চোখে দেখেও যা বিশ্বাস হতে চায় না!

উৎপল শুভ্র

৬ জানুয়ারি ২০২২

চোখে দেখেও যা বিশ্বাস হতে চায় না!

অমর এক ছবি

এ এমনই এক জয়, চোখে দেখেও যা বিশ্বাস হতে চায় না। প্রতিপক্ষ টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ড, এটা তো শুধুই একটা কারণ। তার চেয়েও বড় কারণ তো খেলাটা নিউজিল্যান্ডে, যেখানে এতদিন পরাজয়ই হয়ে ছিল বাংলাদেশের নিয়তি। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে জয় তাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমানা অদৃশ্য করে দেয়!

অবিশ্বাস্য! অভাবনীয়! অচিন্তনীয়! অত্যাশ্চর্য! অকল্পনীয়!

আর কী কী যথাশব্দ আছে বলুন তো! এত সব বলেও যে মাউন্ট মঙ্গানুই মহাকাব্যকে ঠিক ধরা যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার প্রায় দশ ঘণ্টা পর লিখতে বসেও তো দেখি ঘোর কাটছে না! যা হয়েছে, তা কি সত্যি? নাকি কোনো সুখস্বপ্ন, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর যেটির রেশই শুধু সম্বল হয়ে থাকবে! 

এবাদত হোসেন যেন রূপকথার এক নায়ক!
লেখার শুরুতে 'অ' দিয়ে শুরু বিস্ময়সূচক যে শব্দগুলো লিখেছি, তা এত পরিচিত লাগছে কেন? আগেও কি তাহলে এমন লিখেছি কখনো! প্রথমে স্মৃতি, এরপর আর্কাইভ ঘেঁটে আবিষ্কার করা গেল, ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফতুল্লা টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষেও লেখার ইন্ট্রোটাই আসলে কপি-পেস্ট করে দিয়েছে অবচেতন মন। বাংলাদেশ ৪২৭ করে ফেলার পর ৬ উইকেটে ১৪৫ অস্ট্রেলিয়া যেদিন ২৮২ রানে পিছিয়ে। লেখালেখিতে পুনরাবৃত্তি গুরুতর দোষ বলে বিবেচিত, তারপরও তা বদলাতে গিয়েও থমকে গেলাম। আনন্দ-উচ্ছ্বাস-তৃপ্তি এসব অনুভূতি ছাপিয়ে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট ম্যাচ যে শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাসেই আচ্ছন্ন করে রাখছে। থাকুক, এটাই থাকুক।

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা জয়, এ নিয়ে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। ২০০৫ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ও হয়তো বিস্ময়ের রিক্টর স্কেলে একই মাত্রা ছুঁয়েছিল। তবে তা ছিল ওয়ানডে। নির্দিষ্ট একটা দিন কারও ভালো-কারও মন্দ যাওয়াটা যেখানে নির্ধারক হয়ে যায়। কিন্তু টেস্ট ম্যাচ তো তা নয়। এখানে শর্টকাট সাফল্যের রাস্তা দেয়াল তুলে বন্ধ। খেলাটাই যে শর্টকাট নয়। ক্রিকেটের অন্য দুই ফরম্যাট তো নয়ই, অন্য কোনো খেলাতেও পিছিয়ে পড়ার পর ফিরে আসার জন্য এমন অফুরন্ত সময় ও সুযোগ নেই। নিউজিল্যান্ডেরও সেই সুযোগ ছিল, সময় তো বটেই...কিন্তু আসলে কী হয়েছে? সময় যত গড়িয়েছে, বাংলাদেশের তরুণ এই দল ততই বজ্রআঁটুনিতে বেঁধে ফেলেছে নিউজিল্যান্ডকে।

সেই নিউজিল্যান্ড, টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট যাদের মাথায়। সেই নিউজিল্যান্ড, ২০১৭ সাল থেকে যারা দেশের মাটিতে অপরাজেয় এক দল। সেই নিউজিল্যান্ড, স্বভূমে টানা ১৭টি টেস্ট ম্যাচে যারা পরাজয় কাকে বলে জানে না।

প্রথম ইনিংসে মুমিনুল আর লিটনের ব্যাটিংয়ে দূরাকাশে প্রথম উঁকি দিয়েছিল অসম্ভবের স্বপ্ন
এই নিউজিল্যান্ড তো সর্বজনীন। সবার জন্যই তা এক। এর বাইরেও তো বাংলাদেশের একক যন্ত্রণা হয়েও আরও অনেক কিছু ছিল। যেসবের যোগফলে সেই কবে থেকেই বাংলাদেশের জন্য ভীতিকর এক গন্তব্যের নাম নিউজিল্যান্ড। যেখানে যাওয়ার সময়ই সবার জানা, জয়-পরাজয়ের হিসাবে বাঁদিকের সংখ্যাটা কত বাড়বে, তা হয়তো পরিবর্তনশীল; তবে ডানের সংখ্যাটা ধ্রুব। ২০০১ সালে সেখানে সেই যে ‘শূন্য’ বসেছে, পরের ২০ বছরেও তাতে কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু বাঁয়ের সংখ্যাটাই ধাই ধাই করে বাড়তে বাড়তে হয়ে গেছে ৩২। টেস্ট জয়ে শেষ হবে নিউজিল্যান্ডে পরাজয়ের এই মিছিল...এমন স্বপ্ন কি আদৌ দেখেছিলেন কেউ? স্বপ্ন না বলে কল্পনাই বলি না কেন, কারও কল্পনাই নাগাল পেয়েছিল এমন কিছুর। মুমিনুল হক তো আর এমনিই বলছেন না যে, নিউজিল্যান্ডে টেস্ট জয়ের কথা বললে লোকে তাঁকে পাগল বলত!

সেই সম্ভাবনা/আশঙ্কা তো ছিলই। নিজেদের দেশে দুদর্মনীয় নিউজিল্যান্ড, সেই নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের দুঃস্বপ্নের সব স্মৃতি এসবকে যদি ‘পাস্ট ইজ পাস্ট’ বলে কেউ উড়িয়েও দিতে চাইতেন, ‘প্রেজেন্ট’-তো ছিল নৈরাশ্যের আরও কালো আঁধারে ঢাকা। নিউজিল্যান্ডের এই দলটি তর্কাতীতভাবে তাদের ইতিহাসের সেরা। আর তাদের সঙ্গে খেলতে যে দলটি ক্রাইস্টচার্চে গিয়ে নেমেছিল, তাসমান সাগরপাড়ের দেশে এর চেয়ে অনভিজ্ঞ দল আর কখনো পাঠায়নি বাংলাদেশ। হ্যাঁ, ২০০১ সালে প্রথম সফরের দলটি টেস্ট অভিজ্ঞতায় হয়তো আরও পিছিয়ে, তবে সেটি তো ছিল অন্তত বাংলাদেশের সেরা দল। এবার যেখানে তামিম নেই, সাকিব নেই, নিউজিল্যান্ডে যাঁর ব্যাট থেকে রানের ফল্গুধারা ঝরে, নেই সেই মাহমুদউল্লাহও। টেস্ট ক্রিকেটে যেখানে পরিণত মস্তিষ্ক দাবি করে, সেখানে বিশের ঘরেই বেশিরভাগ খেলোয়াড়। সবকিছু মিলিয়েই এ এক অসম লড়াই।

তা মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে অসম লড়াই-ই তো হলো! প্রথম দিনটাকে যদি সমানে-সমান ধরেন, দ্বিতীয় দিন থেকেই তো অবিসংবাদী চালকের আসনে বাংলাদেশ। এমনই যে, টেস্টের চার দিন যাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ আর নিউজিল্যান্ড নয়, একমাত্র প্রতিপক্ষ ইতিহাস। ক্রিকেটীয় দক্ষতার সীমা ছাড়িয়ে যা পরিণত দুর্লঙ্ঘ্য এক মনস্তাত্ত্বিক বাধায়। নিউজিল্যান্ড জানত, বাংলাদেশ এখান থেকেও হারতে পারে। বাংলাদেশও জানত, যোগ-বিয়োগ করার ৫ উইকেটে মাত্র ১৭ রান নিয়ে পঞ্চম দিন শুরু করা নিউজিল্যান্ড এখান থেকেও কিছু একটা করে ফেলতে পারে।

যেন-তেনভাবে জিতলেও এই জয় বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরার স্বীকৃতি পেয়ে যেত। সেখানে যে দাপট দেখিয়ে, যেভাবে আধিপত্য বিছিয়ে এই জয়, তা শুধু তর্কটাকেই অকারণ বানিয়ে ফেলেনি, পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই বাধ্য করেছে অবিশ্বাসে চোখ কচলাতে। এমন এক জয়, চোখে দেখেও যা বিশ্বাস হতে চায় না।

বাংলাদেশ দলে যে দুজন টেস্ট ক্রিকেটটাকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি হৃদয়ে ধারণ করেন, জয়ের মুহূর্তে তাঁরাই ছিলেন উইকেটেপ্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ডকে ৩২৮ রানে শেষ করে দিয়ে নিজেরা ৪৫৮ করে ফেলার পরও বাজির দর নির্ঘাত বাংলাদেশের জয়ের পক্ষে কথা বলেনি। নিউজিল্যান্ডে চার শ পেরোনো স্কোর তো বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। এই টেস্টের আগে সর্বশেষ পাঁচ টেস্টেই যা তিন বার হয়েছে। একবার তো ডিক্লেয়ার না করলে ছয় শ-ই হয়ে যায়। এই পাঁচ টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ৭টি সেঞ্চুরি, যার একটি আবার ডাবল। ওই সাত সেঞ্চুরির পাঁচ সেঞ্চুরিয়ানের (সাকিব ও মাহমুদউল্লাহর দুটি করে সেঞ্চুরি) কেউই যে এবার নেই, সিরিজ শুরুর আগে এই তথ্যটাও কি মনে একটু খচখচানি জাগায়নি!

তাহলে কোথায় আলাদা হয়ে গেল এই বাংলাদেশ? ভয়ডরহীন তারুণ্যে? কোনো প্রত্যাশাই নেই না বলে প্রত্যাশার চাপ বলেও কিছু না থাকা? ক্রিকেটীয় উত্তর খুঁজতে গেলে আগের তিনটি চার শ প্লাস ইনিংসের সঙ্গে এবারেরটির পার্থক্য কিছুটা হলেও দিয়ে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর। ১৭৬.২ ওভার ব্যাটিংয়ে, মাহমুদুল হাসান জয় থেকে মেহেদী হাসান মিরাজ পর্যন্ত প্রথম আট ব্যাটসম্যানেরই ৫০-এর বেশি বল খেলায়। এই প্রথম নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ শুধু রানই করেনি, টেস্টে যেমন খেলা উচিত, তেমন খেলেই রান করেছে। 

সেটাই কি আর জয়ের নিশ্চয়তা ছিল? অসমান বাউন্সের উইকেটে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং তো চোখ রাঙিয়েই যাচ্ছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ড যখন ২ উইকেটে ১৩৬, সেই চোখ আরও রক্তবর্ণ। সেখান থেকে ৩৩ রানে শেষ ৮ উইকেট হারিয়ে ১৬৯ রানে অলআউট হয়ে যাবে নিউজিল্যান্ড...এটা তো রীতিমতো ভোজবাজির মতো ব্যাপার। বাংলাদেশকে এমন ভেঙে পড়তে দেখতে আমরা খুবই অভ্যস্ত, প্রতিপক্ষকে নয়। 

এবাদতের স্যালুট এখন এবাদতের একার নয়যাঁর কল্যাণে এমন হলো, তিনি নিজেই তো মূর্তিমান এক ভোজবাজি। এই টেস্টের আগে যাঁর বোলিং অ্যাভারেজ আর স্ট্রাইক রেট দলকে অস্বস্তি আর নিন্দুকদের ট্রলের উপাদান সরবরাহ করে গেছে, সেই এবাদত হোসেন যেন রূপকথার এক নায়ক। উইকেট নেওয়ার পর নিজের বিমানবাহিনী-অতীত মনে করিয়ে দেওয়া স্যালুটটা আগেও দিয়েছেন। তবে চোখে ঘুম নিয়ে ভোর রাতে টেলিভিশনে দেখা ওই স্যালুটের দৃশ্যে এবার যেন অন্যরকম এক ব্যঞ্জনা।

যা দেখছি, তা সত্যি কি না অনুভূতিটা আরও তীব্র করে তোলার মতো।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×