কয়েই হারাই। এরপর সেমিফাইনাল-ফাইনাল। ওই বক্তৃতায় সবাই টগবগ করতে করতে মাঠে নামলাম। আমি নিজে আগে-পরে কোনো দিন এমন উদ্দীপ্ত বোধ করিনি। মাঠে নামার সময় মনে হচ্ছিল, কে ব্যাটসম্যান তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। আজ আমাকে কেউ খেলতে পারবে না।

ওই বিশ্বকাপে আমি নতুন বলে বোলিং শুরু করে টানা দশ ওভার করে যেতাম। আমাদের বোলিং বলতে তখন আমি, ওয়াসিম (আকরাম) আর মুশতাক। জেনুইন সিমার বলতে দুজন। ইমরানের কাঁধে এমন চোট ছিল যে, কীভাবে বোলিং করেছেন তা ভেবে আমি এখনো অবাক হই। ইমরান তখন রান আটকে রাখা বোলার। আর আমাদের কাছে তাঁর একটাই দাবি ছিল—উইকেট চাই।

এমন না যে, ‘নামো জওয়ান, উড়িয়ে দাও’ বলেই দায়িত্ব শেষ করতেন। প্রত্যেককে সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিতেন, কী করতে হবে। আমাকে যেমন বলতেন, তোমাকে দুটি স্লিপ দিচ্ছি, একটা গালি, এবার তোমার আউট সুইঙ্গার দেখাও। মাঝেমধ্যে একটা বাউন্সার ছাড়ো। ওয়াসিমকে আমার সামনেই ডেকে বলেছিলেন, নো-ওয়াইড নিয়ে ভাবার দরকার নেই, তোমার কাজ জোরে বল করা। ওদের কাঁপিয়ে দাও। ওয়াকার তো বিশ্বকাপের আগে আগে ছিটকে পড়ল। এর আগে যখন আমরা তিনজন একসঙ্গে খেলেছি, ওয়াকারের প্রতি তাঁর একটাই নির্দেশ থাকত, সোজা স্টাম্পে বল করো।

পাকিস্তানি পেস চতুষ্টয়: ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান, ওয়াকার ইউনিস ও আকিব জাভেদ। ছবি কৃতজ্ঞতা: দ্য ডন

ইমরানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের দিনটাও পরিষ্কার মনে আছে। ১৯৮৮ সালের শুরুর দিকে আমি আন্ডার নাইনটিন টিমের অনুশীলনে নেটে বল করছি। সেবারই প্রথম হতে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ক্যাম্প। মুদাসসর নজর ও ইমরান আমার বোলিং দেখে আমার কী নাম, কোথায় বাড়ি এসব জানতে চাইলেন। ইমরান হঠাৎ আমাকে বললেন, ওরা যদি তোমাকে দলে না নেয়, তুমি এসে ন্যাশনাল টিমের নেটে বোলিং করবে। আমি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সুযোগ পেলাম। মাঝেমধ্যে ইমরানের কথাটা মনে পড়ত আর ভাবতাম, হঠাৎ কী মনে হয়েছিল বলেছেন, ইমরান কি আর আমাকে মনে রেখেছেন!

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ছয় মাস পর কে যেন এসে বলল, ইমরান তো তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তোমাকে ভারতে চ্যারিটি ম্যাচ খেলার জন্য নিতে চায়। ভারতে গেলাম। প্রথম ম্যাচের দিন সকালে মাঠে এসে ইমরান আমাকে বললেন, তুমি তো নতুন বলে বোলিং করো, তাই না? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমার হাতে বল দিয়ে ইমরান ফিল্ডিং সাজালেন। একটা স্লিপ, একটা গালি, স্কয়ার লেগ...ওয়ানডের ফিল্ড প্লেসিং যেমন হয় আরকি! সাজিয়ে জানতে চাইলেন, ফিল্ড সেটিং ঠিক আছে কি না। আমি বললাম, না, স্কয়ার লেগ ফিল্ডারটাকে আমি দ্বিতীয় স্লিপে চাই। কারণ, আমার বল বেরিয়ে যায়। স্ট্রাইকিং এন্ডে ছিলেন সুনীল গাভাস্কার! ওই বয়সে গাভাস্কার-টাভাস্কার কাউকেই কিছু মনে হয় না। ইমরান একটু চমকে গিয়ে হেসে বললেন, ওকে। আমি দুই উইকেট নিয়েছিলাম। দুটিই স্লিপে ক্যাচ। ওই সফরের পর টিম সিলেক্ট হয়ে যাওয়ার পরও তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইমরান আমাকেও অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে ছাড়লেন। এভাবেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার যাত্রা শুরু। 

খেলার বাইরেও ইমরানের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তাঁকে দেখেও অনেক কিছু। এরপর অন্য ক্ষেত্রে কত সফল মানুষের সঙ্গেই তো পরিচয় হলো, কিন্তু ইমরানের মতো আর কেউ আমাকে এতটা প্রভাবিত করতে পারেনি। কোথায় ইমরান আলাদা ছিলেন, জানতে চান? চিন্তায়, ভিশনে। তাঁর মনটা সব সময়ই অন্যদের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকত। এখনো তা-ই আছে। এ কারণেই তাঁর যাত্রা ক্রিকেটেই শেষ হয়নি, এখন আরও বড় পরিসরে কাজ করছেন। আমার সব সময়ই এমন কিছু হবে বলে মনে হতো। কারণ, ছোট কিছুতে ইমরানের আগ্রহ ছিল না। তাঁর মানসিকতাই ছিল বড় কিছু ভাবা।

দেখুন না, খেলা ছাড়ার পর দিব্যি কমেন্ট্রি-টমেন্ট্রি করে আরামে দিন কাটাতে পারতেন। প্রথমে ক্যানসার হাসপাতাল করলেন। এখন নেমেছেন পাকিস্তানকে বদলে দেওয়ার কাজে। এমনই হওয়ার কথা, কারণ কঠিন চ্যালেঞ্জ নেওয়াটাই ইমরানের পছন্দ। তাঁর সঙ্গে যখনই কথা হয়েছে, দেখেছি সাধারণ কোনো কিছুতে তাঁর আগ্রহ নেই। সব সময়ই বড় চিন্তা। ইমরানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ নেই, তবে আমার শুভকামনা সব সময়ই তাঁর সঙ্গে আছে। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, শুধু পাকিস্তান নয়, ইমরান বিশ্বকেই বদলে দিতে পারেন। ইমরান সৎ, বৈষয়িক লোভ নেই, নিজের জন্য কিছু করছেন না। ইমরান লিডার, এটা সবাই জানেন। তা লিডার তো অনেকেই। ইমরান খানের ক্ষেত্রে আমি বলব, ইমরানকে  লিডার লেখার সময় ‘এল’ অক্ষরটা বড় হাতে লিখুন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×